যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ বেশ কয়েকটি স্টেটে ২০ মে টানা ৬০ দিন অতিবাহিত হলো লকডাউনের। কবে নাগাদ এমন ভীতিকর পরিস্থিতির অবসান ঘটবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে না পারলেও সকলেই উদগ্রীব স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে। বিশেষ করে অর্থকষ্টে পড়া লোকজন আর ঘরে বসে থাকতে চাচ্ছেন না। স্বাস্থ্যনীতি মেনেই সকলে কর্মযজ্ঞে ফিরতে আগ্রহী।
এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা কেমন আছেন, কীভাবে অতিবাহিত হচ্ছে বিদেশ-বিভূইয়ে ঘরে থাকার সময়গুলো, করোনা পরিস্থিতির কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে কীভাবে শুরু করবেন জীবন-যাত্রা ইত্যাদি নিয়ে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনদের সাথে।
সকলেই প্রচণ্ড রকমের অস্থিরতায় কাটিয়েছেন প্রতিটি মুহূর্ত। পরিবারের সান্নিধ্যে ঘরে অবস্থান সত্বেও ভেতরে ভেতরে মহাদুশ্চিন্তায় ছিলেন সকলেই। কে কখন আক্রান্ত হন, কখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সম্পর্ক-এমন টেনশন সকলকেই গ্রাস করেছে প্রতিনিয়ত। অধিকাংশই বলেছেন, ঘুম ভেঙেছে মৃত্যু সংবাদ দিয়ে এবং রাতে ঘুমুতে যাবার আগেও পরিচিতজনের চিরবিদায়ের সংবাদ শুনতে হয়েছে। জীবিত লাশের ন্যায় দিন কাটিয়েছেন প্রবাসীরা। এমন অস্থিরতা আর কখনোই কাউকে গ্রাস করতে পারেনি।
বিটিভির দাপুটে অনুষ্ঠান-প্রযোজক এবং পরবর্তীতে চারণ কবি হিসেবে খ্যাত সন্দ্বীপের বেলাল বেগ বেশ ক’বছর থেকেই নিউইয়র্কে বাস করছেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন। তিনি বললেন, এ আতঙ্ক কেবল ব্যক্তিগত নয়, পারিবারিক কিংবা সামাজিক নয়। এটি সমস্ত মানবজাতির জন্যে ভয়ঙ্কর একটি আতংক। আমরা আদৌ বাঁচবো কিনা-সে শঙ্কায় তাড়িত হচ্ছি। মূলত: প্রতিটি মানুষই করোনার কারাগারে বন্দি। অদ্ভূত এক পরিবেশে ক্ষীণ আশা নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টায় আছি। করোনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পরও আমরা নিস্তার পাবো না। অকল্পনীয় এক অর্থনৈতিক শঙ্কা রয়েছে। সেজন্যেও প্রস্তুতি থাকতে হবে।
আইটি প্রশিক্ষণের খ্যাতনামা ইন্সটিটিউট ‘পিপল এন টেক’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আবু হানিপ বলেন, মার্চের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবতরণের পরই বাসায় না উঠে কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম ১৪ দিন। এরপর পরিবারের সান্নিধ্যে এলেও একইভাবে আটকে রয়েছি বাসায়।
লেখক এবং অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ফাইজুল ইসলাম বললেন, ১৯৩০ সালের মহামন্দা এবং ২০০৮ সালের মন্দার চেয়েও কঠিন এক পরিস্থিতির আভাস পাচ্ছি করোনা পরবর্তী সময়ে। অর্থাৎ এই করোনায় জীবন কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি অর্থ-সম্পদ গ্রাসের ফাঁদও পেতেছে। মানবজাতির জন্যে কঠিন এক সংকট এনেছে করোনা নামক অদৃশ্য এক শত্রু।
ইউএস সেনসাস ব্যুরোর সাবেক ডিজি এবং যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ড. খন্দকার মনসুর বলেন, জীবনে বহু সমস্যা-সংকট দেখেছি। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হইনি। স্বেচ্ছায় গৃহবন্দিত্বের যে কী কষ্ট তা সকলেই এখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছি।
খ্যাতনামা শ্রমিক ইউনিয়ন লিডার মাফ মিসবাহ উদ্দিন বলেন, পুরোটা সময়ই বাসায় কাটাচ্ছি। তবে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব হয়নি। ফোন, অনলাইন এবং ভাচুয়াল মিটিং করতে হচ্ছে। আমার সংগঠনের অনেকেই অত্যাবশ্যকীয় পেশায় নিয়োজিত। তাদেরকে দিক-নির্দেশনা ছাড়াও যারা আক্রান্ত হয়েছেন বা কোন সমস্যায় পড়েছেন তাদেরকে পরামর্শ দিতে হয়।
৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক হাসানুজ্জামান অবরুদ্ধ জীবনেও থেমে নেই। নিউইয়র্ক সংলগ্ন লং আইল্যান্ডে নিজ বাসায় অবস্থানকারি হাসান প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এভাবেই তাদের অস্থির সময় কেটে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ঐসব প্রতিষ্ঠানের আশপাশের গরিব-অসহায় মানুষদের মধ্যে ত্রাণ-সামগ্রিও বিতরণ করিয়েছেন প্রতিনিধির মাধ্যমে।
নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরী বলেন, দিন কাটছে পরিবারের সান্নিধ্যে টিভি এবং অনলাইনে নিউজ দেখে। সাংগঠনিক মিটিং চালাচ্ছি অনলাইনে। সাংগঠনিক ভাবে ত্রাণ-তৎপরতাতেও অংশ নিয়েছি।
কন্সট্রাকশন কন্ট্রাক্টও এবং যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বললেন যে, দিন কাটছে অসহনীয় এক দুশ্চিন্তায়। টেলিফোন, ই-মেল এবং অনলাইন হচ্ছে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সারাক্ষণ পরিচিতজন ছাড়াও দেশে স্বজনের সাথে যোগাযোগ রাখছি। সাংগঠনিকভাবে ঘনিষ্ঠজনদের সাথেও কথা বলছি, খোঁজ-খবর নিচ্ছি।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সোসাইটির ঝুলে থাকা নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী কাজী নয়ন বললেন, প্রথম একমাস কাটে একাকীত্বে। নিজ বাসায়ই কোয়ারেন্টিনে ছিলাম। কারণ আমি চাইনি পরিবারের কেউ এমন মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হোক। ফোনে পরিচিতজনদের খোঁজ খবর নিয়েছি। করোনায় মারা যাওয়াদের মধ্যে যারা একেবারেই অসহায় ছিলেন ফিউনারেল খরচসহ কবর ক্রয়ে, তাদের জন্যে সাধ্যমত সহায়তা দিয়েছি।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা এবং মূলধারার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘আরএলবি সেইফটি’র মালিক আকতার হোসেন বাদল বললেন ভিন্ন কথা। কারণ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুটোই খুবই জরুরি আইটেমে পরিপূর্ণ হওয়ায় প্রতিদিনই স্টোরে থাকতে হচ্ছে। সে এক অন্যরকম আনন্দ বলে উল্লেখ করলেন বাদল। এভাবেই সকাল-সন্ধ্যা কাটলেও রাতে বাসায় ফিরে ফোনে প্রিয়-পরিচিতজনদের খোঁজ নিচ্ছি।
যুক্তরাষ্ট্র জাসাসের সভাপতি আলহাজ্ব আবু তাহের বলেন, বেঁচে থেকেও মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করার মত শিক্ষা পেলাম সকলে। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ না থাকার দীক্ষা পেলাম বলেই মনে হচ্ছে। আশা করছি, করোনা পরবর্তী নতুন বিশ্বে সকলেই আমরা মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত হতে কোন কার্পণ্য করবো না।
ল’ ফার্মের কর্মকর্তা এবং অভিবাসন বিষয়ে প্রবাসীদের যথাযথ সহায়তা প্রদানে খ্যাতি অর্জনকারি ড. রফিক আহমেদ বললেন, এটি হচ্ছে জীবনে প্রথম বড় একটি কষ্ট। কখনো এমন অসহায়বোধ করিনি। করোনাকাল প্রতিটি মানুষেরই নতুন এক অভিজ্ঞতা এনে দিল একাকীত্ম সম্পর্কে। আশা করছি শীঘ্রই এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবো।
নির্মাণ ব্যবসায়ী এবং যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারি হাজী আব্দুল কাদের মিয়া বললেন, ব্যস্ততার জন্যে আগে পরিবারকে তেমনভাবে সময় দিতে পারিনি। করোনায় সে সুযোগ অবারিত করেছে। ৫ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি সন্তানদের সাথে নানা বিষয়ে কথা বলে সময় কাটাচ্ছি।
যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কোষাধ্যক্ষ আলিম খান আকাশ বলেন, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় কাটছে। মাঝেমধ্যে এখানকার এবং বাংলাদেশে প্রিয়-পরিচিতজনদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি ফোনে। দিন কাটে স্ত্রী-সন্তানের সাথে টিভি সংবাদ এবং অনুষ্ঠান দেখে।
যুক্তরাষ্ট্র যুবদলের নেতা এম এ বাতিন বলেন, অবরুদ্ধ অবস্থায় করোনার আতঙ্কের মধ্যেই প্রায় রাতে টেলি-কনফারেন্সে মিলিত হচ্ছি আমরা। বিভিন্ন দেশের নেতা-কর্মীরাও অংশ নিচ্ছেন এই কনফারেন্সে। পারস্পরিক কুশলাদি ছাড়াও করোনা পরবর্তী সময়ে করণীয় নিয়েও কথা হচ্ছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, জাসাসের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খানসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও আসছেন টেলি-কনফারেন্সে। এভাবেই সাংগঠনিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চালাচ্ছি।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা