কবি অধ্যাপক ফরিদা মজিদ প্রয়াত হয়েছেন ঢাকায়। কণ্ঠে ক্যানসার নিয়ে বিদায় নিলেন ২৮ সেপ্টেম্বর। মৃত্যুকালে বয়েস হয়েছিলো প্রায় ৭৯ বছর। প্রগতিশীল ও সৃষ্টিশীল নারী-ব্যক্তিত্বের বিদায়ে সর্বত্র শোকের ছায়া। প্রবাসের সংস্কৃতিসেবী ও লেখকরাও স্মৃতিচারণ করেছেন। নানাজনের কণ্ঠে শোকভরা স্মৃতি তর্পণ।
মৃত্যুর পরপরই ফেসবুকে আবেগপ্রবণ পোস্ট দেন কবি সালেম সুলেরী। ঢাকায় ফরিদা মজিদ তিনবাংলা’র প্রাণকণ্যা ছিলেন বলে জানান। উল্লেখ্য, কবির জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৯৪২-এর ২৭ জুলাই। লেখাপড়া, অধ্যাপনার পেশাজীবন বৃটেন ও অ্যামেরিকায়। ২০০৬ থেকে অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন বাংলাদেশে। এজন্যে নিজেকে তিনি ‘তিনবাংলা’র প্রামাণ্য প্রতিনিধি বলতেন। বাংলাদেশ-ভারত-প্রবাসবাংলা’র সেতুবন্ধ সংগঠন ‘তিনবাংলা’ করতেন। প্রশিক্ষণ-গবেষণা-অনুবাদ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শুদ্ধতা ও আন্তর্জাতিকতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন। তিনবাংলা'র গ্লোবাল সভাপতি হিসেবে নানান সহযোগিতা পেয়েছি। কবি সালেম সুলেরী’র মতে তিনি ‘আধুনিকা’ ছিলেন। তবে পরিপাটি শাড়িতে বাঙালিত্ব বহাল রাখতেন। ওনার পরামর্শেই তিনবাংলা দেশে-বিদেশে সাহিত্য-সাংবাদিকতার কর্মশালা করেছে।
ফরিদা মজিদের স্মৃতিতর্পণ করেছেন খ্যাতিমান সংগঠক নার্গিস আহমেদ। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সোসাইটির প্রথম নির্বাচিত নারী সভাপতি। শোক প্রকাশের পাশাপাশি লিখিতভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন। বলেছেন, ২০১৭-তে ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁয় দীর্ঘদিন পর দেখা। ‘তিনবাংলা’ সংগঠনের সাংগঠনিক সম্মেলন ছিলো। কবি জাহিদুল হক ও ওনার প্রস্তাবে আমি অ্যামেরিকা’র সভাপতি হই। তিনবাংলা’র বিষয়টি সর্বসম্মতিক্রমে হলেও ওনার আগ্রহ ছিলো সর্বাধিক। প্রবাসীদের প্রতি বিশেষ টান শেষদিন পর্যন্ত বহাল ছিলো।
বৃটেনের প্রবীণ লেখিকা সালেহা চৌধরী বলেন, ধাক্কা খেলাম। আমরা প্রায় সমবয়সী, তরুণবেলার বন্ধু। ফরিদা মজিদ যেন আমাদেরও অমর্ত্যলোকে ডাকছে। 'পরিচয়' সম্পাদক নাজমুল আহসান বলেন, আড্ডাগুলো ভুলিনি। হাডসন রিভার ড্রাইভে বাসা ছিলো। বাঙালি সংস্কৃতিসেবীদের জন্যে হৃদয় ও বাসা- উন্মুক্ত রাখতেন। কবি মুহম্মদ আলী বাবুলের মতে সে- সে এক সময় ছিলো। মূলধারার সাহিত্যাঙ্গনে বাংলা’র মশাল জ্বালিয়েছেন।
সিনিয়র সাংবাদিক তাসের মাহমুদের স্মৃতিচারণ দীর্ঘ। বলেছেন, পরিচয়- আশির দশকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক সেমিনারে’। ফরিদা মজিদ ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি অনন্যসাধারণ নারী। ওনার উদ্যোগ, সম্পৃক্ততায় ঘাতক-দালাল নির্মুল কমিটি হয় নিউইয়র্কে। ওনার মতো দক্ষ সংগঠক কমিউনিটিতে হাতে গোনা। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন বলেন, উনিতো নিকটাত্মীয়। পারিবারিকভাবে আমার 'ননাস', জ্যোৎস্না ফুপুর মেয়ে। ওনাদের পরিবারটি ঐতিহ্যবাহী ও খ্যাতিমানে ভরা। প্রখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা আপন নানা। শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার, মোস্তফা আজিজ মামা। কবি ফরিদা মজিদের মৃৃত্যু দেশ-পরিবার সমাজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করলো।
কবি শামস-আল মমীন আহ্বান করেছেন 'ফরিদা মজিদ'কে পড়তে। একমাত্র কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। শিরোনাম ‘গাঁদা ফুলের প্রয়াণ ও যারা বেঁচে থাকবে’। সংগঠক আবু খালিকুজ্জামান বলেন, আমরা একই ধারার মানুষ। জন্ম পশ্চিমবাংলায়, ঢাকায় কৈশোর-তারুণ্য। আর শেষে প্রবাসবাংলায়। অর্থাৎ তিনবাংলা’র জীবন। উনি-আমি তিনবাংলা’র ট্রেনের যাত্রী। সাপ্তাহিক মাতৃভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার বলেন, আমি মহা-মর্মাহত। উনি ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বজনীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আমার থলিতে ওনার প্রাণবন্ত জীবনের শতস্মৃতি জমা আছে।
বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সম্পাদক ফখরুল আলমও শোকার্ত। বলেন কমিউনিটিকে গড়তে উনি অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। প্রবীণ সংগঠক হাসান আলী বলেন, সম্পর্ক ১৯৯২ থেকে। মদিনা মসজিদের নিকট মবশ্বির চৌধুরীর রেস্টুরেন্ট। একসঙ্গে অনেক সভা ও মতবিনিময় করেছি। বাংলাদেশে চলে গেলে ফেসবুকে যোগাযোগ রাখতেন।
সংস্কৃতিসেবী ফেরদৌস খান বলেন, নবপ্রজন্মের জন্যে উনি দৃষ্টান্ত। সংগঠক মনিকা রায় চৌধুরীর মতে, ওনাদের পথেই হাঁটছি। লেখক-সংগঠক এবিএম সালেহউদ্দীন বলেন, স্মৃতিভান্ডার বিশাল। কারণ নিউইয়র্কে ম্যানহাটনে হাডসন রিভারসাইডে প্রতিবেশী ছিলাম। লস এঞ্জেলেস থেকে স্মৃতিচারণ করেন সিকদার গিয়াসউদ্দিন। বলেন উনি লেখক-অনুবাদক-শিক্ষক ছিলেন। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন।
প্রবাস লেখক আদনান সৈয়দ ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্ট দেন। ফরিদা মজিদের নিউইয়র্কের শেষ দিনগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। প্রয়াত কবির হেঁসেলের খবরও দিয়েছেন প্রাণাবেগ থেকে। শিক্ষাব্রতী ফরিদা শিরীন খান প্রকাশ করেছেন বিষ্ময়। বলেছেন, এতো কম বয়েসে সেই কবে এতোকিছু করেছেন। বাঙালির নারীত্বকে অনেক উচ্চতায় নিয়েছিলেন।
বহুমাত্রিক লেখক কাজি জহিরুল ইসলাম শোকবাণী দিয়েছেন। বলেন, বৃটেন-অ্যাামেরিকার মূল ধারার কবিদের বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশের আর কোন কবি-লেখক এতো নৈকট্য পাননি। পাবলো নেরুদা, টেড হিউজ, অ্যালেন গিনসবার্গ... ভাবাই যায় না। অস্ট্রেলিয়াবাসী কথাসাহিত্যিক দীলতাজ রহমানও মুখ খুলেছেন। বলেছেন, ২০১৯-এ ঢাকায় প্রথম ও শেষ দেখা। অন্যরকমভাবে খোঁপাটি বেঁধেছিলেন যা ভুলতে পারি না। আমার গাড়িতে অনুবাদ বিষয়ে অনুপ্রেরণামূলক কথা হয়।
সংস্কৃতিসেবী রানু ফেরদৌস বলেন, ছিলেন ভালোবাসায়। ওনার সান্নিধ্য আমাদের মুগ্ধতা দিয়ে গেছে। লেখক সোনিয়া কাদের বলেন, আব্বা ওনাকে জানতেন শুনেছি। উনি প্রবাস-মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আব্বার ওপরে লেখা বই-এ ওনার প্রসঙ্গটি এনেছি। যতোদিন বাঁচি ওনাকে শ্রদ্ধা জানাবো। পরপারে উনি যেন স্বর্গীয় প্রশান্তি পান।
প্রবাসের অসংখ্য লেখক-সংস্কৃতিসেবী শোক প্রকাশ করেছেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা-লেখক ড. নূরন্নবী, শিশুসাহিত্যিক শরীফ মাহবুবুল আলম, প্রাবন্ধিক আবেদীন কাদের, সংগঠক আজিজুল হক মুন্না, কবি তমিজ উদ্দিন লোদী, কবি-অনুবাদক রওশন হাসান, লেখক-সাংবাদিক মনিজা রহমান, বৃটেনের কবি শামীম আজাদ, মুজিব ইরম, সাংবাদিক কাজী জাওয়াদ, রিমন ইসলাম প্রমুখ।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন