লসএঞ্জেলেস কাউন্টিতে শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ দাবানলে ছাই হয়ে যাওয়া ১২ হাজারের অধিক বাড়ি-ব্যবসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রবাসীদের সহায়-সম্পদও রয়েছে। মঙ্গলবার শুরু ভয়ংকর এই দুর্যোগের লেলিহান শিখা শনিবার অপরাহ্নে আরো নতুন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে ১৬ জন। তবে এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলে দমকল কর্মীরা আশংকা করছেন। লসএঞ্জেলেস কাউন্টির মেডিক্যাল এক্সামিনার জানান, প্যাসাডোনা সংলগ্ন ইটন সিটিতে ১১ জন এবং ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে লসএঞ্জেলেসের পশ্চিমে প্যালিসেডসে। ক্ষতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। প্রাথমিকভাবে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো ধারণা করেছে (শনিবার সন্ধ্যায়) যে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটিকে ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর ১০টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এবং এহেন পরিস্থিতিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর প্রভাব হিসেবে দেখছেন পরিবেশবিদরা।
স্থানীয় সাংবাদিক তপন দেবনাথ জানান, প্যালাসেডস, আলটাডিনাসহ আশেপাশের আগুন নেভাতে মেক্সিকো এবং কানাডা থেকেও দমকল বাহিনী এসেছে। উড়োজাহাজে পানি ছিটানো হচ্ছে কিন্তু ততটা সাফল্য আসছে না। কারণ বাতাসের গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এমনি একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিপতিত আলটাডিনার গৃহহারাগণের অন্যতম বাংলাদেশি মাহবুব মোরশেদ। যুক্তরাষ্ট্র (পশ্চিমাঞ্চলীয়) আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা: রবি আলমের আত্মীয় মাহবুব মোরশেদ ৪ বছর আগে স্বপ্নের দুটি বাড়ি ক্রয় করেছিলেন ১.৮ মিলিয়ন (প্রায় ২৪ কোটি টাকা) ডলারে। করোনা থেকে জেগে উঠার পরিক্রমায় মাহবুবও ৩ কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে কঠোর শ্রমে নিয়োজিত হয়েছিলেন। নিজের মত করে সাজিয়েছিলেন দুটি বাড়ি। শুক্রবার এ সংবাদদাতাকে তিনি জানালেন যে, সবকিছু ছাই ভস্মে পরিণত হয়েছে। দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। আগুনের তান্ডব কিছুটা কমায় গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। আগুনে ছাই হওয়া দৃশ্য দেখতে হয় ৫০/৬০ ফুটি দূর রাস্তায় গাড়িতে বসে। কারণ, সে এলাকায় তখোন কার্ফ্যু জারি করা হয়েছে লুটতরাজ বন্ধে। মোরশেদ জানালেন যে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কিছু দূরে ছোট ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করছেন।
লসএঞ্জেলেস এলাকার সমাজ-সংগঠক মোমিনুল হক বাচ্চু এ সংবাদদাতাকে জানান, আগুনে পুরোপুরি ছাই হয়ে না গেলেও মারাত্মকভাবে ক্ষতি হয়েছে আরো অনেক প্রবাসীর বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এরফলে আমরা কেউই স্বস্তিতে নেই। হলিউডের ব্যবসায়ী বিশ্বখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচের ছোট ভাই শংকু আইচ জানালেন, আগুনের ছাই এবং ধোঁয়ায় গোটা এলাকা আচ্ছাদিত হওয়ায় বাইরে বের হতে সাহসী হচ্ছি না। অসহনীয় পরিবেশ বিরাজ করছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের ঘটনা এটা নতুন না হলেও লসএঞ্জেলেস কাউন্টিতে আগে কখনো এমন অবস্থা দেখিনি বা শুনিনি। ঘন, বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্যালিসেডস এলাকা।
দমকল বাহিনীর প্রধান ক্রিস্টিন ক্রাউলি শনিবার জানান, এ সিটিতে ৫৩০০টি স্থাপনাসহ ২৩ হাজার ৬৫৪ একর জমির ওপর বাড়ি ও গাছপালা পুড়েছে। ইটন সিটির পূর্বে প্যাসাডোনায় ৭ সহস্রাধিক স্থাপনাসহ ১৪ সহস্রাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই। বৃক্ষরাজি পুড়ে গোটা এলাকা শশ্মানে পরিণত হয়েছে। লুটেরার উৎপাতে সেখানেও কার্ফ্যু জারি করা হয়েছে। এই সিটি সংলগ্ন গেটি সেন্টারসহ ব্রেন্টউডে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের লেলিহান শিখা। ক্যালাবেস এবং হিডেন হিল এলাকার আগুন শনিবার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। কেনেথ ফায়ারের এই তান্ডবে জড়িত সন্দেহে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের তথ্য দিয়েছেন লসএঞ্জেলেস পুলিশের সহকারী চিফ ডোমিনিক চৈ। সান ফার্নান্দোর আগুণ শুরু হয়ছে শুক্রবার সন্ধ্যায়। এভাবে আরো কটি নতুন স্থানে আগুনের বিস্তার ঘটায় ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের এই অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নাগরিকদেরকে জরুরী সতর্কবার্তা অনুযায়ী অবস্থান অথবা নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার আহবান জানানো হয়েছে। ১ লাখ ৫৩ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার আদেশ রয়েছে। এছাড়া আরও ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮০০ জন ঘরবাড়ি ছাড়ার সতর্কতার মধ্যে রয়েছে। খালি করা সব জায়গায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। দাবানলের দিক পরিবর্তনের কারণে আরও মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, আগুন নেভাতে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।
প্যালেসেইডসের আগুন ব্রিটনউডস ও সানফার্নান্দো ভ্যালির দিকে মোড় নিয়েছে বলে শনিবার রাতে জানা গেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস ফায়ার ডিপার্টমেন্টের ক্যাপ্টেন এরিক স্কট বলেন, প্যালেসেইডসের আগুন পূর্বাঞ্চলের দিকে নতুন করে ছড়াচ্ছে এবং উত্তর-পূর্ব দিকে অব্যাহত রয়েছে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে সব থেকে ধ্বংসাত্মক এই দাবানল আশেপাশের গোটা এলাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। বাড়িঘর ও স্থাপনাগুলো থেকে ধোঁয়া উড়ছে।
প্রতিবেশি সাতটি স্টেট ও কানাডা ক্যালিফোর্নিয়ার এ দুঃসময়ে সহযোগিতা করছে। আকাশ থেকে হেলিকপ্টারে করে পানি ফেলতে এবং আগুন নেভানোর কর্মী, ঘোড়া ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করছে।
ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস বলেছে, সপ্তাহান্তে লস অ্যাঞ্জেলেসের অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে। একটানা বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৩২ কিলোমিটার বেগে বইতে পারে, যা ৩৫ কিলোমিটার থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আসছে মঙ্গলবার শক্তিশালী বাতাসের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া ফায়ার বিভাগ।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট গভর্ণর, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবানল পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন। শনিবার সকালে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে যথাযথ অর্থ সহায়তার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অনলাইনে আবেদনের আহবান জানানো হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে নগদ অর্থ মঞ্জুরি ছাড়াও সুদমুক্ত ঋণের প্রকল্প রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। অর্থাৎ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণ করা হবে না বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, পুড়ে যাওয়া প্রতিটি বাড়িরই ইন্স্যুরেন্স থাকলেও প্রকৃত ক্ষতির সাথে সমন্বয় ঘটবে না জেনেই ফেডারেল সরকার বাড়তি সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। সে আলোকে স্টেট গভর্ণর এবং সিটি কর্তৃপক্ষও ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের পদক্ষেপ নেবে বলে জানা গেছে।
বিডি প্রতিদিন/এএ