শিরোনাম
৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০৩:০৯

হাসিবের ঈদ

নাইম আবদুল্লাহ

হাসিবের ঈদ

সংগৃহীত ছবি

ঈদের দিন সকাল নয়টা। হাসিব এইমাত্র সিডনি এয়ারপোর্টে এসে নেমেছে। ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়ে সে তার বন্ধুকে ভাইবারে কল দিলো। বিপ্লব, আমি হাসিব বলছি। বন্ধু, এইমাত্র আমি ইমিগ্রেশন পার হলাম। তোর না গতরাতে আসার কথা দোস্ত। 

কাল যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কুয়ালালামপুর থেকে প্লেন ডিলে (দেরি) ছিল প্রায় বারো ঘণ্টা। আর আমিও এয়ারপোর্ট থেকে ওয়াই-ফাই কানেকশন পাচ্ছিলাম না। তাই তোকেও জানাতে পারিনি। সরি বন্ধু, আমি মনে হয় তোকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম। 

আরে না, না। তোকেই বরং একটু ঝামেলা পোহাতে হবে। আমি আজ সকাল আটটা থেকে কাজ শুরু করেছি। বাসায় ফিরতে ফিরতে চারটা বাজবে। 

দোস্ত, তুই একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে ঠিকানা ধরে আমার বাসায় চলে যা। তারপর পাশের রুমে নক করলে এক আফগানি বৃদ্ধা দরজা খুলবে। ওকে তোর নাম আর আসার কথা বলে এসেছি। ওর ঘরে মালপত্র রেখে তুই দশ মিনিটের হাটা দূরত্বে ওয়েস্টফিল্ড শপিং মলে চলে যাবি। ওখানে ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া করে মোবাইলে ফ্রি ওয়াই-ফাই কানেক্ট করে রাখবি। আমি কাজ শেষ করে ঠিক সাড়ে তিনটায় তোকে কল দিবো। এখন ছাড়ছি দোস্ত। 

হাসিব এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বিপ্লবের ফ্লাট বাড়ির সামনে নামলো। তারপর আফগানি বৃদ্ধার দরজা নক করে ওর ঘরে মালপত্র রেখে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। 

তখন সকাল সাড়ে দশটার মতো বাজে। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। ওয়েস্টফিল্ড শপিং মল কোনদিকে কাউকে জিজ্ঞেস করার জন্য সে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ সে বেশ কিছুটা দূরে ঈদের পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি পড়া ছোট বাচ্চা ও তাদের মা বাবারা সামনের পার্কের একটি জায়গায় জড়ো হতে দেখলো। 

হাসিবের কাছে ওদের বাংলাদেশি বলেই মনে হল। আবার ইন্ডিয়ান কিংবা পাকিস্তানিও হতে পারে। সে কিছুটা উৎসুক হয়ে গেটের ভিতর দিয়ে পার্কে ঢুকলো। 

ঈদের নতুন পোশাকে ছেলে-মেয়েরা ছুটাছুটি করছে। কিছুক্ষণ পরে ছোট্ট একটি ছেলে তার সামনে এসে বলল, আঙ্কেল তুমি একা এসেছো? আন্টি বাবুদের সঙ্গে আনোনি? ওদিকে তো সবাই অপেক্ষা করছে। এই বলে বাচ্চা ছেলেটি তার হাত ধরে এক রকম জোর করেই ভিড়ের ভিতর নিয়ে গেলো।

হাসিব প্রবাসে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে কিছুটা বিব্রত বোধ করলেও নিজেকে সামলে নিলো। এক ভদ্রলোক তার দিকে হাত বাড়িয়ে তার নাম বলল। অন্যরাও দেখাদেখি এগিয়ে এলো। সেও তার নাম পরিচয় ও এখানে আসার কারণ জানালো।

সবাই তাকে বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিলো এবং তার বন্ধু না ফেরা পর্যন্ত তাদের সাথে থাকার ও লাঞ্চ করার অনুরোধ জানালো। 

হাসিব কথায় কথায় জানতে পারলো, প্রবাসে এই আট দশটি পরিবার সবাই একে অপরের বন্ধু। কেউ স্কুল জীবনের বন্ধু, কেউ দেশে একসাথে চাকুরী করতো, কেউবা এখানে পাশাপাশি ফ্লাটে থাকে আবার কেউবা এখানে চাকুরী সূত্রে পরিচিত। আজ ঈদের দিনে সবাই সবার বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। তাই মহিলারা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি করে ডিস রান্না করে নিয়ে এসে সবাই এই পার্কে ঈদ করবে। তাতে সবার সাথে সবার দেখাও হবে আবার বাচ্চারাও একসাথে খেলার সুযোগ পাবে। 

মহিলাদের মধ্যে থেকে একজন বয়স্ক মহিলা হাসিবের দিকে এগিয়ে এসে ওকে নিয়ে একপাশে বসালো।

মায়ের আদর মাখা কণ্ঠে বলল, বাবা তুমি অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছ। আমি তোমার খাবার রেডি করি। এই বলে সে হাসিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্লেটে করে ঈদের পোলাও, রোস্ট রেজালা ও মিষ্টি নিয়ে এলো।

সে খাওয়া শুরু করলে বৃদ্ধা পাশে বসে তার বাড়িতে মা বাবার খোঁজ খবর নিলো। হাসিবের খেতে খেতে খুব কান্না পেলো। সে অতি কষ্টে তার কান্না দমন করলেও চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। বৃদ্ধা পরম মমতায় শাড়ির আঁচল দিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিলো। 

বিকেল সাড়ে তিনটা বাজার কিছু আগে সে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শপিং মলে যেতে চাইলে সবাই কারণ জেনে একজন তার বন্ধু বিপ্লবের মোবাইলে মেসেজ দিয়ে রাখল। বিপ্লব কাজ শেষে জানালো সে পার্কে এসেই তাকে বাসায় নিয়ে যাবে।

বিপ্লব হাসিবকে নিতে এসেছে। হাসিব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বৃদ্ধার কাছে গেলে সে কেঁদে ফেললো। বৃদ্ধার ছেলে কাছে এসে বৃদ্ধাকে সামলাতে সামলাতে বলল, আপনার বয়সী আমার ছোট ভাই গত বছর দেশে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তারপর থেকেই মা তার শোঁকে কেমন জানি হয়ে গেছে। সিডনিতে আসার পর থেকে সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। ভালোই হল ভাই, মার আপনাকে দেখলে ভালো লাগবে। 

বৃদ্ধার ছেলে হাসিবকে জড়িয়ে ধরলো। বৃদ্ধা তাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। হাসিব চলে যাচ্ছে আর বৃদ্ধা তার ফিরতি পথের দিকে তাকিয়ে আছে। 

লেখক-সিডনি প্রবাসী ও সাংবাদিক

বিডি-প্রতিদিন/ ই-জাহান

সর্বশেষ খবর