২৫ নভেম্বর, ২০১৯ ১৪:২৫
গল্প

চক্রান্ত

পলাশ মজুমদার

চক্রান্ত

পলাশ মজুমদার

এনআরসির ভয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটে অনুপ্রবেশকারী এক যুবকের আত্মহত্যা। হঠাৎ একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণ খুলতে চোখে পড়ল ছোট সংবাদটি। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার একটি পত্রিকায় ঢুঁ মারি। বিস্তারিত পড়ে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 

এক.
অর্ঘ্য পাঠক। ২৭ বছর বয়সি ছেলেটির নাম অর্ঘ্য পাঠক। যাবতীয় বৃত্তান্ত। রানাঘাট স্টেশন। সব মিলে গেছে। ফেসবুকে অর্ঘ্যের প্রোফাইলে ঢুকতেই চোখে পড়ে তার বন্ধুদের শোক-প্রকাশের স্ট্যাটাস। বিভিন্ন রকম প্রতিবাদ। তাকে যারা খুব কাছ থেকে জানত, তারা স্ট্যাটাস দিয়ে ভরে ফেলেছে। অর্ঘ্যর আত্মহত্যার জন্য অনেকে দায়ী করছে তার স্ত্রী শ্রেয়াকে। কেউ কেউ শ্রেয়ার পরিবারকে। বেশিরভাগের অভিমত এক রকম। এনআরসি এখানে কোনো ইস্যু নয়। সব সাজানো নাটক। অর্ঘ্যের বিপক্ষেও লিখছে কেউ কেউ। স্পষ্ট দুটি ভাগ দৃশ্যমান।

সঙ্গে সঙ্গে শ্রেয়ার প্রোফাইলে ঢুকি। দেখি বড় একটা স্ট্যাটাস। সে অর্ঘ্যকে ট্যাগ করেছে। অর্ঘ্যর কিছু বন্ধুকেও। ক্লিয়ার করেছে নিজের অবস্থান। বিভিন্ন উপায়ে বলতে চাচ্ছে যে, তার বাঁচার সাধ নেই। অর্ঘ্য যে পৃথিবীতে নেই, সেখানে সে কীভাবে থাকবে। অর্ঘ্যকে প্রাণের চেয়েও সে বেশি ভালোবাসে। অর্ঘ্য কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল? কেন একবারও তার কথা ভাবল না? ভাবল না তাদের সন্তানের কথা। এরকম অনেক কিছু।

অর্ঘ্য আমার সঙ্গে সব বিষয়ে শেয়ার করত। হয়তো আমার মধ্যে সে এক ধরনের নির্ভরতা খুঁজে পেত বলে। শ্রেয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপড়েনের ব্যাপারটাও বলেছিল। সমস্যাটি যে ঘোঁট পাকাচ্ছিল, সে আমাকে জানাতো। বেশিরভাগ সময় ওর সঙ্গে কথা হতো ফেসবুক মেসেঞ্জারে। আমি তাকে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিতাম। বলতাম, শ্রেয়ার কাছ থেকে সরে আসতে। ছিন্ন করতে সম্পর্ক। সে বলত তার অক্ষমতার কথা। বুঝতে পারতাম, সে আটকা পড়েছে এক জটিল জালে। ওই চক্র ভেদ করার সামর্থ্য অর্ঘ্যর ছিল না।
 
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না কী এমন ব্যাপার ঘটেছিল যে অর্ঘ্য আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলো। আমি যত দূর জানি, সে আত্মহত্যা করার মতো ছেলে নয়। জীবনকে সে ভীষণ ভালোবাসত। পৃথিবীর প্রতি প্রেম ছিল অফুরন্ত।

রবীন্দ্রনাথের গানে-কবিতায় বিভোর থাকত সব সময়। জীবনমুখী রবীন্দ্রনাথই ছিল তার বেঁচে থাকার প্রেরণা। জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ/ধন্য হলো, ধন্য হলো মানব জীবন- এটি যার প্রিয় গান সে আত্মহত্যা করতে পারে না। এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। আমি জানি, মা-বাবার প্রতি ছিল অর্ঘ্যর সীমাহীন টান। স্বপ্ন দেখত, একদিন মা-বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। পড়াশোনা শেষে একটা ভালো চাকরিও পেয়ে গেল সে। 

আমাকে মাঝে মাঝে অর্ঘ্য বলত, দাদা, কখনো কুষ্টিয়া গেলে আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। আমার মা-বাবাকে তোমার কথা বলেছি। তাঁরা অনেক খুশি হবে। আমি তাকে আশ্বস্ত করি, যাব। অবশ্যই যাব। আরো বলি, কুষ্টিয়া বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। আমার অতি প্রিয় একটি স্থান। লালন-রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়া যে বাঙালির তীর্থস্থান। আমি অনেকবার গিয়েছি কুষ্টিয়ায়। শিলাইদহে রাত কাটিয়েছি। চাঁদনি রাতে হেঁটেছি পদ্মার পারে। অবগাহন করেছি জোছনার সরোবরে। ছেঁউড়িয়ায় বাউলদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়েছি অনেকবার। দেখেছি সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা। কুমারখালীতে কাঙাল হরিনাথের বাড়িতে গিয়েছি। আমার এসব কথা শুনে সে ভীষণ খুশি হতো। বলত, তুমি দেখছি আমার চেয়ে কুষ্টিয়াকে বেশি জানো!

একা একা বসে ভাবছি, অর্ঘ্য কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছে? নাকি তাকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আমার মাথায় কিছু যেন ঢুকছে না। আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনো রহস্য আছে। তার হাসিমাখা মুখখানি মনে করতেই ফিরে গেলাম এক বছর আগের সময়টিতে।

দুুুই.
অর্ঘ্য পাঠকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় গত বছর। বনগাঁ স্টেশনে। পূঁজার সময়। সে বনগাঁয় এসেছিল মামার বাড়িতে। ফিরছিল রানাঘাটে। নবমীর বিকেলে বেনাপোল বর্ডার পার হই আমরা- আমি আর প্রসেনজিৎ। বনগাঁ লোকালে যাব রানাঘাট হয়ে কৃষ্ণনগরে। প্রসেনজিৎ আমার আগরতলার বন্ধু। একবার আখাউড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় এসেছিল প্রসেনজিৎ। একদিন ঢাকায় থাকে। তারপর দিন আমাকে নিয়ে ফরিদপুর যশোর হয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে সে। উদ্দেশ্য মায়াপুর-নবদ্বীপ ঘুরে সুন্দরবনে কয়েকটি দিন কাটানো।

ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনের বেঞ্চে বসে আমরা দু'জন আলাপ করছিলাম চা খেতে খেতে। এক ২৫-২৬ বছর বয়সি যুবক আমাদের পাশে বসে একা একা বাদাম খাচ্ছিল। কিছুক্ষণ আমাদের কথোপকথন শুনে সে হঠাৎ জানতে চাইল, দাদা, আপনারা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?

আমাদের সম্মতিসূচকভাব লক্ষ্য করে সে উৎসাহী হলো কথা বলতে। পরিচয় দেয়ার পর নিজের নাম অর্ঘ্য বলে জানায় সে। তার আগ্রহ যেন উপচেপড়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ধীরে ধীরে জমে ওঠে আড্ডা। এর মধ্যে রানাঘাটগামী ট্রেন চলে আসে। একই কামরায় আমরা পাশাপাশি বসি। চলতে থাকে কথাবার্তা। মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান হয়। ফেসবুকেও বন্ধু হয়ে যাই তৎক্ষণাৎ।

নিজের গ্রামের কথা, মা-বাবার কথা, ফেলে আসা জীবনের কথা বলতে শুরু করে অর্ঘ্য। আমি বরাবরই মানুষের ব্যাপারে কৌতূহলী। প্রসেনজিৎ আমার চেয়ে এক কাঠি সরেস। কথা বললেও অর্ঘ্যকে খুব বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল যেন তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে আপন ভেবে অনেক কথাই বলেছিল সে। সময়ের অভাবে আর বেশি কথা বলা সম্ভব হয়নি তখন। রানাঘাটে নেমে আমরা তার থেকে বিদায় নিয়ে কৃষ্ণনগরের ট্রেনে উঠে পড়ি। ওই দিনের মতো আড্ডার সমাপ্তি ঘটে। তবে সম্পর্ক শেষ হয় না।

শ্রীচৈতন্যভুবন নবদ্বীপ মায়াপুর ঘুরে কলকাতায় ফেরার সময় রানাঘাটে নামতে হয় আমাদের। অর্ঘ্যর উপর্যুপরি অনুরোধ আমরা ফেলতে পারিনি। ফোনে ফেসবুকে অনেক বার অনুরোধ করেছিল সে। সেদিনটি আমাদের চমৎকার কেটেছিল রানাঘাটে। বাসায় অর্ঘ্য একা ছিল। তার স্ত্রী শ্রেয়া তখন বাবার বাড়িতে। অফিসের পাশে ওর বাসা। অন্তরঙ্গ আড্ডায় আমরা আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। ওই সময় সে তার সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলে। আমরা তন্ময় হয়ে শুনি। কখনো ফেলি দীর্ঘশ্বাস।

তিন.
আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন এপারে চলে আসি। উঠি মামার বাড়িতে। ছোট মামাই আমাকে নিয়ে আসেন। অনেকটা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আমার মামারা অনেক আগে থেকে বনগাঁয় স্থায়ী। 
আমার মা-বাবা ও ভাই-বোনেরা বাংলাদেশেই থাকে। কুমারখালীতে আমাদের বাড়ি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা-বাবা আমাকে এখানে পাঠিয়ে দেয়। প্রথমে দাদার আসার কথা ছিল। দাদা অস্বীকৃতি জানাতে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রথম প্রথম আমার বেশ কষ্ট হতো। একা একা পড়ে থাকতাম। বাড়ির জন্য মন কাঁদতো সারাক্ষণ। গ্রামের বন্ধুদের খুব মিস করতাম। আমার কথা শুনে সবাই হাসত বলে মুখ খুলতে চাইতাম না। মিশতাম না কারো সঙ্গে। নিজেকে খুব ছোট মনে হতো তখন।

পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বলে মামার বাড়ির সবাই আমাকে ভীষণ আদর করত। আমার দিদিমা তো আমাকে চোখের আড়াল হতে দিত না। একে একে ক্লাস টপকাতে লাগলাম। শিখে ফেললাম ঘটি ভাষা। মিশে যেতে লাগলাম এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে। ভালোভাবে। খেয়াল করতাম মেয়েদের উৎসূক চাহনি। আসতে লাগল প্রেমের প্রস্তাব। কারো দিকে ফিরে তাকাইনি। প্রতিজ্ঞা ছিল যেভাবে হোক আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এভাবে পৌঁছে গেলাম কলকাতা ভার্সিটিতে। ইংরেজিতে অনার্স শেষে ভর্তি হলাম মাস্টার্সে।

আমি ও শ্রেয়া মাস্টার্সে একসঙ্গে পড়তাম। তার বেপরোয়া আচরণে আমি প্রথমে ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। শ্রেয়া ছিল অবস্থাপন্ন ঘরের এক আদুরে মেয়ে। তার বাবা আবার শাসকদলের এক জাঁদরেল নেতা। যা চায় তা পেতে অভ্যস্ত ছিল সে। আমার মতো সামান্য এক ছেলে তার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না বা তাকে প্রত্যাখ্যান করছে তা সে মেনে নিতে পারছিল না। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে আমি অহংকারী নই। আমি এক ভাগ্যবিড়ম্বিত এবং এদেশে অনাহুত এক জীবনসংগ্রামী। আমাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে নিজের ভাগ্য গড়ার জন্য। এমন এক যুবকের জন্য ভালোবাসা সোনার হরিণ। আমি জানতাম, নারী-হৃদয়ের কোমল ভালোবাসা আমার জন্য নয়। আমাকে অনেকদূর যেতে হবে। আর নারী সে গন্তব্যের পথে বাধা হতে পারে। সব সময় চলতাম খুব সাবধানে। হিসাব কষে কষে।

আমার দিক থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া না পেয়ে শ্রেয়া শরণাপন্ন হয় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাহুল ঘোষের। শ্রেয়া ভালো করে জানত যে, রাহুল আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু। এরপর আমাকে বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে রাহুল। আমার নিষ্ক্রিয়ভাব দেখে শ্রেয়ার আগ্রহ যেন আরো বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে আমার প্রতি হুমকি আসতে থাকে। রাহুলকে শ্রেয়া বলে যে, অর্ঘ্য যদি রাজি না হয় আমি আত্মহত্যা করে ওকে ফাঁসিয়ে যাব। এমন কথা শুনে আমি ভীষণ ঘাবড়ে যাই। কূল-কিনারা পাই না। রাহুল আমাকে অব্যাহত চাপের মধ্যে রাখে। বলে, শ্রেয়া যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে তবে তোর জীবন শেষ। তখন কোথায় যাবে তোর মা-বাবা। আশা-ভরসা। স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ।

এ রকম বিভিন্নমুখী চাপে আমি অবশেষে সাড়া দিই। চলতে থাকে আমাদের সম্পর্ক। আগে কখনো কোনো মেয়েকে ভালোবাসিনি। তবু টের পেতাম যে, শ্রেয়া সত্যি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে। সেখানে কোনো ছলচাতুরি নেই। কিছুদিন যাওয়ার পর খেয়াল করি যে, মাত্রাতিরিক্ত আবেগের বশে শ্রেয়া শারীরিক মিলনে বেশি উৎসাহী। কৌশলে আমাকে ফাঁদে ফেলে। বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যায় দোলের সময়। রাতে একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হই। আমি তো আর নপুংসক নই। কয়েক মাস পর জানতে পারি যে, শ্রেয়া গর্ভবতী। বিষয়টা জানার পর ওর মা-বাবা আমাকে দূরে সরে যেতে বলে। ওর বিয়ে ঠিক করে এক ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে। বাচ্চাটা গর্ভপাত করাতে চায়। এদিকে শ্রেয়া আমার সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। পালিয়ে যেতে বলে তাকে নিয়ে।

অনন্যোপায় হয়ে আমরা পালিয়ে চলে যাই শিলিগুড়িতে। শালুগাড়ায় ওর এক বান্ধবীর বাসায় উঠি। শ্রেয়ার বাবা লোক লাগিয়ে আমাদের ঠিক ধরে ফেলে। জোর করে নিয়ে যায় শ্রেয়াকে। আমাকে অনুপ্রবেশের মামলা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় জেলে। শ্রেয়ার তীব্র প্রতিবাদে ধীরে ধীরে আমার প্রতি তাদের রাগ মিইয়ে আসে। তুলে নেয় মামলা। শ্রেয়ার জেদের কাছে হেরে গিয়ে আমাদের বিয়ে দেয়। তবে বিয়েটা যে তারা মন থেকে দেয়নি, তা কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারি। সন্তান হওয়ার পর শ্রেয়াকে বিভিন্নভাবে ভুল বোঝায়। ও চলে যায় আমাকে ছেড়ে।

মাস খানেক ধরে শ্রেয়া বাপের বাড়িতে আছে। আর আমি এই বাসায় একা। তবে শ্রেয়া মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে ফিরতে চায়। ফোনে ফেসবুকে কথা হয় আমাদের। আমি চলে আসতে বলি। কিন্তু পারছে না। আসতে দেবে না ওর মা-বাবা। এদিকে আমাকেও তারা বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে যেন বাংলাদেশে চলে যাই। আমি এক রকম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছি। মা-বাবাকে সব কথা জানাতে পারছি না, পাছে তারা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। আমার বাবা এমনিতে হার্টের রোগী।

যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকবার ভেবেছি, সব ছেড়ে দেশে চলে যাই। নিজের বাড়িতে না খেয়ে থাকলেও সুখ। যেভাবে হোক চলে যাবে। চিন্তা করা যত সহজ, সিদ্ধান্ত নেয়া তার চেয়ে অনেক কঠিন। এভাবে পড়ে আছি দিনের পর দিন।

চার.
রাতের বাসে সোজা কুষ্টিয়ায় চলে যাই। সেখান থেকে কুমারখালীতে। ওদের বাড়িটি কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়ির কাছে। এখানে আরো পাঁচ বছর আগে আমার পদচিহ্ন পড়েছিল। চারপাশের সবকিছু আমার চেনা। অর্ঘ্যদের বাড়িতে গিয়ে দেখি তার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে তার মায়ের আহাজারি আর বিলাপে। একটি কথাই বলছে তার মা- কেন ছেলেকে ওপারে পাঠাতে গেলাম। আমার ছেলে তো যেতে চায়নি। আমি অর্ঘ্যর মাকে এই বলে সান্ত্বনা দিই— মাসি, আমি যাচ্ছি রানাঘাটে। দেখি কী করা যায়। আপনারা শান্ত হোন। আমার কথায় তারা কিছুটা বিশ্বাস খুঁজে পায়।

পাঁচ.
বেশিক্ষণ থাকি না অর্ঘ্যর বাড়িতে। দর্শনায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগেনি। বর্ডার পার হয়ে গেদে লোকালে সোজা রানাঘাট। মানুষ উপচে পড়ছে বাড়িটার চারপাশে। ঘিরে রেখেছে পুলিশ। রানাঘাট শহরের টক অব দ্য টাউন- অর্ঘ্য পাঠককে কি হত্যা করা হয়েছে নাকি সে আত্মহত্যা করেছে! গুজবে কান পাতা দায়।

পুলিশের কাছে আমার পরিচয় দিই। কথা শুনে আমার দিকে কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় সবাই। তাদের চোখে আমি যেন এক অদ্ভুত প্রাণি। কারো ইঙ্গিতে পুলিশ আমার প্রতি সদয় হয়। অনুসরণ করতে বলে। পুলিশের সঙ্গে ঘরে ঢুকতেই দেখি মেঝেতে সাদা চাদরে ঢাকা অর্ঘ্যর লাশ। সিলিং ফ্যানে এখনো ঝুঁলছে অর্ঘ্যর ফাঁসির দড়ি। টেবিলের ওপর পেয়ে যাই ওর সুইসাইড নোট। পুলিশই আমাকে দেখায়। পড়তে বলে।

‘এভাবে জীবন দিয়ে ভালোবাসার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, আমি কি তা কখনো ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলাম। বাঙাল হওয়ার অপরাধে শ্রেয়ার বাবা আমাকে অপমান করল। অপমান করেও যদি ক্ষান্ত হতো, তবু মেনে নেয়া যেত। জেলে পুরে দিল অনুপ্রবেশের মামলা দিয়ে। স্ত্রী-সন্তানকে কেড়ে নেয়া হলো আমার থেকে। অভিশপ্ত এ জীবন নিয়ে আমি আর কী করব? হায় ভগবান! কেন ভালোবাসতে গেলাম! আমার মতো কোনো বাঙাল অভাগা যেন কোনো ঘটি মেয়েকে কখনো ভালো না বাসে। আর আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’

সুইসাইড নোটটা পড়ে বুঝতে পারি, এটা অর্ঘ্যর লেখা নয়। তার হাতের লেখা আমি চিনি। মুক্তোর মতো উজ্জ্বল। টেবিলের এক পাশে ওর একটি ডায়েরি পড়ে ছিল। সেটা খুলে পড়ি। অর্ঘ্যর হাতের লেখার মতো বানানোর বেশ চেষ্টা করা হয়েছে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করছি। তখনই পুলিশ আমাকে জেরা করা শুরু করে, আপনি ওর কে হন?
আমি অর্ঘ্যর বন্ধু।
কেমন বন্ধু? 
বন্ধু তো বন্ধুই। এটা কেমন কথা।
কোথা থেকে এসেছেন আপনি? 
বাংলাদেশ থেকে।
কেন এসেছেন?
বন্ধুর দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতে। আপনাদের সমস্যা কী?
আমাদের কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হবে আপনার। বুঝতে পারবেন একটু পরে। আপনাকে এখন থানায় যেতে হবে আমাদের সঙ্গে। 
কেন?
প্রয়োজন আছে। আর শুনে রাখুন, অর্ঘ্য পাঠকের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা আছে। মামলা থেকে বাঁচতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে সে। এখন একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। উঠে পড়ে লেগেছে তার বিরোধীপক্ষের লোক। আপনি আদালতে সাক্ষ্য দেবেন। বলবেন যে, মানসিক সমস্যার কারণে সে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে। আপনি তার এ সমস্যার কথা আগে থেকে জানতেন।
অসম্ভব। আমি বলতে পারব না এমন কথা। আরে মশাই, অনুপ্রবেশ হবে কেন? দীর্ঘদিন ধরে অর্ঘ্য ভারতে আছে। সে এখানকার ভোটার। তার আধার কার্ড আছে।
রাখেন আপনার আধার কার্ড। সামনে এনআরসি আসছে। সে জেনে গেছে যে, এনআরসিতে তার নাম নেই। তাই আগেই সে বেছে নিয়েছে আত্মঘাতী পথ।
আমি বিশ্বাস করি না। আর এই সুইসাইড নোট তার লেখা নয়।
শুনুন মশাই, বেশি চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। আপনার বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে। বের করুন আপনার পাসপোর্ট।
ব্যাগের মধ্যে পাসপোর্ট খুঁজি। তন্নতন্ন করে কাগজপত্র ও কাপড়চোপড় ঘাঁটি। কোথাও পাই না। চারদিকে শূন্যতা অনুভব করি। ঘামতে থাকে আমার শরীর।
ভীষণ ঘাবড়ে যাই আমি। সবাই যেন আমার অসহায়ত্ব উপভোগ করছে। উপায়ন্তর না দেখে ভয়ে ভয়ে বলি, আপনারা কী করতে চান?
আপনাকে অনুরোধ করছি, মানে মানে কেটে পড়ুন। নয় ফেঁসে যাবেন।
এমন সময় শ্রেয়ার বাবা আশুতোষ চৌধুরীকে আমার চোখে পড়ে। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসেন- আপনারা, মানে বাঙালরা আমাদের কি একটু শান্তিতে থাকতে দেবেন না? আপনাদের জন্য আজ আমাদের এই দুর্দশা। পুরো দেশটাকে শেষ করে দিল খচ্চর রিফিউজিগুলো। যত্তসব জঞ্জাল। একটা একটা করে তাড়ানো উচিত। সরকার যে কেন কিছু করে না, বুঝতে পারি না।
আরো কী কী যেন বলেন। আশুতোষ বাবুর কথা আমি ঠিক শুনতে পাই না। আমার মাথা যেন দুলছে। কিছু দেখতেও পারছি না।
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালের বেডে। সামনে পুলিশ। আমার চোখের ওপর হাতকড়া ঝুলছে- আপনাকে অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেফতার করা হলো।

(পাঠক কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত একান্তই পাঠকের, তার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়) 

বিডি-প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর