কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে, ১৮৯৯-২৯ আগস্ট, ১৯৭৬) বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়কর এক বহুমাত্রিক প্রতিভা। যিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর দ্রোহাত্মক সত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রেম ও সর্বজনীন মানবতা। প্রেম-প্রণয়, আশা-নিরাশা, স্পৃহা-আকাক্সক্ষা, প্রতনু-প্রত্যাশা, হতাশা-বেদনা, বিরহব্যথা ও মানবতা তাঁর কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক এবং গদ্য রচনায় বারবার নানারূপে ফুটে উঠেছে। তিনি প্রেমকে শুধু দেহারাধ্যের সীমায় আবদ্ধ রাখেননি, বরং প্রেমকে মানবতা, স্রষ্টা এবং প্রকৃতির সঙ্গে এক সুগভীর সম্পর্কের শাশ্বত সেতুবন্ধ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর সাহিত্যে উদ্ভাসিত প্রেম-দ্রোহ ও মানবতা ব্যক্তিক পর্যায় থেকে সর্বজনীনতায় একীভূত।
কাজী নজরুল রচিত সব গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয়- আকাশ-মহাকাশ, সূর্য-চন্দ্র, ঝড়-বৃষ্টি, ফুল ও পাখি, নদী ও সাগর, পাহাড়-অরণ্য, ঋতুচক্র, ফসলের মাঠ, সবুজ বনানী যা কিছুই থাক না কেন, তা দ্রোহ-প্রেম ও মানবতার মূল প্রতিপাদ্যে অন্তর্নিহিত। নজরুল এসব অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ শুধু সৌন্দর্যের উপাদান হিসেবেই ব্যবহার করেননি, তিনি এসব কিছুকে কাব্যিক আত্মার (poetic soul) সঙ্গী করেছেন। জাগতিক জীবনে প্রেম, বিদ্রোহ, মানবতা, ধর্ম, বিরহ- সবকিছুই মানবিক বিশ্ব গড়ার প্রবল আকুতি। নজরুলের কবিতা ও গানে দ্রোহ-প্রেম ও মানবতা এক চলমান চরিত্র, বস্তুত জন্মতান্ত্রিক মানুষকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার এক জীবন্ত আবেগ।
নজরুল সাহিত্যে প্রেমবোধের প্রবিধরূপ
নজরুলের প্রেমবোধ ব্যক্তিক-সামষ্টিক, অসাম্প্রদায়িক-সর্বজনীন, জাতীয়তা-আন্তর্জাতীয়তা, অন্তর্জগৎ-বহির্জগৎ, ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক বিবিধ বৈচিত্র্যময়তার সমন্বয়ে গঠিত। তাই তাঁর প্রেম কখনো ব্যক্তিগত, কখনো সামাজিক, কখনো আধ্যাত্মিক, আবার কখনো বৈশ্বিকতার এক অনুপম আবহে ভাস্বর। এমন বিচিত্র প্রেমবোধকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- রোমান্টিকতা, বিরহ ও বেদনার সুর, স্রষ্টাপ্রেম ও সুফিবাদের নিগূঢ় ভক্তি এবং মানবপ্রেম ও সাম্যের আকাক্সক্ষায় অসাম্প্রদায়িক প্রেমের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেমন-‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়/ সে কি মোর অপরাধ?’ অথবা ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী/ দেবো খোঁপায় তারার ফুল’। এ ধরনের অসংখ্য গান-কবিতায় কবি নজরুলের শাশ্বত প্রেমের অনুপম পরিচয় বিধৃত। এ ছাড়াও নজরুল রচিত ‘অবেলার ডাক, আশান্বিতা, উপেক্ষিত, আড়াল, চক্রবাক, তোমারে পড়িছে মনে, চিরন্তনী, প্রিয়া, চৈতী হাওয়া, অকরুণ পিয়া, আমার কালো মেয়ে, মিলন-মোহনায়, মনের মানুষ, অনামিকা’ প্রভৃতি কবিতায় মানবপ্রেমের অনিন্দ্য রূপশ্রী দেখতে পাওয়া যায়। “তাহারই লাগিয়া শত সুরে শত গানে/ কাব্যে, কথায়, চিত্রে, জড় পাষাণে,// লিখিছে তাহার অমর অশ্রু-লেখা।/ নীরন্ধ্র মেঘ বাদলে ডাকিছে কেকা!// আমাদের পটে তাহারই প্রতিচ্ছবি,/ সে গান শুনাই- আমরা শিল্পী কবি।” নজরুলের হাজার হাজার লেখায় এমন প্রেম-বিরহ ও বাস্তবতার অসাধারণ চিত্র চিরন্তন। এভাবে তাঁর সাহিত্যে প্রেম স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বজনীন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, নারী-পুরুষ, কোনো ক্ষেত্রেই তা বৈষম্যমূলক নয়। ফলে নারীর প্রতি কবির যেমন ছিল সুগভীর প্রেম তেমনি ছিল প্রবল শ্রদ্ধা। তাই, নারী জাতিকে সম্মান করে ‘নারী’ কবিতায় তাঁর নিবেদন-যে দেশে নারীরা বন্দিনী, আদরের নন্দিনী নয়,/ সে দেশে পুরুষ ভীরু কাপুরুষ জড় অচেতন রয়!/ অভিশপ্ত সে দেশ পরাধীন, শৌর্য-শক্তিহীন,/ শোধ করেনি যে দেশ কল্যাণী সেবিকা নারীর ঋণ!
এভাবে তিনি প্রেমকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখেছেন। বিরহ-বেদনার রূপ তথা বিরহ প্রেমেরই প্রতিসত্তা হিসেবে তাঁর কবিতা ও গানের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে। এ কারণে বলাই যায়, নজরুল সাহিত্যের প্রেমে যেমন উল্লাস, তেমনি আছে ব্যথিত আত্মার সকরুণ বেদনার অশ্রুসিক্ত ছায়া। “বেদনার পারাবার করে হাহাকার/ তোমার আমার মাঝে হে প্রিয়তম।// অনন্ত এই বিরহের নাহি পার,/ হবে না মিলন আর এ জনম।” অথবা, “শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/ বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে।// ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ-স্বপন সম/ আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে।” অথবা “ফুল ঝরার বেলা এলে মোর শেষ অতিথি/ কাঁদে হা হা স্বরে রিক্ত কানন-বীথি।// এলে রে মরুভূমে পিয়াসি চকোর মোর/ শুক্লা তিথির শেষে কাঁদিতে এলে চকোর।// (তুমি) আসিলে জীবন-সাঁঝে ঘুম ভাঙাতে।/ ওগো কে এলে গো চির সাথী অবেলাতে।” এমন হাজার হাজার গানের বাণীতে সমাজ, সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা ও বিদ্রোহের সুর ও প্রেমে অন্তরীণ। তাঁর প্রেম মানে আবেগ, সৌন্দর্য, চেতনা এবং মানুষের পরিপূর্ণ রূপ। এভাবে নজরুল প্রেমকে দেখেছেন বহু রূপে-মানব প্রেম, আধ্যাত্মিক প্রেম, বিরহ, কামনা-বাসনা, হারানোর বেদনায় এবং মুক্ত প্রেমের অনিন্দ্য সরোবরে।
নজরুল মানুষকে ভালোবেসেছিলেন নিঃশর্তে ও নিঃস্বার্থে। প্রেমই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এ কারণে তিনি কবি-সাহিত্যিক, নেতা বা অন্য কিছু হতে চাননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি হতে এসেছিলেন মানবপ্রেমিক। তাই তাঁর রচিত সব গ্রন্থের মর্মবাণী একটাই, তা হলো- প্রেম ও মানবতা। তাঁর দ্রোহেও প্রেম। তাঁর জন্মেও প্রেম। মরণেও প্রেম। নির্দ্বিধায় তাই তিনি বলেছিলেন- “আমি কবি হতে আসি নি। আমি নেতা হতে আসি নি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।”
দ্রোহের অন্তরে প্রেম
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, পত্রিকা সম্পাদনা প্রধানত- জুলুম ও জালিমের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব বিদ্রোহের প্রখর দ্যুতি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী বজ্রের মতো, তবে তা মিথ্যানাশক। কবির কলম অগ্নিগিরি এবং সুচয়িত শব্দসম্ভার লাভার ন্যায় সতেজে উদ্গীরিত। যে কারণে বঞ্চিতের পক্ষে তাঁর দ্রোহ-কণ্ঠস্বর অগ্নিশক্তির সমতুল্য। তবে তিনি শুধু কলমে নয়, কর্মেও ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহী পুরুষ। লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তাঁর সদর্প উচ্চারণ : ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।’/ ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না। আমি সেই দিন হবো শান্ত’। এসব লেখার উদ্দেশ্য শুধুই বিদ্রোহ নয়, বরং মানুষকে ভালোবেসে মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখা। এমন লেখনীর প্রতিটি শব্দ জালিম শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার-দুর্বিচারের বিরুদ্ধে এক অগ্নিকণ্ঠ আওয়াজ। ব্রিটিশ শাসনামলে পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে কবি নজরুল, দুর্বিনীত সাহসে দুঃসহ দাসত্বের বিরুদ্ধে কলম হাতে রুখে দাঁড়ান। তাঁর কবিতা, যেমন-কামাল পাশা, আনন্দময়ীর আগমনে এবং ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলোতে স্পষ্টভাবে অত্যাচারী, জননীপীড়ক ব্রিটিশ শাসনবিরোধী চেতনা ফুটে উঠেছে। এসবই তিনি মানুষের কল্যাণে করেছেন। অগ্নিবীণা, সিন্ধু হিন্দোল, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, সর্বহারা, ফণীমনসা, সঞ্চিতা, জিঞ্জীর, প্রলয় শিখা, ঝড়, মৃত্যুক্ষুধা প্রভৃতি গ্রন্থের লেখাগুলো নিছক দ্রোহের দাবানল নয়; প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার আদায়ের উদাত্ত ঘোষণা।
দ্রোহ-প্রেমে মানবতার জয়গান
নজরুল ইসলাম শুধু কবি নন, বরং একাধারে সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, ছোটগল্পকার এবং সর্বোপরি মানবতার গীতিকার। তাঁর রচনাশৈলিতে বিদ্রোহ ও প্রেমের সংমিশ্রণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে গভীর মানবিক বোধ, সমতা ও ন্যায় বিচারের আহ্বান। তাই সহজেই বলা যায়, নজরুল কবি, প্রেমিক ও বিপ্লবী। তবে তিনি মুখ্যত দুঃখী মানুষের পরম বন্ধু। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও মজলুম জনতার পক্ষে সিসা ঢালা অটল প্রাচীর। তাঁর সাহিত্য ও জীবনযাত্রা মানবতার প্রতি অবিচল ভালোবাসার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মানবতাবাদ তাঁর লেখনীর মূল উজ্জীবনী শক্তি। ‘সাম্যবাদী’, ‘চক্রবাক’, ‘নতুন চাঁদ’, ‘মরুভাস্কর’, ‘দোলন-চাঁপা’, ‘চিত্তনামা’, ‘ছায়ানট’, ‘পুবের হাওয়া’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণী-মনসা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘সন্ধ্যা’, ‘নির্ঝর’, ‘শেষ সওগাত’, ‘চোখের চাতক’, ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘নজরুল গীতিকা’, ‘জুলফিকার’, ‘গীতি শতদল’, ‘রিক্তের বেদন’ প্রভৃতি গ্রন্থের বহু কবিতা গানে মানবতার জয়গান ধ্বনিত হয়েছে। নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্মে বারবার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
কবি নজরুল হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃত্বের কথা বলতেন সৎ সাহসে, যখন ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তুঙ্গে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা কাণ্ডারী হুঁশিয়ার-এ কবি লেখেন : ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’ এ পঙ্ক্তিগুলো নিঃসন্দেহে নজরুলের মানবিক চেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ। তাঁর চোখে জাতি-ধর্ম-বর্ণ কোনো কিছুই মানুষের চেয়ে বড় নয়। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছেন নিখাদ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবি লেখেন- দেখিনু সেদিন রেলে,/ কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!// চোখ ফেটে এলো জল, এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ মানুষের বেদনায় ব্যথিত কবির কী দারুণ শক্তিশালী উচ্চারণ! সত্যি তাঁরই কথায় লিখতে হয়- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। নজরুল শুধু ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন না, তিনি জাতপাত ও ব্রাহ্মণ্যবাদকেও কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে ধর্ম মানেই মানবতা। তিনি সমাজের সব শ্রেণি-পেশার ও ধর্মের মানুষের অসাম্প্রদায়িক নেতা। তাই নারী-পুরুষ, কালো-ধলা, কুলি-মজুর মুটে কিংবা আশরাফ-আতরাফ তাঁর কাছে মুখ্য নয়। কাজী নজরুল অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিকামী মানবতাবাদী ছিলেন বলেই ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। তাই যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানবতার আহ্বান নজরুলের সাহিত্যের অন্যতম উপাদান। মানবতাবাদীরা জালিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। নজরুল শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তিকামী ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর কবিতায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কবিতা মানবিক বোধকে জাগ্রত করে। নজরুল ছিলেন একটি পূর্ণ বিপ্লবী চেতনার নাম, যার প্রভাব সাহিত্য ছাড়িয়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতেও পড়েছে। তিনি একাধারে ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, নারীবাদী, সমাজতন্ত্রী এবং মানবতাবাদী।
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব। তাঁর কলম ছিল তলোয়ার, শব্দ ছিল বজ্র। যে সময়ে ভয়ে ও শাসন ত্রাসনে মানুষের মুখ বন্ধ, সে সময় তিনি লিখেছেন মুক্তির গান। তিনি বিদ্রোহ করেছেন শুধু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়, বরং সব অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাঁর লেখনী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবপ্রেমের দুঃসাহস কীভাবে শিল্প হয়ে ওঠে। তাই তিনি আজীবন আমাদের কাছে দ্রোহের কবি। তবে এই দ্রোহে প্রেমচেতনা বহুমাত্রিক এবং গভীর ব্যঞ্জনাধর্মী। তাঁর প্রেম সৃষ্টিজগৎ, মানবতা, ঈশ্বর এবং জীবনের প্রতি। তিনি প্রেম দিয়ে মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন, বিদ্রোহে প্রেমের শক্তি প্রয়োগ করেছেন। প্রেম, নজরুলের কলমে, এক শক্তিশালী জীবনদর্শন। তাই তিনি শুধু বিদ্রোহের নয়, প্রেমের কবি। এই দ্রোহ-প্রেমের সম্মিলনেই মানবতার জন্ম। তাই মানবতা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা ও সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, লিঙ্গ কিংবা শ্রেণি- কোনো কিছুর ভিত্তিতে তিনি মানুষে মানুষে প্রভেদ মানতেন না। তাঁর জীবন সংগ্রামের, তাঁর সাহিত্য প্রতিবাদের এবং তাঁর কণ্ঠ সব সময় নিপীড়িতের পক্ষে। তাই কাজী নজরুল ইসলাম দ্রোহ-প্রেম ও মানবতার কবি। এবং বিশ্বব্যাপী এক সর্বজনীন কণ্ঠস্বর, যিনি আজও মানুষে মানুষে সংহতির স্বপ্ন দেখান।