ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের আট সদস্য। আর এ ফুটবলারদের কল্যাণেই দূর থেকে পাহাড়ি সৌন্দর্যের অবারিত হাতছানি দেওয়া কলসিন্দুর এখন বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে হয়ে উঠেছে অনন্য একটি নাম। ২০১১-১২ সালেই মহিলা ফুটবল মানচিত্রে ঢুকে পড়েছিল এ গ্রাম। যেখান থেকে উঠে আসে সানজিদা আক্তার, মারিয়া মাণ্ডা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, সাজেদা আক্তার, মার্জিয়া আক্তার। আর তাদের কল্যাণেই হিমালয়ের দেশে হিমালয়ের চূড়ায় উঠে ছিনিয়ে নেয় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি। পরবর্তীতে নিজেদের প্রতিভা, সাহস আর ইচ্ছাশক্তির মিশেলে সময়ের ঘূর্ণায়মান স্রোতে পাল তুলে তারা একেকজন হয়ে ওঠেন ফুটবল-কন্যা। ক্রমশ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিলেতেও তাদের নাম-যশ-খ্যাতি।
ওদের বাবারা কেউ দিনমজুর, কেউবা কৃষক। কারও ছোট-খাটো ব্যবসাও আছে। পারিবারিক সচ্ছলতা না থাকা এসব পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়েরা ইতিহাস তৈরি করেছেন। নেপালের মাটিতে নেপালকেই হারিয়ে প্রথমবার মহিলাদের সাফ প্রতিযোগিতায় জিতল বাংলাদেশ। গেল ১৯ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ফাইনালে নেপালকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। গোটা দেশ আনন্দে মেতে ওঠে। পুরুষ দল আগে সাফ প্রতিযোগিতা জিতলেও মহিলা দল পারেনি। ভারতের কাছে ২০১৬ সালে ফাইনালে হেরেছিল তারা। এবার তৈরি হলো ইতিহাস। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ কেন, মহিলাদের সাফ প্রতিযোগিতা আগে ভারত বাদে অন্য কোনো দলই জিততে পারেনি। অতীতে যে পাঁচবার এই প্রতিযোগিতা হয়েছে, প্রতিবারই জিতেছে ভারত।
ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরবর্তী ধোবাউড়ার কলসিন্দুর এলাকায় গিয়ে কথা হয় প্রমীলা এসব ফুটবলার, তাদের স্বজন ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে। জানা যায়, ২০১১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ঘোষণা হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট। খবরটি কানে আসে ময়মনসিংহ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়া কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিনের।
নিজের স্কুলের জন্য টিম তৈরিতে লেগে পড়েন তিনি। তখন সানজিদা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। যোগ দেন স্কুলের টিমে। এরপর একে একে টিমে নাম লেখান মারিয়া মাণ্ডা, শিউলি আজিম। তাদের দেখে উৎসাহিত হয়ে যোগ দেন মারজিয়া আক্তার, শামসুন্নাহার, তহুরা, সাজেদা, শামসুন্নাহার জুনিয়র। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যাত্রা শুরু করা এ আট খেলোয়াড় এখন জাতীয় দলে।
স্কুলে টিম গঠন হওয়ার পর কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিন নিজেই শুরু করেন প্রশিক্ষণ দেওয়া। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতী রানী শীল নেন দেখভালের দায়িত্ব। ২০১২ সালে জেলায় শুরু হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট। প্রথমবারের মতো অংশ নেয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হন সানজিদা, মারিয়া, তহুরারা। চ্যাম্পিয়ন না হতে পারার আক্ষেপ নিয়ে ফিরে আসেন তারা। শুরু হয় নতুন করে প্রস্তুতি।
কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিন জানান, শুরুটা ছিল চ্যালেঞ্জ। গ্রামের অভিভাবকরা রক্ষণশীল। মেয়েদের ফুটবল খেলার কথা শুনতেই পারতেন না। অভিভাবকদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করার ক্ষেত্রে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এরপর মেয়েদের নিয়ে যখন মাঠে নেমেছি অনেকেই ঠাট্টা মশকরা করেছে। অনুশীলনের সময় মাঠের আশপাশে থাকত উৎসুক মানুষের ভিড়। অনেকেই আমাকে বিদ্রুপ করত। তবে সাহায্য করতেও এগিয়ে এসেছেন অনেকে। মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুল ছুটির পর ও বন্ধের দিন মাঠে অনুশীলন করতে থাকে। এক পর্যায়ে আসে সফলতা।
২০১৩ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পরই স্থানীয় প্রশাসন ও ক্রীড়ামোদী ব্যক্তিদের নজরে আসেন সানজিদা, মারিয়ারা। অল্প করে হলেও মিলতে থাকে সুযোগ সুবিধা।
২০১৪ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মারিয়া মাণ্ডা, শামসুন্নাহার জুনিয়র। এমন সফলতা দেখে এগিয়ে আসেন অন্য নারী শিক্ষার্থীরা। দিন দিন বাড়তে থাকে কলসিন্দুরের স্কুল টিমের সদস্য সংখ্যা।
কলসিন্দুর স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক মিনতী রানী শীল জানান, ‘প্রথমে মেয়েরা লজ্জা পেত। ফুটবলে লাথি দিতে চাইত না। অভিভাবকরাও গালমন্দ করত। কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে আমরা ওদের ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। ওরা এ এলাকার তো বটেই, দেশের নামও উজ্জ্বল করেছে। আমাদের বিশ^াস ছিল এই মেয়েরাই জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে খেলে দেশের জন্য অনন্য গৌরব বয়ে আনবে।’