‘পেশাগত কারণে হিমালয়ে নিয়মিত পর্বত আরোহণের বিভিন্ন ট্যুর পরিচালনার জন্য বছরের অধিকাংশ সময় আমি হিমালয়ে অবস্থান করি। এ কারণে প্রাকৃতিকভাবেই হিমালয়ের আবহাওয়ার সঙ্গে শারীরিকভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। ফলে ২৫ দিনের মধ্যেই সফলভাবে মানাসলু পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছি।’ কথাগুলো বলছিলেন পর্বতারোহী তৌফিক আহমেদ তমাল। দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ১৪ বছর পর সম্প্রতি তিনি বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মানাসলু জয় করেছেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তমাল মানাসলুর শিখরে উড়িয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ পর্বতারোহী এসব কথা বলেন।
তমাল জানান, পর্বত আরোহণ পৃথিবীর ঝুঁকিপূর্ণ, দুঃসাহসিক এবং ব্যয়বহুল একটি খেলা। একজন পর্বতারোহীকে যে কোনো অভিযানের আগে বেশ কিছু পূর্বশর্ত মেনে নিজেকে তৈরি করতে হয়। এ জন্য অধ্যবসায়ের পাশাপাশি কঠিন প্রশিক্ষণও লাগে। নানা রকম বাধা পেরিয়ে তারপর একটি অভিযানের পরিকল্পনা করতে হয়। সাধারণত পর্বত দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত। এই দুর্গমতাকে শরীরের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো প্রক্রিয়া পর্বতারোহীকে রপ্ত করতে হয়।
এই পর্বতারোহী বলেন, আমরা যতই ওপরের দিকে উঠতে থাকি ততই অক্সিজেনের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আর অক্সিজেন সংকটের কারণে পাহাড়ে ওঠার প্রক্রিয়া আরও বেশি রোমাঞ্চকর হয়ে যায়। এতে প্রয়োজন হয় শারীরিক শক্তির। চার থেকে ছয় হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতগুলো সাধারণত বরফে আচ্ছাদৃত। সেখানে আবহাওয়ার তারতম্য হয়, যা খুবই অস্থিতিশীল। এতে নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তুষারঝড়, তুষার ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শঙ্কা আছে। এ ছাড়া পাহাড়ের ওপর বরফ গলে নদীর উৎপত্তি হয়, যাকে বলে গ্লেশিয়ার। পাহাড়ে উঠতে এই গ্লেশিয়ারের ওপর দিয়েই একজন পর্বতারোহীকে ওপরে উঠতে হবে। এরপর সামিট চূড়ার রিজে উঠতে হয়। পরে শেষ পর্যন্ত আপনি পর্বতের চূড়ায় উঠতে পারবেন। গ্লেশিয়ারের মধ্যে নানা ধরনের ফাটল তৈরি হয়, যাকে ক্রিভার্স বলে। ক্রিভার্স আবার দুই ধরনের। কিছু খালি চোখে দেখা যায় আর কিছু ক্ষেত্রে ছোট ফাটলগুলো নতুন তুষার দিয়ে ঢাকা থাকে। যা অনেকটা মৃত্যুফাঁদের মতো। অভিজ্ঞতা না থাকলে এবং রুট সম্পর্কে ধারণা না থাকলে, যথাযথ দিকনির্দেশনা না থাকলে পর্বতারোহণের সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়।
তমাল বলেন, ‘আমি এই প্রথম পৃথিবীর ১৪টি ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতের মধ্যে একটি পর্বতে অভিযান পরিচালনা করেছি। ১৪ বছর পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে মানাসলু পর্বতের চূড়ায় উঠেছি। যা পৃথিবীর অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত, এর উচ্চতা ৮,১৬৩ মিটার বা ২৬ হাজার ৭৬০ ফুট। এ পর্বতকে এক্সট্রিম হাই অলটিটিউড (পর্বত আরোহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য) পর্বত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীতে ৮ হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার দুটো পর্বত বেশ বিখ্যাত। যেখানে প্রচুর পর্বতারোহীর ভিড় থাকে। সারা বিশ্ব থেকে পর্বতারোহীরা এখানে এসে পর্বতারোহণের চেষ্টা করেন। এর একটি মাউন্ট এভারেস্ট আর দ্বিতীয়টি মানাসলু। এ বছর মানাসলু অভিযানের জন্য মোট ৩৭৮ জন পর্বতারোহী পারমিট নিয়েছেন। এই অভিযানে মেয়াদকাল থাকে ৪৫ দিনের মতো। অভিযানটি শেষ করতে আমি এক মাসের পরিকল্পনা করেছিলাম।
তিনি আরও বলেন, পর্বতে যেসব বিপদ আছে তা একজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী আগে থেকেই জানেন। আর এগুলো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থেকে আসে। অভিযানকালীন প্রায়ই দেখেছি নতুন পর্বতারোহীদের অনেকে হুট করে ৮ হাজার মিটার পর্বত আরোহণে এসে বিপদে পড়েছেন। তবে প্রযুক্তিগত কারণে এখন হিমালয়ের পাহাড়ে দুর্ঘটনা কম ঘটছে।
এই পর্বতারোহী বলেন, আমার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পৃথিবীর অবশিষ্ট সর্বোচ্চ পর্বতগুলোর চূড়া ছুঁয়ে দেখা। আমরা হিমালয় থেকে খুব কাছে অবস্থান করছি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে হিমালয়ে অভিযানের সফলতা খুব কম। অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেই ৪০০টি পর্বত আরোহণবিষয়ক ক্লাব আছে। বাংলাদেশে পর্বত আরোহণে ধীরে ধীরে মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এখনো একে ক্রীড়া হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
তমাল জানান, এই সম্পূর্ণ অভিযান তিনি নিজের অর্থায়নে পরিচালনা করেছেন। পেশাগত জীবনে যা উপার্জন করেছেন তার পুরোটাই, ১৯ লাখ টাকা পাহাড়কে ভালোবেসে এর মোহে এই অভিযানে ব্যয় করেছেন। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর যে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় তার সঙ্গে জাগতিক কোনো কিছুর তুলনা হয় না বলেই তিনি পাহাড় ভালোবাসেন। তার ভাষ্যে, ‘আমি পর্বত আরোহণকে ধারণ করি। চাই পর্বত আরোহণে বাংলাদেশ কিছু করুক। ক্রিকেট-ফুটবলে যেমন বাংলাদেশ দেশ হিসেবে বাইরে প্রতিনিধিত্ব করছে তেমনি পর্বত আরোহণেও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ আছে। এটি হচ্ছে মানসিক ও শারীরিক শক্তির খেলা।’
বিবিএ-এমবিএ শেষ করে চাকরি শুরু করেও পাহাড়ের টানে তিনটি চাকরি ছেড়ে মাউন্টেন গাইডিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তমাল। এ থেকে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির কথা ভাবেন। যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে পাহাড়ে নিয়ে যেতে পারবেন। একই সঙ্গে তার অর্থ উপার্জনও হবে। এর আগে শিক্ষাজীবনে দেশের বিভিন্ন পাহাড়ে ঘুরেছেন। পাহাড়ি মানুষদের সঙ্গে মিশেছেন। নিজের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে রক ক্লাইম্বিংয়ের বেসিক এবং অ্যাডভান্স কোর্স করেছেন। পর্বত আরোহণবিষয়ক মৌলিক কোর্স করেছেন ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে। বর্তমানে তমাল অলটিটিউড হান্টার নামের একটি মাউন্টেনিয়ারিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জড়িত। এটি দেশের প্রথম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যারা সবুজ পাহাড় থেকে মানুষকে হিমালয়ের পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছে। এখন দেশ থেকে ২০ থেকে ২৫টি এজেন্সি মানুষকে হিমালয়ের পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আগে বাংলাদেশ থেকে বছরে হিমালয়ের পাহাড়ে একটি-দুটি অভিযানও হতো না। কিন্তু এই সিজনেই ২৫ জন বাংলাদেশি হিমালয়ে যাচ্ছেন। যারা ৬ থেকে ৭ হাজার মিটার উচ্চতার চূড়ায় উঠবেন।
এই পবর্তারোহী জানান, প্রথমে তার মাউন্ট এভারেস্টে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এভারেস্ট অভিযান প্রচুর ব্যয়বহুল। এ বছর এভারেস্ট অভিযানে কমপক্ষে ৫০ হাজার ডলার বা ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টাকা অর্থের প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি সাহায্য বা কোনোরকম পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই অর্থ তার পক্ষে বহন করা সম্ভব না। এ জন্য রেপলিকা হিসেবেই বা বিকল্প হিসেবে এবার মাউন্ট মানাসলু অভিযানে যান। এখন তার লক্ষ্য এভারেস্ট ছুঁয়ে দেখা এর সঙ্গে আরও দুটো পর্বত যোগ করে একটি রেকর্ড এক্সিপিডিশন করার ইচ্ছে। তিনি এক মাসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনটি উঁচু পর্বতের চূড়া অভিযানের পরিকল্পনা করছেন।
তিনি বলেন, পর্বত আরোহণের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা প্রায় ২০ বছরের কাছাকাছি। কিন্তু এই ২০ বছরে এভারেস্টে গিয়েছেন মাত্র সাতজন বাংলাদেশি। আর ৮ হাজার মিটারের উচ্চতায় উঠেছেন আট থেকে ১০ জন। ২০ কোটি মানুষের মধ্যে এই সংখ্যা খুবই সামান্য। অথচ এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে পারি আমরাও পৃথিবীর দুর্গম এলাকায় পৌঁছাতে পারি। এই পর্বতারোহী বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পর্বত আরোহণে প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান নেই। যারা শিখছেন তারা ভারতের বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পর্বত আরোহণের আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠান আছে ইউআইএএ। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত ইউআইএএ-এর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়নি। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ করা হয়নি। যোগাযোগ তৈরি হলে পর্বত আরোহণে হয়তো আমরাও আর্থিক সহায়তা পেতাম। ভারতের মতো পর্বত আরোহণকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনলে একে ক্রীড়া হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারতাম। এতে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেত।