মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

আলো ছড়াচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

আকতারুজ্জামান

আলো ছড়াচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

আলো ছড়াচ্ছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। দ্রুত বিকাশমান খাতগুলোর মধ্যে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও। দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১২টি। আর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থী। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে অংশ নিতে হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়। বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন মানসম্মত শিক্ষাদানের মাধ্যমে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং এতদসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা গ্রামাঞ্চলের জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতি জেলায় অন্তত একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে প্রান্তিক পর্যায়েও উচ্চশিক্ষার সুবিধা পাচ্ছে মানুষ। অতীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও সময়ের সঙ্গে তা কমে এসেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমেই বাড়ছে শিক্ষার মান। বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) থেকে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় চাকরিতে নিজেদের স্থান করে নিচ্ছেন গ্র্যাজুয়েটরা। প্রকৌশল আর প্রযুক্তিতে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক দলাদলি, সংঘর্ষ, সংঘাত থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঝামেলা নেই। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের কোনো ঝামেলাও পোহাতে হয় না ছাত্রছাত্রীদের। তাই অনেকের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর পর ৩১ বছরের ব্যবধানে দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ১১২টি। এসব প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সূত্র ধরে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার হার কমে আসছে। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরাও জাতীয় উন্নয়নে সর্বক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। দুই দশক আগেও দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন স্বল্পতার কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী লাখ লাখ টাকা খরচ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে পাড়ি দিতেন। বর্তমানে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েক লাখ ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ৯৩ হাজার ৫০৩ জন। এদের মধ্যে ছাত্রী ছিল ২৮ হাজার ৮৬৮ জন। এদের মধ্যে স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে ৬৭ হাজার ১৬৪ জন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২৩ হাজার ৯৫৭ জন, স্নাতক (পাস) পর্যায়ে ৩৭৭ জন ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০৫ জন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট প্রায় ৩ লাখ ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্নাতক (পাস) পর্যায়ে ১ হাজার ১৬০টি। স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৯৯টি এবং মাস্টার্স পর্যায়ে আসন রয়েছে ৮৯ হাজার ২৯৬টি।

 

আকর্ষণীয় বিষয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খোলা হয়েছে আধুনিক যুগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও শিক্ষার্থীদের চাহিদা মাফিক নানা বিষয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- আর্কিটেকচার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্র্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, পাবলিক হেলথ, ফার্মেসি, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজি, অ্যাপারেল ম্যানুফেকচারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার, প্রোডাক্ট ডিজাইন, মিউজিক, গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, অ্যাকাউন্টিং, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আইন ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ সরকার বলছে স্মার্ট হয়ে গেছে।

 

বিদেশি শিক্ষার্থীর আগ্রহ বেড়েছে

বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে উচ্চশিক্ষার কোর্স-কারিকুলাম, সিলেবাস ইত্যাদি দেখে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমেও পাঠ গ্রহণ করছে তারা। দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব থাকা সত্ত্বেও গত ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৩ জন বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, ২০১৯ সালে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৬৭ জন। ২০২০ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৫০ জনে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১ হাজার ৬০৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ-তরুণীরা বাংলাদেশে আসছেন। বর্তমানে ২৬টি দেশের শিক্ষার্থী বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, চীন, জাপান, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, গাম্বিয়া, মরক্কো, সাউথ কোরিয়া, মৌরিতানিয়া, তানজানিয়া, অস্ট্রিয়া, রুয়ান্ডা, জিবুতি, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, সাউথ সুদান ও বাহরাইন। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩২টিতে বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন।

বার্ষিক প্রতিবেদনে ইউজিসি বলছে, প্রতি বছরই বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। উন্নত দেশ বিশেষ করে আমেরিকা, কানাডা, চীন, জাপান থেকেও শিক্ষার্থীরা পড়তে এসেছেন। এতে বহির্বিশ্বে একদিকে যেমন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হারও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

বিনা বেতনেও পড়ছেন অনেক শিক্ষার্থী

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনা বেতনেও পড়ছেন অনেক শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এ ভর্তিযোগ্য মোট আসন সংখ্যার শতকরা ৩ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য বিনামূল্যে ভর্তির জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১ সালে ১ হাজার ৬৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অধ্যয়নরত রয়েছেন। উচ্চশিক্ষার সুযোগ সর্বস্তরে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকার মোট আসনের শতকরা ৩ ভাগ দরিদ্র অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষণ করেছে। বর্তমানে মোট ১০ হাজার ৫৬৯ জন দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থী বিনা খরচে অধ্যয়নরত আছেন।

 

ইউজিসি চেয়ারম্যানের ভাষ্য

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার বিস্তারে অনেক কাজ করে যাচ্ছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছেন। হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অভিযোগ, সমালোচনা থাকলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিয়ম মেনে চলছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকেও বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে আসছেন। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার পাশাপাশি দেশও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর