স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটছে বাংলাদেশের। অর্থনীতি বড় হচ্ছে। বাড়ছে শিল্পকারখানা। এসব শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে পরিবহন করতে হচ্ছে। প্রয়োজনের তাগিদে বাড়ছে বাণিজ্যিক যানের চাহিদা। দ্রুত চলাচলের জন্য বাড়ছে মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভরতা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকাশ ঘটছে অটোমোবাইল শিল্পের।
বর্তমানে বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্প দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অটোমোবাইল শিল্পকে একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচনা করছে সরকার। প্রতি বছর এ খাতে দৃশ্যমান প্রবৃদ্ধি ঘটছে এবং জাতীয় আয়ে যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে অটোমোবাইল শিল্প উৎপাদনের আঞ্চলিক কেন্দ্রে পরিণত করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে সরকার।
এতে বলা হয়েছে, সরকারি অর্থায়নে অটোমোবাইলের আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ কেনার ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের প্রস্তুতকৃত মেড ইন বাংলাদেশ লোগোযুক্ত পণ্য অগ্রাধিকার পাবে। নীতিমালায় অটোমোবাইল শিল্পের বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর রেয়াতসহ প্রণোদনা প্যাকেজের সুযোগ দেওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবে অটোমোবাইল শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু নীতিমালা করলেই চলবে না। এ নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে নীতিসহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান খান সম্প্রতি বলেছেন, বিশ্ববাজারে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। এই বড় বাজারে তৈরি পোশাকের মতো অটোমোবাইলের প্রসারের সুযোগ রয়েছে। এর জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। নতুন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠছে, যাদের মধ্যে নতুন গাড়ি কেনার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। তবে আমদানিকৃত গাড়ির শুল্ক এত বেশি যে ক্রেতার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্যে কুলোয় না। এ কারণে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীর বেশির ভাগই রিকন্ডিশন গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, জিপের ৭০ শতাংশই সেকেন্ড হ্যান্ড বা রিকন্ডিশন্ড।
অটোমোবাইল শিল্পের অন্যতম কোম্পানি এসিআই মোটরস লিমিটেড-এর নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, উন্নয়নশীল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ মোটরসাইকেলের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বাজার। ভারতে ২৫ জনে একটি মোটরসাইকেল, ভিয়েতনামে প্রতি চারজনে একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে; সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ৯০ জনে একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়। ফলে এখানে আরও অনেক বেশি মোটরসাইকেলের সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশে মোটরসাইকেলের দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য আমদানি শুল্ক হ্রাস, স্থানীয়ভাবে ভ্যালু অ্যাড করার জন্য ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পে নীতিসহায়তা, উপযোগী যোগাযোগব্যবস্থা, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ও অটোমোবাইল খাতের ভোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে অর্থায়ন সুবিধা বিশেষ করে ব্যাংকঋণের সুপারিশ করেন এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক।
চ্যালেঞ্জের পরও এগিয়ে অটোমোবাইল শিল্প খাত : নানা চ্যালেঞ্জের পরও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় দেশি কোম্পানিগুলো সম্পূর্ণ গাড়ি উৎপাদনে যেতে না পারলেও গাড়ি বা যান সংযোজন শিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। দেশের অর্থনীতির উত্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের যানবাহন এখন বাংলাদেশেই সংযোজন হচ্ছে। বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, মিতসুবিশি, ফোর্ড, টাটা, মাহিন্দ্রাসহ আরও অনেক ব্র্যান্ডের গাড়ি দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। বিআরটিএর প্রতিবেদনমতে, বাণিজ্যিক যানবাহন বিক্রি বেড়েছে বছরে ১০.৬৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ট্রাক, লরি, পিকআপ, থ্রি হুইলার ও ট্রাক্টর।
উদ্যোক্তাদের মতে, অর্থনীতির গতি বাড়ছে বলে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক যানবাহনের জন্য একটি সম্ভাব্য বাজার তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে রাস্তাঘাট। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ব্রিজ। এক শহরের সঙ্গে আরেক শহরের সংযোগ তৈরি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলের মতো অবকাঠামো তৈরি হওয়ার কারণে পাশের ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও আন্তরাষ্ট্রীয় সংযোগ সুবিধা তৈরির পথ খুলে গেছে। আর এ সবই বাংলাদেশে অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশের পথ খুলে দিয়েছে। আর এ পথ ধরেই এ শিল্পে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড, নিটল মোটর, রানার মোটর, এজি অটোমোবাইল, এসিআই মোটরস, ইফাদ অটোস, আফতাব অটো, পিএইচপি অটোমোবাইলস, নাভানা, র্যাংগস মোটরস, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, র্যানকন মোটরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নিজস্ব সংযোজন কারখানা। ভালুকায় নিজস্ব কারখানা রয়েছে রানার অটোমোইলসের। সর্বশেষ ভারতের বাজাজের সহায়তায় গড়ে ওঠা কারখানায় বছরে ৩০ হাজার থ্রি-হুইলার অটোরিকশা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে রানার। ইঞ্জিনের কিছু অংশ ছাড়াও ওয়েল্ডিং, ড্যামিস, বডিসহ অধিকাংশ যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে এ কারখানায়। এ ছাড়া বিশ্বখ্যাত কেটিএম ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল দেশের বাজারে নিয়ে এসেছে রানার গ্রুপ। বিশ্বখ্যাত ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাংলাদেশে আমদানি ও সংযোজন করছে দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ এসিআই মোটরস। কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত পাওয়ার টিলার, ডিজেল ইঞ্জিন ও ট্রাক্টর সুনামের সঙ্গে সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। দুই ব্র্যান্ডের বাস, ট্রাক ও পিকআপ সরবরাহ করছে দেশের আরেক অটোমোবাইল কোম্পানি র্যাংগস মোটরস। শক্তিশালী ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত গাড়ি মাহিন্দ্রা পিকআপ নিয়ে এসেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন দেশের বাজারে নিয়ে এসেছে জ্যাক পিকআপ ভ্যান ও ট্রাক। এসব গাড়ি নিজেরাই স্থানীয়ভাবে সংযোজন করছে। বিশ্বখ্যাত প্রোটন গাড়ি বাংলাদেশে তৈরি করছে পিএইচপি অটোমোবাইল। ভারতের কোম্পানি হিরোর সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল তৈরি করছে আরেক কোম্পানি নিটল-নিলয় গ্রুপ।
টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার রায় বলেছেন, ২০০৭ সালে ছোট্ট পরিসরে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই কোম্পানির যৌথ মালিকানায় এ দেশে ব্যবসা শুরু করে টিভিএস। আজ আমরা দেশের মোটরসাইকেল মার্কেটের ২২ থেকে ২৩ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছি। একক কোম্পানি হিসেবে মোটরসাইকেলের জগতে টিভিএসের অবস্থান দ্বিতীয়।
বাংলাদেশে গাড়ি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ইফাদ অটোস লিমিটেড এবং ভারতের গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি অশোক লেল্যান্ড মিনিবাস ও পিকআপ ভ্যান বাজারে ছেড়েছে। এ ছাড়া টিভিএস ব্র্যান্ডের সিএনজিচালিত অটোরিকশাও দেশের বাজারে এনেছে ইফাদ অটোস। জাপানের সুজুকি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী র্যানকন মোটর বাইকস লিমিটেড ছাড়াও মার্সিডিজ মিতসুবিশি ব্র্যান্ডের গাড়ি দেশে নিয়ে এসেছে। রাসেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আমদানিকৃত কিংটন কেপিআর ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাজারজাত করছে, যা তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি উদ্যোক্তার অনেকেই সম্ভাবনাময় এ শিল্পে বিনিয়োগ করেছেন।
বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি ও নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, নিবন্ধনহীন গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে জবাবদিহিতার আওতায় আনা কঠিন। সারা দেশে ৫০ লাখের মতো ইজিবাইক চলছে। এসব বাহনের জন্য নীতিমালা দরকার।