চাকরির আশায় যশোর থেকে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর হাত ধরে ঢাকায় এসেছিলেন মোহাম্মদ লুত্ফর রহমান। আশা ছিল একটা চাকরি জোগাড় করে জীবিকানির্বাহ করার। মাত্র ২৫০ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসে একটি ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৭২ সালেই কলাবাগানে ছোট্ট একটা দোকান নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন লাজফার্মা। সময়ের পরিক্রমায় কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ে বর্তমানে তিনি লাজফার্মার চারটি শাখার কর্ণধার। সারা দেশে ১২৭টি ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’ দিয়ে ‘ব্র্যান্ড নাম’ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মোহাম্মদ লুত্ফর রহমানের হাতে গড়ে ওঠা লাজ ফার্মা কলাবাগানের গলি থেকে সুনামের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। শৈশবে লুত্ফর রহমান ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তাঁর পাট ব্যবসায়ী বাবা তাঁকে যশোরের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করান। কিন্তু একসময় তিনি চরমপন্থি বাম গোষ্ঠী নকশালের সশস্ত্র সদস্য হয়ে ওঠেন। তরুণ লুত্ফর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। কারণ, তাঁর দল
যুদ্ধে অংশ নিতে তাঁকে নিষেধ করেছিল। তিনি বেশ কয়েক বছর ওই রাজনৈতিক সংগঠনে কাটানোর পর একাত্তরের এক পর্যায়ে দলের নেতারা তাঁর বাবাকে বুর্জোয়া বলে অভিহিত করে এবং লুত্ফরকেই দায়িত্ব দেয় নিজের বাবাকে হত্যা করার জন্য। লুত্ফর রহমান বলেন, ‘আমি আমার জন্মদাতা বাবাকে হত্যা করতে পারিনি। তাই পার্টির নির্দেশ অমান্যের অপরাধে পার্টির দেওয়া মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাই ভারতে। সেখানে আশ্রয় নিই শরণার্থী শিবিরে। প্রণয় ছিল এক সহপাঠীর সঙ্গে। যুদ্ধ শেষ না হতেই ফিরে এসে গোপনে বিয়ে। যুদ্ধ শেষে বেকারত্ব নিয়ে পাড়ি জমান রাজধানী শহরে। শুরু হয় কষ্টের জীবন। ঢাকায় আসার পর তাঁর এক বন্ধু কলাবাগানে থাকার জন্য মাসিক ৩০ টাকা ভাড়ায় এক রুমের একটি বাসার ব্যবস্থা করে দেন। কয়েক মাস পর তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে লুত্ফর তাকে ডাক্তার আহাদুল বারী নামের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। লুত্ফর রহমান বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে দেখে ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তার বিনামূল্যে কিছু ওষুধ দিয়ে আমাকে সহায়তা করেছিলেন।’ ডাক্তার বারী কলাবাগানের বসিরউদ্দিন রোডসংলগ্ন নিজ চেম্বারের ফার্মেসিতে লুত্ফর রহমানকে কাজ দেন এবং তাঁর বাসায় একটা রুম ভাড়া দিয়ে এই দম্পতির থাকার কথা জানান। তাঁর দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন দোকান থেকে ওষুধ কেনা এবং ডাক্তারের চেম্বারের ফার্মেসিতে মুনাফায় তা বিক্রি করা। এটিই ছিল ওষুধ বিক্রেতা হিসেবে লুত্ফর রহমানের যাত্রা শুরুর গল্প। কিছু টাকা সঞ্চয় হলে ১৯৭২ সালেই কলাবাগানের প্রথম গলিতে ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর সন্তানদের নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দোকানের নাম রেখেছেন। তাঁর মেয়ে লাইজুর নাম থেকে ‘লা’ এবং ছেলে জয়ের নামের প্রথম অক্ষর ‘জ’ নিয়ে দোকানের এই নামকরণ। আর এভাবেই জন্ম হয় ‘লাজফার্মা’র। তিনি বলেন, ওষুধ ব্যবসায় জড়ানোর পর দেখলাম মানুষ যেসব ওষুধ সেবন করে, তার অধিকাংশই মূলত নকল বা নিম্নমানের। ভেজালে ভরা ওষুধ, ইনসুলিনে সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। তখন থেকে ওষুধের এই অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। ১৯৮০-এর দশকে ওষুধ ব্যবসায় ব্যাপক অনৈতিক চর্চার কারণে লুত্ফর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে তিনি সপরিবারে কানাডায় চলে যান। সেখানে একটি বাড়িও কিনেছিলেন। তিনি সেখানে ওষুধের দোকানে ঘুরে বেড়াতেন। কানাডার ওষুধের চেইন শপ ‘শপার্স ড্রাগ মার্ট’-এর আদলে ফার্মেসি তৈরির স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি ওষুধের দোকানগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। দোকানগুলো ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং ওষুধগুলো চমৎকারভাবে সাজানো। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার ফার্মেসিকেও একইভাবে সাজাব। ১০ বছর কানাডায় থাকার পর, ২০০২ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসি। এবার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে ফার্মেসিকে সাজাতে শুরু করি। সাজসজ্জা, গ্রাহকসেবা ও নতুন পরিবেশে বিক্রি বাড়াতে শুরু করি।’ লুত্ফর রহমান অন্যান্য ফার্মেসিকে লাজফার্মার নাম ও লোগো ব্যবহারের অনুমতি দেন। ফলে অন্যরাও লাজফার্মার নামে ফার্মেসি দোকান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অবশ্য সবাই অনুমতি পাননি। আমি মনে করি, যারা মানুষের সেবায় কাজ করবে, তারাই এই ফ্র্যাঞ্চাইজি পাবেন। বাংলাদেশের ফার্মেসি ব্যবসায় ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। যারা এখন ব্যবসায় আসছেন, তারা সরকারি নীতিমালায় নির্ধারিত মডেল অনুযায়ী ফার্মেসি দোকান স্থাপন করছেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর আমাদের অনেক সহযোগিতা করছে।’ সারা দেশে লাজফার্মার মাধ্যমে মানসম্মত ওষুধ পৌঁছে দিতে নিরলস কাজ করে চলেছেন লুত্ফর রহমান। লক্ষ্য ১২৭টি শাখা থেকে ১ হাজার শাখায় উন্নীত করা। সততা ধরে রেখে ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে সাদা মনের মানুষের খোঁজ চলছে অবিরাম। তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধের ব্যবসায় আমার নজর পড়ে সঠিক তাপমাত্রার বিষয়ে। জীবনরক্ষাকারী ওষুধের গায়ে লেখা থাকে কত তাপমাত্রায় সেটা সংরক্ষণ করতে হবে। দেশের অসংখ্য ফার্মেসিতে এসব বিষয়ে খেয়াল করা হয় না। যে কোনো ওষুধ ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরে রাখলে কার্যকারিতা হারায়। যে দোকানগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, সেগুলো আপনাকে মানসম্মত ওষুধ দিতে পারে না। গরমে নষ্ট হয় ওষুধের গুণাগুণ, তাতে অর্থ খরচ হলেও সুস্থতা মেলে না। এজন্য আমি দেশের সব লাজফার্মাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করেছি। মুনাফা কম হলেও মানুষ যেন মানসম্মত ওষুধ পায় এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’ ফার্মেসি এবং ওষুধ রাখার তাপমাত্রা সম্পর্কিত অনেক ছোট বই বা পুস্তিকাও লিখেছেন লুত্ফর রহমান। শুধু ওষুধপত্র নয়, তিনি তাঁর ব্যবসার পাশাপাশি উপন্যাসও লিখেছেন। এ পর্যন্ত ২৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমি লিখতে ভালোবাসি। যখনই সুযোগ পাই, লেখালেখিতে সময় ব্যয় করি।’ এখন আত্মজীবনী লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
শিরোনাম
- আজ ঢাকার বাতাসে কতটা দূষণ?
- রাজধানীতে ডিবির অভিযানে আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার
- সাময়িক বন্ধের পর স্বাভাবিক মেট্রোরেল চলাচল
- রাজধানী ঢাকায় আজ কোথায় কোন কর্মসূচি?
- হারের পর বোলারদের ‘সরি’ বললেন লিটন
- মেট্রো রেলে ঝাঁকুনি, কারওয়ান বাজার-আগারগাঁও রুটে চলাচল বন্ধ
- স্বর্ণের দাম ভরিতে বাড়লো ৮ হাজার ৯০০ টাকা
- এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের
- ৪৮তম বিশেষ বিসিএসে বাড়ছে না চিকিৎসকের পদ
- সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার রোধে দুই সেল গঠনের চিন্তা
- সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযান, গ্রেফতার ১৪৩২
- মাদক মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা চালু করতে না পারলে পিছিয়ে যাব : এ্যানি
- টিকটক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিইসির বৈঠকে ‘অপপ্রচার’ ঠেকাতে আলোচনা
- বন্দরের বাড়তি ট্যারিফ নিয়ে শীঘ্রই স্টেকহোল্ডারদের সাথে বৈঠক হবে : আমীর হুমায়ুন
- সিরিজে টিকে থাকতে বাংলাদেশের দরকার ১৫০ রান
- নির্বাচনকালে নিজ বা শ্বশুরবাড়ি এলাকায় পোস্টিং হবে না
- শিক্ষায় পচন এত যে কমিশন করলেই সেরে যাবে না : পরিকল্পনা উপদেষ্টা
- প্লট দুর্নীতি : হাসিনা-পুতুল-জয়ের বিরুদ্ধে আরও ৮ জনের সাক্ষ্য
- সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বই আকারে প্রকাশে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান
- আগামীর নতুন বাংলাদেশ হবে শিক্ষানির্ভর : আমীর খসরু
প্রকাশ:
০০:০০, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫
আপডেট:
০০:৫৯, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫
কলাবাগানের গলি থেকে সারা দেশে পৌঁছেছে লাজফার্মা
মোহাম্মদ লুত্ফর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক , লাজফার্মা লিমিটেড
জয়শ্রী ভাদুড়ী
প্রিন্ট ভার্সন
এই বিভাগের আরও খবর