রবিবার, ৩১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

এক ফুটবল নক্ষত্রের বিদায়

রাশেদুর রহমান

এক ফুটবল নক্ষত্রের বিদায়

গোলাম রব্বানী হেলাল। কারও মতে, তিনি বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের একজন অন্যতম সেরা তারকা। কারও মতে, সেরা সংগঠক। অনেকের কাছে খুব বড় মাপের মানুষ। একজন ফুটবলার ও সংগঠক হিসেবে দীর্ঘ ইতিহাস আছে গোলাম রব্বানী হেলালের। বাংলাদেশ জাতীয় দল এবং আবাহনী লিমিটেডের সাবেক এ ফুটবলার ৬৭ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তার মৃত্যুতে শোকাহত পুরো ক্রীড়াঙ্গন। কেউ বলছেন, খুব দুঃসময়ে একজন অসাধারণ সংগঠককে হারাল দেশের ফুটবল। কেউ বলছেন, এক ফুটবল নক্ষত্র বিদায় নিলেন আমাদের মাঝ থেকে।

খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক অর্জন ছিল গোলাম রব্বানী হেলালের। ১৯৭৬ সালে আবাহনীতে নাম লেখালেও তার খেলা শুরু হয় ১৯৭৭ সাল থেকে। সেবার বিজি প্রেসের বিপক্ষে এক ম্যাচে ডবল হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। তবে তার দুর্ভাগ্য, ম্যাচটা বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এর ফলে ডাবল হ্যাটট্রিকটাও আর রেকর্ডবুকে স্থান পায়নি। ১৯৮১ সালে সাধারণ বীমার বিপক্ষে মাত্র ৭ মিনিটে হ্যাটট্রিক করে এক বিরল রেকর্ড গড়েছিলেন হেলাল। সেই রেকর্ড ঢাকার মাঠে এখনো অক্ষুণœ আছে। দীর্ঘ সময় আবাহনীতে খেলেছেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। মাঝখানে অবশ্য খুব অল্প দিনের জন্য বিজেএমসিতে খেলেছিলেন তিনি ১৯৮৩ সালে। আবাহনীর জার্সিতে ছয়টি হ্যাটট্রিক করা হেলাল জীবনের অসংখ্য অর্জন পেছনে রেখে গেলেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব মোহামেডানের বিপক্ষে চারটা গোল আছে তার। তবে নিজ দল এবং প্রতিপক্ষরাও সমানভাবে ভালোবাসত গোলাম রব্বানী হেলালকে। দাপটের সঙ্গে খেলেছেন জাতীয় দলের জার্সিতেও। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত লাল-সবুজের জার্সিতে টানা খেলে গেছেন তিনি। কখনো মিডফিল্ডার কখনো স্ট্রাইকারের প্রয়োজন পূরণ করেছেন হেলাল। থাইল্যান্ড ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। এই সূত্র ধরেই থাইল্যান্ড বেশ কয়েকটা প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচ পরিচালনা করতে ছুটে আসতেন থাইল্যান্ডের রেফারিরা। গোলাম রব্বানী হেলালের সৌজন্যে বাংলাদেশের ফুটবলে আরও অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। তবে তার পথচলা সব সময়ই সহজ হয়নি। ১৯৮২ সালে মোহামেডানের বিপক্ষে উত্তপ্ত ম্যাচের ঘটনা এখনো পুরনো ফুটবল দর্শকদের চোখে ভাসে। সেই ম্যাচে গ-গোলকে কেন্দ্র করে জেলে যেতে হয়েছিল আবাহনীর চার ফুটবলারকে। তাদের মধ্যে ছিলেন গোলাম রব্বানী হেলালও। অন্য তিনজন ছিলেন কাজী মো. সালাউদ্দিন, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু এবং কাজী আনোয়ার।

খেলোয়াড়ি জীবনের পরও ফুটবলই ছিল তার প্রিয় কর্মক্ষেত্র। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন তিনি। আর প্রিয় ক্লাব আবাহনীর পরিচালক ছিলেন আমৃত্যু। শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রেরও পরিচালক ছিলেন তিনি। গতকাল তাকে বিদায় জানাতে আবাহনী ক্লাব মাঠে ছুটে আসেন অগণিত ভক্ত-অনুরাগী। অনেকের চোখেই ছিল অশ্রু। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিজেদের আবেগ সামলাতে পারেননি ক্লাব ও জাতীয় দলের প্রিয় সতীর্থরা। পরম আত্মœীয়ের মতোই তাকে বিদায় জানান তারা। আবাহনী ক্লাব ও বাফুফে ভবনে জানাজা শেষে গোলাম রব্বানী হেলালের মৃতদেহ দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে। হেলালের বড় মেয়ে অশ্বিনী বলেন, ‘আপনারা আমার বাবাবে অনেক ভালোবাসতেন। সবাই দোয়া করবেন তার জন্য।’ হেলাল দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

গোলাম রব্বানী হেলালের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনসহ বাফুফের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। হেলালের প্রিয় ক্লাব আবাহনী লিমিটেড ছাড়াও প্রিমিয়ার লিগের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং, বিসিবিসহ দেশের অনেক ক্লাব, ক্রীড়া সংগঠন, সংগঠক এবং ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থাগুলোও শোক প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। হেলালের মৃত্যুতে আবাহনী লিমিটেড ও বাফুফে ভবনে তিন দিন পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।

 

গোলাম রব্বানী হেলালের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনসহ প্রতিষ্ঠানটির সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। হেলালের প্রিয় ক্লাব আবাহনী লিমিটেড ছাড়াও প্রিমিয়ার লিগের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং, বিসিবিসহ দেশের অনেক ক্লাব, ক্রীড়া সংগঠন, সংগঠক এবং ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থাগুলোও শোক প্রকাশ করেছে

গোলাম রব্বানী হেলাল স্মরণে..

 

আবদুস সাদেক, সাবেক অধিনায়ক, ও কোচ আবাহনী

রব্বানীকে (গোলাম রব্বানী হেলাল) যখন দেখি তখন ও বাচ্চা ছেলে। স্কুল বয় বলা যায়। ওর মামা সুরুজ ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য। তিনিই হেলালকে আবাহনীতে এনেছিলেন। তার বয়স কম হওয়ায় অনেকে খেলাতে চায়নি। আমরা তাকে খেলতে দিই। তাকে খেলতে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। চুন্নু, সালাউদ্দিন, হেলাল যে খেলাটা খেলেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা ত্রয়ী হিসেবে বিবেচিত হবে।

আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু,সাবেক অধিনায়ক, আবাহনী

হেলালের ভিতরে যে টেকনিক ছিল যদি সে মাঠে তা দেখাতে পারত তাহলে নিঃসন্দেহে উপমহাদেশের সেরা স্ট্রাইকার হতে পারত। সে টিভিতে খেলা দেখে তা রপ্ত করে মাঠে খেলতে আসত। তবে মাঠে কৌশলগুলো ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারত না। তবে তারপরও আমি বলব, আমাদের অন্যতম সেরা একজন ফুটবলার ছিল হেলাল। ১৯৮১ সালে সাধারণ বীমার বিপক্ষে মাত্র ৭ মিনিটে হ্যাটট্রিক করে এক বিরল রেকর্ড গড়েছিল হেলাল।

বাদল রায়, বাফুফে সহসভাপতি

যারা ফুটবলকে ভালোবাসে তাদের অনেকেই চলে যাচ্ছে। এই ফুটবলের কী হবে! সবার কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন হেলাল। বড় মাপের ফুটবলার হওয়ার পাশাপাশি বড় মাপের মানুষও ছিলেন তিনি। একজন সংগঠক হিসেবে বর্তমান সময়ে তার খুব প্রয়োজন ছিল। ফুটবলের জন্য এটা অপূরণীয় ক্ষতি।

শেখ মোহাম্মদ আসলাম, সাবেক ফুটবলার

আমার দেখা সুপার ক্লাস স্ট্রাইকার ছিলেন গোলাম রব্বানী হেলাল। তার মৃত্যুতে আমরা এক বড় তারকার পাশাপাশি একজন ভালো সংগঠকও হারালাম।

খোরশেদ বাবুল, সাবেক অধিনায়ক, আবাহনী

এই শোক ভুলবার নয়। (কান্নায় আর কথা বলতে পারেননি)

সর্বশেষ খবর