বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবির অনেক কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ ছিল ‘উইকেট’! কেবল ভালো ফলের আশায় দেশের মাটিতে যে ধরনের উইকেট বানানো হয়, এমন উইকেটে খেলে অভ্যস্ত ক্রিকেটাররা বাইরে গিয়ে বিপদে পড়ে যান।
দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা না করে সব সময় ‘শটকাটে’ কীভাবে ম্যাচ জেতা যায় এমন দুর্বল ভাবনার কারণেই বড় টুর্নামেন্টে কখনো ভালো করতে পারে না বাংলাদেশ! হোম সিরিজে প্রতিটি দল বাড়তি সুবিধা নিলেও নিজেদের শক্তিমত্তার বিষয়টি ঠিকই মাথায় রাখে। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ যেন একটু ব্যতিক্রম। এ কারণে ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য আসছে না।
তাই বড় টুর্নামেন্টে কিংবা দেশের বাইরে ভালো করতে হলে ঘরের মাঠে উইকেট থেকে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি আপাতত ভুলে যেতে হবে। কারণ দল শক্তিশালী হলে, পাইপলাইন শক্ত হলে যে কোনো ভেন্যুতেই ভালো করা যায়।
উদাহরণ খোঁজার জন্য খুব বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতীয় দলের দিকে তাকালেই হয়। এক সময় এই দলটি হোমে দাপট দেখালেও বিদেশের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ত। কিন্তু এখন ভারতীয় দল বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো দলের বিরুদ্ধে ফেবারিট হিসেবে খেলতে নামে।
বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হেরে ভারতীয় ক্রিকেটাররা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত! হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই দলটাই কয়েকদিন পরই টি-২০তে কী দুর্দান্ত একটা জয় পেল সেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই। ২০ ওভারের ম্যাচে তারা ২০৯ রানের পাহাড় টপকে জিতে গেল।
মজার বিষয় হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলেছে ভারতের সম্পূর্ণ নতুন একটি দল। বিশ্বকাপের ব্যর্থতাকে তারা অতীত করে দিয়ে বাইশ গজে তেড়ে ফুড়ে পারফর্ম করলেন। কী অসাধারণ ব্যাটিং। ক্রিকেটারদের শরীরীভাষা দেখে একবারের জন্যও মনে হয়নি তাদের মধ্যে বিশ্বকাপের ব্যর্থতার ছাপ আছে। বরং ক্রিকেটারদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রাসী ভাব।
যখন যে সুযোগ পাচ্ছেন, নিজেকে মেলে ধরার জন্য উজাড় করে দিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যে অন্য একটি দল খেলল তা বোঝার উপায় নেই। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কারণেই ভারতের ক্রিকেট এমন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা।
ঠিক ভিন্ন চিত্র বাংলাদেশ দলে। এখন পর্যন্ত সাকিব, তামিম, মুশফিকদের বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি! সম্পূর্ণ নতুন একটি দল নিয়েও টি-২০তে ভারতের আগ্রাসী জয়ের পর ক্রিকেট বিশ্লেষক ও কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বিশ্বকাপ ফাইনাল জিততে ব্যর্থ হলেও ভারত যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা তাদের এই ভিন্ন একটা দল এবং খেলার মান দেখেই বোঝা যায়। এটি এমনি এমনি হয়নি, এটি বিসিসিআইয়ের অনেক দিনের পরিকল্পনার ফসল।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না ওরা এখানেই থেমে যাবে। অবাক হব না সামনে কোনো এক সময় ভারত যদি প্রতিটি ফরমেটে দুটি করে দল করে যার একটি খেলবে অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলোর সঙ্গে এবং অপরটি দ্বিতীয় সারির দলগুলোর সঙ্গে।’
‘এর কিছু নমুনা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। ভারতে অনূর্ধŸ-১৯-এর টুর্নামেন্ট চলছে। সেখানে খেলছে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড এবং ভারতের দুটি দল অনূর্ধŸ-১৯ ‘এ’ এবং ‘বি’। আমরা যখন যে কোনোভাবে জেতার জন্য অস্থির হয়ে আছি ওরা তখন প্লেয়ার গড়ছে, দুটি দল করে বেশি বেশি খেলোয়াড়দের সুযোগ দিচ্ছে। এমন কিন্তু নয় যে, ওরা দুটি দল করায় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ত ভারতেরই একটা দল হবে। এক দল করায় দোষের কিছু নেই, তবে আমি শুধু ওদের দৃষ্টিভঙ্গিটার কথা বলছি।’
ভারত, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলো হোম সিরিজে বা টুর্নামেন্টে যখন ক্রিকেটার গড়ার মিশন নিয়ে খেলে তখন আমরা উইকেটের সুবিধা নিয়ে কেবল ফলের চিন্তা করি।
এবারের বিশ্বকাপে চূড়ান্ত ভরাডুবির পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কি তাদের চিন্তায় পরিবর্তন আনবে? অবশ্য এর প্রতিফলনটা নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজেই দেখা যাবে। নিজেদের মতো উইকেট তৈরি করে শটকাটে ফলের পেছনে ছুটবে নাকি স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে ‘রিয়েলিটি চেক’ করবে! কেমন হবে সিলেটের উইকেট- এটাই এখন দেখার বিষয়!