শুধু এবার নয়, সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিবারই ক্রীড়াঙ্গন বদলের আওয়াজ ওঠে। অ্যাডহক কমিটির সময়ও তা দেখা গিয়েছিল। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে ওবায়দুল কাদের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ফেডারেশন ও বিভিন্ন সংস্থায় নির্বাচন দেন। লক্ষ্য ছিল যোগ্য ও দক্ষ সংগঠকরা ফেডারেশনের দায়িত্ব পালন করবেন। ওই সময় নির্বাচনের আগে দাবি উঠেছিল, ফেডারেশনগুলোয় শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মকর্তারা প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। এখন নির্বাচনে তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। ঢাকা বা বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তারা যে কোনো পদে নির্বাচন করতে পারবেন। এজন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগঠক জাফর ইমামের নেতৃত্বে জেলা ও ক্রীড়া সংস্থা ফোরাম গঠন হয়।
জাফর ইমামের মৃত্যুর পরও এ ফোরাম শুধু টিকেই নেই, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় দাপট তাদেরই। ১৯৯৮ সাল থেকে ফোরামই মূলত ক্রীড়াঙ্গন নিয়ন্ত্রণ করছে। কাউন্সিলর বা ভোটার হিসেবে তাদের সংখ্যা বেশি বলে ফোরাম যাকে চাইবে তারাই নির্বাচিত হবেন। এখানে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার কোনো মূল্য নেই। নির্বাচন দেওয়ার পরই ক্রীড়াঙ্গনে টাকার ছড়াছড়ি দেখা যায়। বড় পদে নির্বাচনি প্রচারে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়। মেম্বার পদে প্রার্থীদেরও কম অর্থ খরচ হয় না। কাউন্সিলরশিপ শুরুর পরই ক্রীড়াঙ্গন অনিয়মে ভরে যায়। যে দুর্নীতির কথা বলা হয়, তা বড় আকার ধারণ করে নির্বাচনের মাধ্যমে। কেননা ভোটে জিততে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে চেয়ারে বসে তা আবার তুলেও নেয়।
ক্রীড়াঙ্গন তো ঢাকাকেন্দ্রিক হতে পারে না। এখানে অন্যান্য জেলার লোকদের ফেডারেশনে দায়িত্ব নেওয়ার অধিকার রয়েছে। গণতন্ত্র মানেই ভালোভাবে চলা। কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনের গণতন্ত্র মানেই যা খুশি করা। অ্যাডহক কমিটিতে ঢাকার সংগঠকরা প্রাধান্য পেলেও তখন কি ক্রীড়াঙ্গন খারাপ চলেছে? বড় তিন ফেডারেশন ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি সচলভাবে চলেছে। একেবারে বিতর্কমুক্ত ছিল তা বলা যাবে না। তবে তা ছিল ক্লাবভিত্তিক। আবাহনী হারলে ওই কর্মকর্তাকে দায়ী করত। মোহামেডানের বেলায় একই ঘটনা ঘটত। সমর্থকরা ফেডারেশনের সামনে সাধারণ সম্পাদকের নাম ধরে মিছিল করত এই যা।
গণতন্ত্রে গুরুত্ব দিয়ে গঠন হয় জেলা ও বিভাগীয় সংগঠক পরিষদ (ফোরাম)। গঠন হওয়ার পরই মূলত ক্রীড়াঙ্গনের বারোটা বাজতে শুরু করে। যখন যে ফেডারেশন বা সংস্থার নির্বাচন এগিয়ে আসে ফোরামের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এখানে আর্থিক বিষয়টি চলে আসে। নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে ফোরামকে নানাভাবে খুশি করতে হয়। গত ১৫ বছরে এর মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে আবার ডিমান্ড দেয় তাদের কাকে কাকে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তন নিয়ে আন্দোলনের ঝড় উঠেছে। অথচ এ অনিয়ম বা দুর্নীতির শিকড় যেন কারও জানা নেই। ফোরামকে প্রাধান্য দেওয়ায় ক্রীড়াঙ্গনে দুর্নীতি যে বেড়ে গেছে তা-ও যেন আন্দোলনকারীদের জানা নেই। বিএনপি আমলেও তো ফোরামের জ্বালায় অতিষ্ঠ ছিল ক্রীড়াঙ্গন।
ফেডারেশন বিলুপ্ত বা ব্যক্তির পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছে। আশ্চর্য লাগে আন্দোলনকারী কেউ বলছেন না ক্রীড়াঙ্গনের বিষধর সাপ ফোরাম নিষিদ্ধ হোক। গতকাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বিএনপিপন্থি এক সংগঠক বললেন, ‘আমাদের দল ক্ষমতায় আসুক না দেখবেন ফোরাম কোথায় উড়ে যাবে।’ অতীতে আওয়ামীপন্থিরাও একই কথা বলেছিলেন কিন্তু পারেননি। বরং রং বদলে ঠিকই তারা প্রভাব বিস্তার করছেন। নাজমুল হাসান পাপন, কাজী সালাউদ্দিন, মুমিনুল হক সাঈদের ক্রীড়াঙ্গনে যে প্রভাব তা তো ফোরাম কেন্দ্র করেই। কোনো কিছুর বিনিময়ে বারবার তাদের চেয়ারে বসাচ্ছে ফোরামই। এতে ক্রীড়াঙ্গন ধ্বংস হলে কারও আসে যায় না। নিজেদের পকেট তো ভারী হচ্ছে। এরা কারা তা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি সংগঠকরা চেনেন ও জানেন। এর পরও তাদের বিতাড়িত করা হয় না। আওয়ামীবিরোধীরা আন্দোলন করতে গিয়ে হয়তো ভুলে গেছেন ফোরামই ক্রীড়াঙ্গনে বড় সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এরা থাকবে কি থাকবে না এখনই চিন্তা করতে হবে।