ফুটবলে মূল প্রাণ দর্শকই। মাঠে খেলোয়াড়রা লড়বেন আর গ্যালারিতে দর্শক থাকবে না তা কি হয়? ভারতের বিখ্যাত ফুটবলার অমল দত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘চুন ছাড়া পান আর দর্শক ছাড়া ফুটবল বড্ড বেমানান।’ প্রসঙ্গটা উঠেছিল কলকাতা লিগে হাঙ্গামা নিয়ে। বড় ম্যাচে নিরাপত্তার কারণে দর্শক নিয়ন্ত্রিত করা যায় কি না, এ নিয়ে ভারতীয় এক পত্রিকা রিপোর্ট করে। সে রিপোর্টের কড়া সমালোচনা করে অমল দত্ত বলেছিলেন, ‘ফুটবল উত্তেজনার খেলা। এখানে দর্শক বা সাপোর্টাররা কোনো কারণে উত্তেজিত হতেই পারেন। তাই বলে দর্শক কমিয়ে আনার পরামর্শ দিতে পারেন না। হাঙ্গামা প্রতিরোধ করবে শান্তিরক্ষা বাহিনী। মনে রাখতে হবে ফুটবল উন্নয়নে দর্শকের ভূমিকা রয়েছে।’
অমল দত্ত কেন, কোনো ফুটবলারই দর্শক নিয়ে আপত্তি তুলবেন না। কারণ তারাই তো প্রাণ। তার পরও বিশ্বে নিয়ন্ত্রিত নয়, দর্শকশূন্য গ্যালারিতে ম্যাচ হয়েছে এমন উদাহরণও দেওয়া যাবে। কিন্তু কেন হয়েছে তা ভেবে দেখতে হবে। ভয়াবহ সংঘর্ষে যেখানে অনেকে নিহতও হয়েছেন। উত্তেজনা কাটাতেই দীর্ঘদিন ফুটবল বন্ধ রাখার পর দর্শকশূন্য গ্যালারিতে বাতিল হওয়া ম্যাচগুলো পুনরায় আয়োজনের রেকর্ডও রয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসেও দর্শকশূন্য গ্যালারিতে খেলা হয়েছে। তা-ও আবার মোহামেডান-আবাহনীর শিরোপা লড়াই। ১৯৮৭ সালে বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে দর্শকশূন্য গ্যালারিতে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটি হয়। এমন স্পর্শকাতর ভেন্যু হওয়ার পরও সে ম্যাচে গ্যালারি ফাঁকা রাখা যায়নি। ২০০ থেকে ৩০০ সাপোর্টার বাধা অতিক্রম করে ম্যাচটি উপভোগ করেন।
এত লম্বা উদাহরণ টানার পেছনে বড় কারণ রয়েছে। লক্ষ করা যাচ্ছে দেশের ফুটবল যখন জেগে উঠছে, ঘরোয়া আসরে দর্শকও ভিড় জমাচ্ছেন, তখন একটি মহল যেন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করেছে। তারা চাচ্ছে দর্শকশূন্য ভেন্যু। তা-ও আবার বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনাকে টার্গেট করে। অবাক লাগছে বাফুফের ডিসিপ্লিনারি কমিটির কাণ্ড দেখে। যেহেতু কিংস অ্যারিনা বসুন্ধরা কিংসের হোম ভেন্যু তাই তাদের কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়া হয়েছিল কেন এ ভেন্যুতে দর্শক ছাড়া ম্যাচ আয়োজন করা হবে না। কিংস সেই শোকজের জবাব দিয়েছে। ডিসিপ্লিনারি কমিটি দর্শকশূন্য থেকে সরে এলেও তারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভবিষ্যতে আবার দর্শক হাঙ্গামার মতো ঘটনা ঘটলে কার্যকর হবে কিংস অ্যারিনার দর্শকশূন্য ছয় ম্যাচের শাস্তি।
প্রশ্ন উঠেছে, ডিসিপ্লিনারি কমিটি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না? কারণ কিংস অ্যারিনায় কী এমন লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে যাতে আগাম হুঁশিয়ারি দেওয়া হলো। ফুটবল মাঠে সমর্থকদের গন্ডগোল বা হাঙ্গামা হতেই পারে। বিশ্বের বিভিন্ন লিগে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিংস অ্যারিনার দোষটা কী? শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গ্যালারিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন থাকে। তারা থাকতে হাঙ্গামা হবে কেন? তা ছাড়া কিংস অ্যারিনায় কয়েকটি ম্যাচে যা ঘটেছে তাকে কি হাঙ্গামা বলা যায়? উত্তেজনায় হট্টগোল হয়েছে এই যা। এ দৃশ্য কি ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা ভেন্যুতে হয় না? তাদের বেলায় চুপ কেন! তাহলে কি বিশেষ মহলের সঙ্গে কোনো ক্লাব এই ষড়যন্ত্রে জড়িত?
ফুটবলে যে চরম দর্শকশূন্যতা নেমে এসেছিল তা থেকে উদ্ধারের ভূমিকা রাখছে কিংস অ্যারিনা। এ ভেন্যুই প্রমাণ করেছে সুস্থ ও শান্ত পরিবেশ থাকলে দর্শক টানা যায়। বসুন্ধরা কিংসের হোম ভেন্যু হওয়ার পরই দর্শকের ঢল নামছে এটা কি কোনো মহলের সহ্য হচ্ছে না? তা না হলে অনিরাপদ বলে কীভাবে? এ ভেন্যু যে বিপদের সময় জাতীয় দলের পাশে দাঁড়িয়েছে তা কি কেউ অস্বীকার করবে? সংস্কারের কারণে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রায় পাঁচ বছর ফুটবল নেই। এক কিংস অ্যারিনা ছাড়া আন্তর্জাতিক ফুটবল আয়োজনে কোনো ভেন্যুই উপযোগী নয়। এমন চরম বিপর্যয়ে বসুন্ধরা কিংসের কিংস অ্যারিনা ব্যবহার না করলে বাংলাদেশ কতদিন আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে বঞ্চিত থাকত তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের বড় ঠিকানা বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনাই। শুধু ম্যাচ নয়, অনুশীলনের জন্যও সবচেয়ে উপযোগী মাঠের নাম কিংস অ্যারিনা। জাতীয় দলের কোচ ও খেলোয়াড়দের প্রথম পছন্দের তালিকায় কিংস অ্যারিনাই। ফিফা ও এএফসির কর্মকর্তারা কিংস অ্যারিনা পরিদর্শন করতে এসে প্রশংসা করে গেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার এমন কোনো ক্লাবের নিজস্ব ভেন্যু আছে কি যেখানে ঘরোয়া আসর ছাড়া জাতীয় দলের ম্যাচ হয়েছে? এখানেই ব্যতিক্রম কিংস অ্যারিনা। শুধু ম্যাচ আয়োজন করেই বসে নেই কিংস অ্যারিনা, ভুলতে বসা সাবেক খেলোয়াড়দের সম্মান জানানোর বড় উদাহরণও। কখনো কোনো ভেন্যুতে সাবেক খেলোয়াড়দের প্রধান অতিথি করে ম্যাচসেরার পুরস্কার খেলোয়াড়দের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কি? এমন নজির স্থাপন করেছে বসুন্ধরা কিংসের কিংস ভেন্যুই। একমাত্র কিংসের ম্যাচেই সাবেকদের সম্মান জানিয়ে মাঠে আনা হচ্ছে। সে আদর্শ ভেন্যুকেই কি না দর্শকশূন্য করার অপচেষ্টা চলছে। এতে ক্ষতিটা কি শুধু কিংস অ্যারিনার? এর সঙ্গে দেশের ফুটবল কি জড়িয়ে নেই?