নয় বছরের ছোট্ট একটি ছেলে। অস্থির। অভাবের সংসার বলে নিত্য স্কুলে যাওয়া হয় না। তাই বলে ফুটবল খেলায় কোনো ছেদ নেই। দিন-রাত, সারাদিন বস্তির গলিতে ফুটবল খেলে বেড়ায়। বন্ধুদের ইন সাইড-আউট সাইড ডজে বোকা বানিয়ে গোল করার পর সেকি উৎসাহ! কিন্তু একদিন ফুটবল খেললো না সেই বালক। কেন? ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই ব্রাজিলের সবগুলো পথ সেদিন মিশেছিল রিও ডি জেনিরোর মারকানা স্টেডিয়ামে। যাদের সাধ্য ছিল, তারা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গী হতে উপস্থিত হয়েছিলেন মারকানায়। যারা পারেননি, তারা রেডিওকেই বানিয়েছিলেন সঙ্গী। দো নাসিমান্তোর বাবা সেদিন ঘরে বসে রেডিওতে ধারাবিবরণী শুনছিলেন ব্রাজিল-উরুগুয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালের। ব্রাজিল এগিয়ে যাওয়ায় বাবার চিৎকারের সঙ্গী হয়েছিলেন ছেলেটি। খেলা শেষে প্রিয় দলের হারে বাবার কান্নার সঙ্গীও হয়েছিলেন সেই বালকটি। আজ যিনি পেলে নামে পরিচিত। সেদিন শুধু পেলে কিংবা তার বাবা কাঁদেননি, শোকে মুহ্যমান ছিল পুরো ব্রাজিল, বিশ্বকাপ জিততে না পারায়। ৬৪ বছর পর সেই মারকানায় আবারও বসবে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। এবার কি ব্রাজিলবাসীকে উৎসবের রঙে রাঙাতে পারবেন নেইমাররা? না আবারও সেদিনের মতো কান্নার নোনা জলে ভেসে যাবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশটি। এ জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে ১৩ জুলাই পর্যন্ত।
বিশ্বকাপ শুরু ১৯৩০ সালে। আয়োজক উরুগুয়ে। স্বাগতিক হয়েই বাজিমাত উরুগুয়ের। পরের দুই আসরের আয়োজক ইউরোপ। ১৯৩৮ সালের তৃতীয় আসরের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য এক যুগ বন্ধ থাকে বিশ্বকাপ। ১৯৫০ সালে চতুর্থ আসর বসে ব্রাজিলে প্রথমবারের মতো। আনুষ্ঠানিক কোনো ফাইনাল ছিল না সেবার। তারপরও ব্রাজিল-উরুগুয়ে ম্যাচটি রূপ নিয়েছিল প্রতীকী ফাইনালের! হিসাব অনুযায়ী ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হতো ব্রাজিল। ৪৭ মিনিটে ফ্রিয়াকার গোলে এগিয়েও যায় স্বাগতিকরা। ৬৬ মিনিটে সমতা আনেন স্কিয়াফিনো। ৭৯ মিনিটে উরুগুয়ের বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেন আলচিডি ঘিগিয়া। প্রিয় দলের হার সহ্য করতে না পেরে এক ভক্ত ১০৫ ফুট উঁচু স্টেডিয়াম থেকে লাফ দিয়ে আত্মাহুতি দেন সেদিন। খেলাটি দেখতে মাঠে উপস্থিত ছিলেন প্রায় পৌনে ২ লাখ দর্শক। ব্রাজিলকে শোকের সাগরে পরিণত করা ঘিগিয়া আজও ব্রাজিলিয়ানদের কাছে শত্রু। ঘরের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে না পারার দুঃখ ঘুচিয়েছিল ব্রাজিল ১৯৫৮ সালে পেলের সৌকর্ষে। পরের আসরেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সাম্বা ফুটবলের জনকরা। ২০১৪ সালে আসরের আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল। এবার কি পারবে সংখ্যাটাকে ছয়ে উন্নীত করতে?
স্বাগতিক বলে এবার বাছাইপর্ব খেলতে হয়নি ব্রাজিলকে। না খেললেও গত তিন বছর কনফেডারেশন কাপ, বিভিন্ন প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছেন কোচ ফিলিপ লুই স্কোলারি। নেইমার, ফ্রেড, দানি আলভেজ, অস্কারদের নিয়ে গড়া দলটি এবারের আসরে ফেবারিট। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন স্পেন, জার্মানি, ইতালি, আর্জেন্টিনাও স্বীকার করছে এবার শিরোপা জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ব্রাজিলের। বাজিও বেশি। 'দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ' আয়োজনে ব্রাজিল খেলবে 'এ' গ্রুপে। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের প্রথম ম্যাচ ১২ জুন। প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া। ১৭ জুন ব্রাজিল-মেঙ্েিকা এবং ২৩ জুন তৃতীয় ম্যাচের প্রতিপক্ষ ক্যামেরুন। গ্রুপ থেকে সহজেই দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে নেইমারদের। যদি আর্জেন্টিনা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে ফাইনালের আগে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অবশ্য ১৩ জুলাই ফাইনালে ওঠতে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের টপকাতে হবে স্পেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের কঠিন ব্যারিয়ার । পারবেন কি নেইমাররা?
১৩ জুলাই বিশ্ববাসী জেনে যাবেন ১৯৫০ সালের দুঃখ-কষ্টকে আমাজান নদীতে ছুঁড়ে ফেলতে পারল কি-না ব্রাজিল। না, আবার শোকের কালো কাপড়ে ঢেকে নিয়েছে নিজেদের।