চারদিকে এখন শুধু ফুটবল আর ফুটবল। আর মাত্র ৫ দিন পরই বিশ্বকাপের পর্দা উঠছে। কে হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন_ এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে ঘিরেই উন্মাদনাটা বেশি। কেননা, দুই দেশের সমর্থক বেশি। ফুটবলে দুই জীবন্ত কিংবদন্তি পেলে ও ম্যারাডোনার জন্যই এত ভালোবাসা। পৃথিবীর আর কে কী চাইছেন বলা মুশকিল। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা মনেপ্রাণে চাইছেন এবার বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল হোক। সত্যি বলতে কি, দুটো দলেরই শিরোপা জেতার সামর্থ্য রয়েছে। সে কারণে তাদের ফাইনালে দেখা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হিসাব অনেকটা পরিষ্কার, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলুক আর নাইবা খেলুক এবার বিশ্বকাপে পুরনো দলগুলোর মধ্যেই শিরোপা জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানি উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেনের শিরোপা জেতার কৃতিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে 'ডি' গ্রুপে তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি, উরুগুয়ে ও ইংল্যান্ড পড়ায় যে কোনো একটি দলকে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হবে। কোস্টারিকা অঘটন ঘটালে দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকেই বিদায় নিতে হবে। তবে শক্তি বিশ্লেষণ করলে একটি দল ছাড়া সাত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের নকআউট পর্বে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আট বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের দেখা মিলবে কি? আসলে এক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভাবনা আছে তা নেদারল্যান্ড ও পর্তুগালকে ঘিরেই। পর্তুগাল বিশ্বকাপ ইতিহাসে কখনো ফাইনাল খেলতে না পারলেও ডাচদের অভাগাই বলতে হয়। পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা তিনবার ফাইনাল খেললেও বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ১৯৭৪, '৭৮ ও ২০১০ তিন ফাইনালেই তারা দুর্ভাগ্যক্রমে হেরে যায়। ব্রাজিল বিশ্বকাপে 'বি' গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন স্পেন, রানার্সআপ নেদারল্যান্ড থাকলেও দুটো দেশেরই পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা, প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকছে চিলি ও অস্ট্রেলিয়া। অন্যদিকে 'জি' গ্রুপে জার্মানি ও পর্তুগালকে ফেবারিট ধরা হলেও প্রতিপক্ষ আফ্রিকার ঘানা থাকায় নকআউট পর্ব নিয়ে হিসাব-নিকাশ রয়েছে।
তবে অনেকের ধারণা, জার্মানি ও পর্তুগালই নকআউট পর্বে যাবে। অনেকেই বলছেন, নতুন দল হিসেবে নেদারল্যান্ড ও পর্তুগাল ছাড়া অন্য কারও শিরোপা জেতার সম্ভাবনা নেই। তবে গ্রুপ পর্ব পাড়ি দিলে ডাচদের আবার কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। নেদারল্যান্ড যদি 'বি' গ্রুপে রানার্সআপ আর ব্রাজিল 'এ' গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয় তাহলে নকআউট পর্বে দুই দলের দেখা হয়ে যাবে। একইভাবে ব্রাজিল গ্রুপ রানার্সআপ হলে 'বি' গ্রুপে স্পেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলে শেষ ষোলতে দুই দল মুখোমুখি হবে। অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ করলে দেখা যায় শেষ ষোলতে তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের অন্তত একটির বিদায় নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ নতুন দল হিসেবে নেদারল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হবে কিনা তা নির্ভর করছে শেষ ষোলতে টিকে থাকার ওপর। তবে শক্তির বিচারে ডাচদের হালকা চোখে দেখার উপায় নেই। আসা যাক পর্তুগাল প্রসঙ্গে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে দেশটির বড় প্রাপ্তি হচ্ছে দুবার সেমিফাইনাল খেলা। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে পর্তুগাল ফাইনালে উঠতে না পারলেও তাদের নৈপুণ্য এখনো চোখে ভাসে। কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরও ৫-৩ গোলে জয় পেয়েছিল। ইউসেবিওর হ্যাটট্রিকের কৃতিত্বে তারা অসাধারণ জয় পেয়েছিল। সেমিতে অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যায়। বিশ্বকাপ ইতিহাসে কখনো ফাইনাল খেলতে না পারলেও পর্তুগালে বেশ কয়জন কিংবদন্তি ফুটবলারের দেখা মিলেছে। ইউসেবিওতো ছিলেনই ফিগো, রুই কস্তা বা গোমেজের নৈপুণ্য কখনো ভোলার নয়। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বিশ্ব ফুটবলে এখন তাকেই সেরা ফুটবলার বলা হয়। অনেকে বলেন, ক্রুইফের মতো ফুটবলার থাকার পরও নেদারল্যান্ডের বিশ্ব জয় না করাটা বিস্ময় ব্যাপার। তেমনি রোনালদোর মতো বিখ্যাত ফুটবল থাকার পরও বিশ্বকাপে পর্তুগাল কেন ব্যর্থ হচ্ছে সেটাও তাজ্জবের ব্যাপার। হয়তোবা আবেগ থেকেই এ প্রশ্নটা সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, ক্রুইফের ফুটবল মেধা নিয়ে কারও সংশয় ছিল না। টেকনিক, গতি অর্থাৎ টোটাল ফুটবল বলতে যা বোঝায় তার কারিগর তাকেই বলা হয়। কিন্তু ক্রুইফ যখন খেলতেন তখন নেদারল্যান্ডে আরও ভালোমানের ফুটবলার ছিলেন। এমনকি ১৯৯০ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডই ছিল হট ফেবারিট। রুদগুলিত, বাস্তেন, রাইকার্ডদের মতো বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলার থাকার পরও সেবার নেদারল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালেই উঠতে পারেনি। অন্যদিকে পারফরম্যান্সের বিচারে এবারে পর্তুগালের রোনালদো ছাড়া বিশ্বকাপ জেতার মতো খেলোয়াড় নেই। তাছাড়া রোনালদো কিছুটা ইনজুরিতে আক্রান্ত। প্রথম ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষে তার নামা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এ অবস্থায় পর্তুগাল বিশ্বকাপ জিতবে কীভাবে? 'জি' গ্রুপে অপর দুই দল ঘানা ও যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়াতে ধরে নেওয়া হচ্ছে জার্মানি ও পর্তুগালই শেষ ষোলতে যাবে। তবে গ্রুপ পর্বে টিকে থাকলে পর্তুগালের আবার কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা 'জি' গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হলে শেষ ষোলতে তাদের খেলতে হবে এইচ গ্রুপ রানার্সআপের সঙ্গে। একইভাবে পর্তুগাল রানার্সআপ হলে খেলতে হবে এইচ গ্রুপ চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে। 'এইচ' গ্রুপে রাশিয়া, বেলজিয়াম, আলজেরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে। যদিও প্রস্তুতি ম্যাচে বেলজিয়াম দারুণ খেলছে। তারপরও পর্তুগালের তুলনায় এইচ গ্রুপে চারটিই দুর্বল দল। ফিকশ্চার যেভাবে তৈরি হয়েছে তাতে কোয়ার্টার ফাইনালেও পর্তুগালের তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রোনালদোরা যদি সত্যিই সেমিফাইনালে চলে যায় তাহলে তাদের অবস্থান কী হবে তা দেখার বিষয়। কেননা পর্তুগাল যতই রোনালদো-নির্ভর হোক না কেন বাকি দুই ম্যাচ অর্থাৎ সেমি ও ফাইনাল জেতাটা অবিশ্বাস্য কিছু হবে না। নতুন চ্যাম্পিয়নের সম্ভাবনা বলতে নেদারল্যান্ড ও পর্তুগালকে তালিকায় এগিয়ে রাখা যায়। আফ্রিকার ক্ষেত্রে ঘানা ও ক্যামেরুনের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু তাদের চ্যাম্পিয়নের সম্ভাবনা ক্ষীণই বলা যায়।