দেশের কিংবদন্তি হকি তারকা জুম্মন লুসাই রবিবার না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ক্রীড়াঙ্গনে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন মেজর (অব.) চাকলাদার। ওই আসরে জুম্মন দারুণ খেলেছিলেন। চাকলাদারের লেখায় ফুটে উঠেছে জুম্মনের খেলোয়াড়ি ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু স্মৃতি।
এশিয়া কাপ হকি ১৯৮৫। প্রথম খেলা বাংলাদেশ বনাম ইরান। আমাদের বাংলাদেশ দল রয়েছে হোটেল পূর্বাণীতে। খেলার দিন হোটেল থেকে বাস আমাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে রওনা হলো। হোটেল ইসলামিয়ার সামনের 'গেটে' পুলিশ বাস আটকে বলল- এখান থেকে হেঁটে যান, বাস ভিতরে যাবে না। আজ আমাদের খেলা, আমরা জাতীয় হকি দল ইত্যাদি বলেও অনঢ় পুলিশ কর্মকর্তাদের বুঝান গেল না। সুতরাং হেঁটেই রওনা হলাম। মাঠে ঢোকার সময় দেখলাম, ইরান দলের বাস মাঠের মেইন গেটে দাঁড়িয়ে আছে। ইরানকে হারালাম। জুম্মন লুসাই হ্যাটট্রিক করল। পরের খেলাতে ইসলামিয়া হোটেলের গেটে বাস দাঁড় করিয়ে হেঁটে যাব- কি দরকার পুলিশের সঙ্গে কথা বিনিময় করার। পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে বললেন, নামবেন না, বাস সরাসরি মেইন গেটে যাবে। তারপর গলা চড়িয়ে বললেন, জুম্মন ভাই, আজও একটু দেখিয়ে দিন। পুলিশের মনোভাব পাল্টানোর জন্য জুম্মনের হ্যাটট্রিক টনিকের কাজ দিয়েছে এবং ওই শুরু। আমরা ওই সময় পাল্টে দিয়েছিলাম সমগ্র দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আর জুম্মন হয়ে উঠেছিল বিশ্ব হকি তারকা।
তখন আমার পোস্টিং ঘাটাইল সেনানিবাসে। আমি ঢাকাতে, ছুটি শেষ। ঘাটাইল যেতে হবে একটি রাজনৈতিক দল হরতাল ডেকেছে। আমি জুম্মনকে বললাম, 'দোস্ত কি করি, যেতে তো হবে'। ও বলল, 'গুরু, ভাইব্বোনা, আমি পুশকিনকে নিয়া আইতাছি'। রাত ১টার দিকে পুশকিন ও জুম্মন গাড়ি নিয়ে চলে আসল, চলে গেলাম ঘাটাইল।
সিলেটে এসআই এন্ডটিতে কোর্সে গিয়েছি। সিলেট স্টেডিয়ামের সঙ্গে ওদের বাড়ি। আমি রামা লুসাই, জুম্মন আড্ডা মারতে মারতে রাত ১২টা পার করেছি। কোনো গাড়ি সিলেট সেনানিবাসের দিকে অত রাতে যাবে না। জুম্মন বলল, 'গুরু চিন্তা কী, আমি নামাইয়া দিতাছি'। অত রাতে ওর মোটরসাইকেলে চলে আসলাম। জুম্মন একাই রওনা হলো সিলেটের দিকে। এ রকম বহুবার ও করেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা। সাবি্বর ইউসুফ ভাই দলের ম্যানেজার। তিনি টীম সিলেকশনের সময় একটি কাগজে ড্যানিয়েলের নাম লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন বললেন আগামীকাল ড্যানিয়েল প্রথম একাদশে খেলবে। আমি, জুম্মন, টিসা আর কাঞ্চন। কারা প্রথম একাদশে খেলবে তা ঠিক করেই রেখেছিলাম। আমি বললাম ড্যানিয়েল নয় কিসমত খেলবে প্রথম একাদশে। সাবি্বর ভাই রাশভারি মানুষ। বললেন, আমি বলছি ড্যানিয়েল খেলবে। জুম্মন হঠাৎ বলল এখানে ক্লাব ক্লাব না করে যাতে দেশের ভালো হয় সেটা করাই ভালো। ও কিন্তু সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আবাহনীর, কিন্তু ওই মুহূর্তে জুম্মন ড্যানিয়েলের পরিবর্তে কিসমতকেই প্রাধান্য দিয়েছে আর কিসমত খেলেছিলও দুর্দান্ত।
টিসা কানাডা থেকে আসলেই, কাঞ্চন, জুম্মন, টিসা মিলে রাত কাবার করার আড্ডা হত আমার বাসাতে। অকারণেই কাঞ্চন বিভিন্ন না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে আসর গরম করে ফেলত, কিন্তু জুম্মন দেশের শ্রেষ্ঠতম হকি তারকা হয়েও জাতীয় পুরস্কার পায়নি, তা নিয়ে কোনো হতাশা প্রকাশ করত না। তাকে জাতীয় পুরস্কার দিয়েছে ২০১২ সালে। অথচ ওর পাওয়ার কথা ৩০ বছর আগেই। জাতীয় পুরস্কারের মনোনয়ন কারা দেয়?
আবাহনী বনাম আর্মির খেলা। সেই সময় সেনাবাহিনী দল ২-৩-৫ পদ্ধতিতে খেলত। রাইট হাফ ৬ষ্ঠ ফরোয়ার্ড হিসেবে আক্রমণে যেত। আমি রাইট-হাফ ছিলাম আর অ্যাটাকে যেতামই। আমার কন্ট্রোলে বল। বলটা আমার ডানদিকে ছিল। কাকে দিব, কাকে দিব করে একটু দেরি করছি, এই সুযোগে জুম্মন অনেক বড় লম্বা স্টেপ নিয়ে আমার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে স্টিক দিয়ে গুঁতো দিল, আমি ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে গেলাম। উঠেই একটা বাজে গালি দিয়ে বললাম, 'আর একবার করে দ্যাখ, স্টিক দেখছস, মুখ না ভাইঙা দিমু।' জুম্মন বললো, গালি দ্যান ক্যান, মুখ ভাঙতে পারলে ভাঙেন। জুম্মন কখনই আওয়াজ করে বাহাদুরি করত না। দেশ, বিদেশ সর্বত্র জুম্মন ছিল প্রচণ্ড রকমের বিশ্বাসী এক তরকা। যার উপর নির্ভর করে দলের অধিনায়ক বিজয়ের কথা সব সময়েই ভাবতে পারে। আমি জুম্মনকে নিয়ে সেই নির্ভরতাই পেতাম। মজাদার কথা বলার জন্য জুম্মন থাকত আসরের অন্যতম ব্যক্তি। কিন্তু নিজের ব্যাপারেও ছিল প্রচণ্ডতম নীরব। ওই নীরবতাকে আশ্রয় করেই চলে গেল- দেশের শ্রেষ্ঠতম হকি সন্তান।
-লেখক : জাতীয় হকি দলের সাবেক অধিনায়ক