ভারতের বিপক্ষে সিরিজে বাংলাদেশের ম্যাচ দেখতে দেখতে আমার খালি নবজ্যোত সিঁধু, বিরেন্দর শেবাগ, রবি শাস্ত্রী, রমিজ রাজা, সরফরাজ নেওয়াজ, জিওফ বয়কট, ডেল স্টেইনদের চেহারা ভাসছিল চোখে। বাংলাদেশ ছোট দেশ, ক্রিকেট বিশ্বে কনিষ্ঠতম। ছোট বলে বড় ভাইদের কাছ থেকে যে সহায়তা, স্নেহ পাওয়ার কথা; সবার কাছ থেকে বাংলাদেশ তা পায়নি। উল্টো জুটেছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর ষড়যন্ত্র। স্টেইন নাকি তার জীবনের বাকি বলগুলো বাংলাদেশের বিপক্ষে অপচয় করতে চান না। এখন তো মনে হচ্ছে, ভয়েই স্টেইন বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন না। তামিম, সাকিব, মুশফিকরা তো আছেনই; এখন তরুণ সৌম্য, সাবি্বর, নাসিররাও যে কোনো বোলারকে পাড়ার বোলার বানিয়ে দেওয়ার জন্যই যথেষ্ট। রমিজ রাজাকে তো কদিন আগেই জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এখন নিশ্চয়ই মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজছেন সিঁধু-শেবাগরা। তবে আমি এই নামগুলো স্মরণ করছি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। নিন্দুকেরে আমি সবার চেয়ে ভালোবাসি। তারা দিনের পর দিন উপেক্ষা দিয়েই আমাদের ক্রিকেটারদের তাতিয়ে দিয়েছেন, আমাদের লক্ষ্যে অবিচল করেছেন। আমাদের ক্রিকেটারদের ঠিক পথের দিশা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য এই উন্যাসিকদের প্রতি আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা। শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত থাকেননি ক্রিকেট মোড়লরা। বাংলাদেশকে কোণঠাসা করতে ক্রিকেটের তিন মোড়ল ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া র্যাঙ্কিং নিয়ে নানা কাড়িকুড়ি করেছে। বিশ্বকাপ স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ করে ইংল্যান্ডকে জবাব দেওয়া হয়েছে আগেই। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর রেকর্ড ১০ বছরের পুরোনো। এখন ভারত বুঝছে কত ধানে কত চাল। সিরিজ জয় তো বটেই, হোয়াইটওয়াশও এখন বাংলাদেশের ডালভাত। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলবে আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ের প্রথম আটটি দল। এই নিয়ম করার সময় সবাই নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের মতো পুচকে দল তাদের অভিজাত আসরের কৌলিন্য মাটি করার সুযোগ পাবে না। কিন্তু বিধাতা নিশ্চয়ই মুচকি হেসেছিলেন। এখন র্যাঙ্কিংয়ের সাত নম্বর দল বাংলাদেশ খেলবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। ভারত বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হারায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান। কার হাসি কে হাসে!
বাংলাদেশের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র আসলে সর্বব্যাপী- মাঠে, মাঠের বাইরে, মিডিয়ায়। ১৯ মার্চ মেলবোর্নে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতকে টিকিয়ে রাখতে আম্পায়াররা জোর করে বাংলাদেশকে হারিয়ে দিয়েছিল; এই সত্য এখন সবাই জানেন। হেরে যাওয়া সেই ম্যাচেই লুকিয়ে ছিল বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার মন্ত্র। সেই ম্যাচে পাওয়া নৈতিক জয়েই বাংলাদেশ এখন অন্য বাংলাদেশ। কাউকেই ভয় পায় না। সৌম্য, সাবি্বর, নাসির, তাসকিন, মুস্তাফিজরা ভয়ডরহীন তারুণ্যের নাম; নতুন বাংলাদেশের আগমনী গান এদের ব্যাটে-বলে। উপমহাদেশের উইকেটে চার পেসার নিয়ে খেলার সাহস কে কবে দেখাতে পেরেছে। বাংলাদেশের আগমনী গান, ভয়ডরহীন সাহসী ক্রিকেটে এখন বুঁদ গোটা ক্রিকেটবিশ্ব।
বাংলাদেশ বদলে যাওয়া মানেই কিন্তু সব ম্যাচ জেতা নয়। যেমন ভারতের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে হেরে যাওয়ায় অনেকে মন খারাপ করেছেন। পাকিস্তানের পর ভারতকে বাংলাওয়াশ দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এটাও তো বুঝতে হবে ভারত র্যাঙ্কিংয়ে দুইয়ে থাকা দল। তাদের ব্যাটিং লাইনআপ বিশ্বসেরা। প্রথম দুই ম্যাচে সেই ব্যাটিং খাবি খেয়েছে তরুণ মুস্তাফিজের স্নোয়ার আর কাটারে। বাংলাদেশ দেশের মাটিতে টানা ১০ ম্যাচ জিতেছে। বয়কটের কথা মানছি, বড় দল হতে হলে দেশের বাইরেও জিততে হবে। গত বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ দারুণ খেলেছে। বয়কটের দেশ ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ শেষ করে দেওয়ায় তার একটু লেগে থাকতে পারে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক এর দর্শক। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব মিডিয়া প্রশংসায় ভাসিয়েছে বাংলাদেশের দর্শকদের। বিশেষ করে বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় বাংলাদেশের দর্শক নজর কেড়েছে বিশ্বের। বাংলাদেশের দর্শক আবেগী, কিন্তু সে আবেগ পরিশীলিত। ভারতের দর্শকদের মতো বাংলাদেশের দর্শকরা মাঠে আগুন জ্বালায় না, খেলোয়াড়দের বাড়িতে হামলা চালায় না। পৃথিবীর অনেক দেশে যখন ক্রিকেট মাঠ খাঁখাঁ করে, তখন বাংলাদেশের স্টেডিয়ামে সমুদ্রের গর্জন। বাংলাদেশি বলেই নয়; আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি বাংলাদেশের দর্শকরা পৃথিবীর সবচেয়ে স্পোর্টিং, সবচেয়ে উৎসাহী, সবচেয়ে আবেগী, সবচেয়ে ভালো। সিরিজ হারার পর ভারতীয় মিডিয়ার দরকার ছিল একটা ছুতো, বাংলাদেশকে হেয় করার। সুধীর গৌতমের তিল ঘটনাকে, তাল বানিয়ে তারা সেটাই করছে। ক্রিকেটের আলোচনায় যখন বাংলাদেশের সঙ্গে পারা সম্ভব নয়, তখন তারা ক্রিকেটকে নিয়ে গেছে মাঠের বাইরে। বাংলাদেশের যেমন টাইগার শোয়েব, টাইগার মিলনরা বাঘ সেজে মাঠে যান, সুধীর গৌতমও নিজেকে ভারতের জাতীয় পতাকার রঙে রাঙিয়ে মাঠে আসেন। মাঠে বাংলাদেশের দর্শকদের পাশে বসেই সুধীররা খেলা দেখেন। সুধীর এর আগেও আটবার বাংলাদেশে এসেছেন। কোনো অসুবিধা হয়নি। দ্বিতীয় ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামের বাইরে কিছু দর্শক তাকে দুয়ো দিয়েছে। তাতেই ভয় পেয়ে গিয়ে থাকবেন তিনি। সুধীরই বলেছেন, কেউ তার গায়ে হাত তোলেনি। আসলে ১৯ মার্চের মেলবোর্ন বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের গর্ভে যে উত্তেজনার বারুদ ঠেসে দিয়েছে, তাতে এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। স্টেডিয়ামের ভিতরে-বাইরে থাকা হাজার চলি্লশেক দর্শকের সবাই তো আর এক মানসিকতার নয়। দুয়েকজন অক্রিকেটিয় দর্শক থাকতেই পারেন। এই দুয়েকজনের অবিমৃশ্যকারিতায় নিশ্চয়ই বাংলাদেশের কোটি দর্শকের কৃতিত্ব আর ক্রিকেটারদের গৌরব ম্লান হয়ে যাবে না। তৃতীয় ম্যাচে সুধীর মিরপুরে গলা ফাটিয়েছেন। তার পাশে বসে বাংলাদেশের সমর্থকরা গলা ফাটিয়েছেন। কোনো অসুবিধা হয়নি।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন অনেক পরিণত। ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিণত হচ্ছে দর্শকরাও। ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। বাংলাদেশের ক্রিকেট দর্শকরাও ভদ্রলোক। দেশের জন্য গভীর ভালোবাসা থাকবে, সঙ্গে থাকবে প্রতিপক্ষের জন্য শ্রদ্ধা। নিজেদের সাফল্যে যেমন গলা ফাটাবে, প্রতিপক্ষের ভালো শটেও তালি দেবে। ক্রিকেটের সত্যিকারের স্পিরিটে আমরাই সেরা; মাঠে, মাঠের বাইরে। এটা প্রমাণের পথেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দৃপ্ত পায়ে।
শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছাড়খাড়, তবু মাথা নোয়াবার নয়।