বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের সুন্দরবন ঘেঁষা দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের মৃত মেছের খানের ছেলে মাহাতাব উদ্দিন খান (৭৯)। তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর সহযোদ্ধারাও স্বীকার করেছেন বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তাদের সঙ্গে অংগ্রহণ করেছেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠেনি তার। হতদরিদ্র এই মুক্তিযোদ্ধা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ১০ বছর ধরে শয্যাশায়ী। টাকার অভাবে চিকিৎসাও চালাতে পারছে না তার পরিবার। জীবন সায়াহ্নে এসে মাহাতাব খানের শেষ ইচ্ছা, তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে যাতে মরতে পারেন।
পরিবারের অভিযোগ, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দুই বছর আগে এক লাখ টাকাও নিয়েছেন এক মুক্তিযোদ্ধা নেতা। কিন্তু, আদৌ তালিকাভুক্ত করাতে পারবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তাও দেননি। চেষ্টা করছি, দেখবো-দেখছি বলে তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন ওই মুক্তিযোদ্ধা নেতা।
তবে, টাকা গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে মুক্তিযোদ্ধা নেতা, যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সহকারী কমান্ডার (সাংগঠনিক) মো. হারুন অর রশিদ খান বলেন, মাহাতাব খান আমার অধীনেই যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু, যুদ্ধের প্রমাণাদি নষ্ট হওয়ায় এখনো তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। উপজেলা কমিটির যাচাই বাছাইয়ে তাঁর নাম ‘খ’ তালিকায় উঠেছে। তিনি যাতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন, সে ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রবিবার সকালে সরেজমিন ওই বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১১ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন মাহাতাব খান। সেই থেকে তিনি শয্যাশায়ী। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না এখন। ৩ ছেলে, ৩ মেয়ে তাঁর। ছেলে-মেয়ে সবার বিয়ে হয়েছে। ছেলেরা কেউ দর্জি শ্রমিক, কেউ নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। বাড়ির দুই কাঠা জমি ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। মাটির ভিতর ওপর পুরনো টিনের জরাজীর্ণ একটি কাঠের ঘর। তার মধ্যেই স্ত্রী-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত মাহাতাব খান। প্রতি মাসে প্রায় ৪ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। দরিদ্র পরিবার টাকার অভাবে সঠিক চিকিৎসা করাতে পারছে না।
শয্যাশায়ী মাহাতাব খান ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করছি। রাইফেল চাইলাছি। রাজাকারের হাতে মাইর খাইছি। মরার আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাইলে মইরাও শান্তি পাইতাম।’
মাহাতাব খানের স্ত্রী নূর জাহান বেগম বলেন, ‘স্বাধীনের আড়াই বছর পর আমার বিয়া হইছে। তহন স্বামীর কাছে যুদ্ধের ঘটনা শুনছি। একটা কাঠের বাক্সে যুদ্ধের অনেক কাগজপ্রত্র রাখা ছিল। মাটির ঘরে উঁই পোকা সেগুলা সব খাইয়া ফালাইছে। এগুলার যে এতো মূল্য হবে তহনতো আমরা কেউ বুঝি নাই।’
সহযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ শিকদার বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনের শৌলা, মঠবাড়িয়ার বেতমোড় এবং শরণখোলার তৎকালীন থানাসদর রায়েন্দা বাজারে যুদ্ধ করেছি। এসব যুদ্ধে মাহাতাব খান আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। একবার রাজাকারদের হাতে মারও খেয়েছেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর খুলনা বিডিআর ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়েছি মাহতাব খানকে নিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী স্বাক্ষরিত একটি সনদও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মূল্যবান সেসব প্রমাণাদি অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে।’
ওই সহযোদ্ধা আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বেশিরভাগই অল্প শিক্ষিত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। যে কারণে তারা মুক্তিযুদ্ধের সনদ বা প্রমাণাদির দিকে অতোটা গুরুত্ব দেয়নি। মাহাতাব খানের কাগজপত্রও ওই একইভাবে অবহেলায় হারিয়েছে। তবে তিনি একজন সঠিক মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এখন মৃত্যুশয্যায়। তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।’
মাহাতাব খানের মেজো কাকোলি আক্তার কাজল বলেন, ‘আমার আব্বা একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। ‘একাত্তরের সুন্দরবন’ নামের একটি বইতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর নাম রয়েছে। কিন্তু কাগজপত্র নষ্ট হওয়ায় তালিকাভুক্ত হয়নি। পরবর্তীতে আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ খান বলেন কিছু টাকা খরচ করতে পারলে নাকি আব্বাকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করা যাবে। যেহেতু আব্বা যুদ্ধ করেছেন তাই তার আশ্বাসে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে আমি গার্মেন্টে কাজ করে এককালিন তাকে ৬৫ হাজার টাকা দেই। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ৫ হাজার, ১০ হাজার করে প্রায় এক লাখ টাকা দিয়েছি। তিনি জানিয়েছেন আমার আব্বার নাম ‘খ’ তালিকাভুক্ত হয়েছে। তিনি আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলছেন কি না তা আমরা জানি না।’
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা