আলোকবর্ষের দূরত্বকে প্রচলিত মাইল বা কিলোমিটারের সঙ্গে তুলনা করে বোঝানো সহজ নয়। কারণ, মহাবিশ্ব অসীম, যার কোনো সীমারেখা নেই। জ্যোতির্বিদ রবার্ট বার্নহাম জুনিয়র প্রথম একটি পন্থা খুঁজে পান। যার সাহায্যে আলোকবর্ষের দূরত্বকে বোঝানো সম্ভব
অনেকের জানার আগ্রহ- মহাবিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো কি একই সময়ে দেখা যায়? এর উত্তর হলো- না। কারণ, আমরা জানি পৃথিবীতে সূর্য্যরে আলো পৌঁছোতেও ৮ মিনিট সময় লাগে। আরেকটু বিষদ আলোচনা করা যাক। সৌরজগতে শনিগ্রহ- পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ, যা সাধারণত আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। একবার ভাবুন তো! যদি শনিগ্রহ কোনো গ্রহাণুর আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় (একটি টেলিস্কোপসহ বা ছাড়া), তাহলে কতক্ষণ পর- তা আপনার কাছে দৃশ্যমান হবে? বিজ্ঞানীদের মতে, শনিগ্রহটি প্রায় ৮০ মিনিটের জন্য আপনার কাছে দৃশ্যমান হবে, এমনকি তা টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়ার পরেও। ঠিক এ কারণেই শনিগ্রহ এবং পৃথিবীর মধ্যে গড় দূরত্ব- ০.০০০১৫ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ শনিগ্রহ থেকে আলো পৃথিবীতে আমাদের চোখে পৌঁছাতে প্রায় ৮০ মিনিট সময় নেয়। সুতরাং আমরা পৃথিবী থেকে যে কোনো নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করছি তা যদি ১০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকে তবে টেলিস্কোপ থেকে আমরা যা দেখছি তা তার বর্তমান অবস্থা নয় বরং ১০০ বছর আগে তারাটির অবস্থান দেখছি। এই কারণেই কখনো কখনো টেলিস্কোপকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় টাইম মেশিন বলা হয়। এবার তাহলে জেনে নেওয়া যাক আলোকবর্ষ কী?
পৃথিবীতে দূরত্ব পরিমাপের জন্য আমরা সাধারণত মিটার বা সেন্টিমিটার ব্যবহার করি। এর চেয়ে বেশি দূরত্ব পরিমাপ করতে হলে ব্যবহার করি কিলোমিটার। এই মিটার, কিলোমিটার দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন কাজ চলে যায়। কিন্তু মহাবিশ্বের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির দূরত্ব মাপতে এই একক পরিমাপ ব্যবহার করা যায় না। কারণ, মহাকাশে তো সবকিছুরই দূরত্ব অনেক বেশি। সেখানে তাই কিলোমিটার- মাইলে হিসাব করাও সম্ভব নয়। আর তাই এককে মহাবিশ্ব পরিমাপ করলে অনেক বড় বড় সংখ্যা পাওয়া যায়। তাও বেশ জটিল।
মহাবিশ্বে আলো সবচেয়ে দ্রুতগামী। আলো এক বছরে প্রায় ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। সংজ্ঞার বিবেচনায়- আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ। মহাবিশ্বের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির বেশির ভাগই কাছাকাছি এবং নানা পদার্থে ভরপুর। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে, আলো তার সর্বোচ্চ গতিতে চলছে। যদিও আলো কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ধীর হয়ে যায় (উদাহরণস্বরূপ, আলো পানির মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ ধীরগতিতে ভ্রমণ করে)। তাই এর পরিমাপ সম্ভব নয়। যদিও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এটি বিস্ময়কর ধারণা মাত্র। বিজ্ঞানীদের মতে, আলোকবর্ষ হলো- মহাজাগতিক দূরত্বের একক, সময়ের একক নয়। যেমন- আলো যেখানে প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে, সেখানে এক বছরে কত দূর অতিক্রম করবে সেটা ভাবতেই নিজেকে ছোট ছোট লাগে না? এটাই মহাবিশ্বের বিশালতা।
হিসাবের সুবিধার জন্য মহাবিশ্বের পরিমাপের জন্য আলোকবর্ষ (Light year) ব্যবহার করা হয়। আলোকবর্ষ বলতে বোঝায়, আলো এক বছরে কত দূরত্ব অতিক্রম করে। সময় ও দূরত্বের এই সম্পর্ক আমরা দৈনন্দিন জীবনেও ব্যবহার করি। ধরুন, কোনো বন্ধুর জন্য আপনি অপেক্ষা করছেন। আপনাকে ফোনে জানালেন, তিনি আর দশ মিনিট দূরত্বে আছেন। এ তথ্য দিয়েই আপনি বন্ধুর দূরত্ব সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ঠিক এই পদ্ধতিটিই কাজে লাগিয়েছেন মহাবিশ্বের দূরত্ব পরিমাপে। এ জন্য মহাবিশ্বের পরিমাপে কাজে লাগানো হয়েছে আলোর গতি।
মহাবিশ্বের বিশালতা বর্ণনা করার জন্য কিলোমিটার এবং মাইলের একক ব্যবহার করা অযৌক্তিক। আর তখনই প্রয়োজন হয় আরও বড় এককের। উদাহরণস্বরূপ-সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টুরাইয়ের দূরত্ব প্রায় ৪.৪ আলোকবর্ষ। রাতে আমরা সাধারণত যেসব নক্ষত্র দেখতে পাই, তা আসলে পৃথিবী থেকে কয়েক শ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আমরা যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে আছি, তা এক লাখ আলোকবর্ষ প্রশস্ত। যা সৌরজগতের আকারের ১৬০ মিলিয়ন গুণ বেশি। আমাদের প্রতিবেশী গ্যালাক্সিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব ২.৫৪ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। এটি এককে হিসাব করতে গেলে যেমন বড় হয়ে যায়, তেমনি এর মানেও বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জ্যোতির্বিদ্যায় অন্যান্য এককের পাশাপাশি আলোকবর্ষ একেকটি ব্যবহার করা হয়। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে, মহাবিশ্ব প্রায় ১৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ প্রশস্ত।
আলোকবর্ষের এই দূরত্বকে মাইল বা কিলোমিটারের সঙ্গে তুলনা করে বোঝানো সহজ নয়। মার্কিন জ্যোতির্বিদ রবার্ট বার্নহাম জুনিয়র প্রথম একটি পন্থা খুঁজে পান। যার সাহায্যে খুব সহজে আলোকবর্ষের দূরত্বকে কিলোমিটার বা মাইলে বোঝানো সম্ভব। আমরা জানি, সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। এই দূরত্বকে বলা হয় এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক বা Astronomical Unit (AU)। বার্নহাম আলোকবর্ষকে এই অট-তে কনভার্ট করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বার্নহাম দেখতে পান, এক মাইলকে ইঞ্চিতে রূপান্তর করলে যত সংখ্যা হয়, এক আলোকবর্ষকে অট-তে রূপান্তর করলে প্রায় কাছাকাছি সংখ্যা পাওয়া যায়। এক মাইল বা প্রায় ১.৬ কিলোমিটারকে ইঞ্চিতে রূপান্তর করলে হয় ৬৩ হাজার ৩৬০ ইঞ্চি। অন্যদিকে এক আলোকবর্ষকে অট-তে রূপান্তর করলে হয় ৬৩ হাজার অট। এই মজার মিলটাই আলোকবর্ষের মাপকে আমাদের বোধগম্য মাপের কাছাকাছি নিয়ে আসে। অর্থাৎ আলোকবর্ষ শুধু দূরত্বের পরিমাপ, সময় নয়। কারণ, আলোকবর্ষ দূরত্বের একক, ঠিক যেমন ফুট এবং ইঞ্চি। তবে আলোকবর্ষ গল্পের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক আছে। এটি একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলে, তাই আমরা যা দেখছি তা মহাবিশ্বের পুরনো চিত্র। সহজভাবে বললে, চাঁদ থেকে কোনো আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে আসতে প্রায় এক সেকেন্ড সময় লাগে। একইভাবে সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় সাড়ে আট মিনিট। এমনি করে তারার প্রভাবও অনেক স্পষ্ট। তারা আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। তাই আমরা যখন তারাদের দেখি, তখন আমরা অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকি। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল যে তারা দেখছি, তা পৃথিবী থেকে ৮.৬ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, অর্থাৎ তা ৮.৬ আলোকবর্ষ আগে চলে গেছে। ডেনেব এবং সিগনাস নক্ষত্রগুলো বিশেষ নক্ষত্র, যা ২,৫০০ আলোকবর্ষ দূরে।