রাজধানী ও তার পাশেই দুটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে থাবা পড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর। স্বাস্থ্য কেন্দ্র দুটি হলো- ঢাকা ডেমরার মাতুয়াইল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। দুটিতেই সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এর মধ্যে মাতুয়াইল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে কয়েক দশক ধরে বিনামূল্যে সেবা পেয়ে আসছিলেন ডেমরার বাসিন্দারা। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি জরাজীর্ণ হওয়ার কারণে কয়েক বছর ধরে সেখানে সেবা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এই সুযোগে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আঙিনায় ময়লা রাখার সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করে ডিএসসিসি।
অথচ দুস্থ ও অসহায় মানুষ যাতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পান, এজন্য ডেমরার সারুলিয়ায় পূর্ব ডগাইর এলাকায় ৪৮ শতাংশ জমি সরকারকে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রুস্তম আলী। সেই জমিতে ১৯৭৭ সালে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রয়াত রুস্তম আলীর ছেলে রৌশন বলেন, অন্যায়ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার বাবার দান করা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জায়গায় ভাগাড় নির্মাণ করেছে ডিএসসিসি। এটি থামাতে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাপসের সঙ্গে আমরা পারিনি।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, তৎকালীন মেয়র তাপস প্রায় ৩ কোটি টাকার টেন্ডার দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে দিয়ে ভাগাড়টি নির্মাণ করান। আর বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের পর প্রথমে এসটিএসে এনে রাখা হয়। পরে কেন্দ্রীয় ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হয়।
তবে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওয়ার্ডের ৬২টি স্থানে খাস জমি রয়েছে। এসব জমির কিছু দখল হয়ে গেছে, কিছু জমি এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাসিন্দারা বলেন, ওইসব জমিতে ময়লার ভাগাড় না করে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে করাটা নিন্দনীয় কাজ।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনেই এসটিএস নির্মাণ করা হয়েছে। ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ২০২১ সালের অক্টোবরে এটি উদ্বোধন করেন। ময়লার ভাগাড়ের পাশেই ‘মাতুয়াইল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পুনর্নির্মাণের নির্ধারিত স্থান’- এমন সাইনবোর্ডও দেখা গেছে। বিদ্যমান স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এক তলা ওই ভবনে পানি জমে আছে।
ডগাইর পশ্চিমপাড়ার এক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে ময়লার ভাগাড় না করতে স্থানীয় লোকজন নানাভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটির কার্যক্রম ২০১৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রটির কিছু কর্মী সীমিত পরিসরে স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে থেকে সেবা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। মোট চারজন স্বাস্থ্যকর্মী ২৬ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করেন।
তবে সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, ওই বাড়ির খুপড়ি থেকে সেই অর্থে সেবা দেওয়া হচ্ছে না। তারা দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য দান করা জমিতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি দ্রুত সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য জমি দানকারী রুস্তম আলীর ছেলের কাছ থেকে পাওয়া নথি অনুযায়ী, ২০২১ সালে কেন্দ্রটির সামনে এসটিএস না করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে লিখিতভাবে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এ ছাড়া ওই বছরের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রটি পুনর্নির্মাণের জন্য সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তেজগাঁও থানা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় থেকে লিখিতভাবে মেয়রকে জানানো হয়েছিল। ২০২২ সালের মার্চে একটি রিট আবেদনের পর আদালত থেকেও ছয় মাসের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এসবের কোনো কিছুই আমলে নেয়নি। তবে এসব বিষয়ে ডিএসসিসির কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এদিকে ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি পঞ্চবটী চৌরাস্তার দক্ষিণ পাশে। জানা যায়, ১৯৮০ সালে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান আলী আহমেদ চুনকা ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির জায়গা দান করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে তৎকালীন মেয়র আইভী স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি পুনরায় দখলে নিয়ে ময়লার ভাগাড় বানান।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে ওই জায়গাটি নামজারি করা হয়নি। কিন্তু সেখানে গরিব মানুষকে বিনামূল্যে বিভিন্ন ধরনের সেবা অব্যাহত ছিল। নামজারি না হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আইভী তখন জায়গাটি দখলে নিয়ে নেন।