কিন্তু আমার সুখের জন্য যেসব হত্যা, গুম কিংবা জেলজুলুম করে থাকেন সে সব কুকর্ম যে সর্বদা আমাকে তাড়া করে বেড়ায় তা কাউকে বোঝাতে পারি না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার অসহায় ব্যক্তি বা পরিবারের আর্তচিৎকার এবং ফরিয়াদ আমার স্বাভাবিক জীবন চলার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। আমার হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে যায়। কখনো কখনো মেজাজ গরম হয়ে ওঠে অকারণেই। কোনো কোনো রাতে ঘুম হয় না। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া লোকজনের অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপে আমি প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি। ভয়াবহ আর নোংরা সব স্বপ্ন। কখনো সাপ আমাকে তাড়া করে, আবার কখনো নিজেকে দেখি উত্তাল সমুদ্রের মাঝখানে ডুবে যেতে। কখনো কখনো ঘুমের মধ্যে বীভৎস চেহারার কিছু লোক এসে আমাকে ভাত, মাংস, রুটি প্রভৃতি মনুষ্য খাদ্যের পরিবর্তে জোর করে বিভিন্ন ইতর প্রাণীর বিষ্ঠা খেতে বাধ্য করে।
আমি যখন স্বপ্ন দেখি তখন মনে হয়, এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। পরের দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙে রাজকীয় সানাই নহবতের সুরে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, প্রায় দিনই আমি বিগত রাতের স্বপ্নের কথা মনে করতে পারি। আর তখনই শুরু হয় জেগে থাকার যন্ত্রণা। কখনো-সখনো নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অতিরিক্ত রাগান্বিত হয়ে পড়ি। আর তখনই দরকার পড়ে টাইগ্রিস নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেহ-মনকে শীতল করার। নদীতে নেমে যদি আমি বেশিক্ষণ ধরে সাঁতার কাটি তাহলে আমার দেহরক্ষীরা আমাকে নিবৃত্ত করার জন্য উপায় খুঁজবে এবং তাড়াতাড়ি খবর দেবে আমার শিক্ষক যাকে কিনা আমি বাবা বলে ডাকি সেই মান্যবর বয়োবৃদ্ধ এবং সম্মানিত লোক জনাব ইয়াহিয়া বার্মেকিকে।
আব্বাসীয় জমানায় বার্মেকি বংশের লোকজন ক্ষেত্রবিশেষে খলিফার চেয়েও ক্ষমতাশালী বলে লোকজন বলাবলি করে। পারস্য দেশীয় অভিজাত রাজপুরুষদের বংশ 'বার্মেকিরা' শত শত বছর ধরে বংশানুক্রমে রাজকার্যে পারদর্শী বলে সর্বমহলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। বার্মেকি শব্দটি পারসিক। আরবিতে বলা হয় আল বারামিকাহ। অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতির পণ্ডিতগণ শব্দটিকে বলেন প্রমুখা। আরবি, ফারসি এবং সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ হলেও কথাটির শব্দার্থ কিন্তু এক এবং অভিন্ন। এটির অর্থ নেতা বা প্রধান প্রশাসক কিংবা নিবন্ধনকারী। বহু শত বছর ধরে এই বংশের লোকজন পারস্য সম্রাট বিশেষ করে সাসানিদ সম্রাটদের দরবারে একের পর এক সাফল্য দেখিয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। শোনা যায় তারা নাকি এক সময়ে অগি্ন উপাসক ছিল। তারও আগে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল। হজরত ওমর (রাঃ)-এর সময় পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হলে অন্য লোকজনের মতো তারাও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।
বার্মেকি পরিবারের শিক্ষিত লোকেরা পারস্য রাজদরবার ছাড়াও আরবের বিভিন্ন রাজদরবারে, মধ্য এশিয়া, চীন, বলখ এবং উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার রাজনীতির নেয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তারা রাজনীতির বাইরে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মতত্ত্ব, চিত্রকলা, নৌবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভূগোল, অর্থনীতি, অংক, জ্যামিতি, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞানসহ মানবজীবনের উন্নয়নের বহু ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা করে সারা দুনিয়ায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, বার্মেকিরা ইসলাম গ্রহণ করলেও আব্বাসীয় খলিফাদের পূর্বসূরি উমাইয়াদের কোনো সাহায্যই করেনি। এমনকি তারা উমাইয়াদের রাজধানী দামেস্ক নগরীর নাম পর্যন্ত শুনতে পারত না। এর অবশ্য কারণও ছিল। বার্মেকিরা নিজেদের অভিজাত পারসিক রাজনীতির প্রতিভূ মনে করত। পারস্য সম্রাটগণ খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৮০০ বছর পূর্ব থেকে বংশানুক্রমে কয়েক হাজার বছর ধরে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে আসছিল। পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট সাইরাজ দি গ্রেট কিংবা তৎপরবর্তী সম্রাট প্রথম দারায়ুসের সমপর্যায়ের কোনো রাষ্ট্রনায়ক নাকি পৃথিবীতে কোনো দিন জন্ম নেয়নি- এমনটি দাবি করে পারস্যের লোকজন রাতদিন গর্ব করে বেড়ায়।
পারস্যে যখন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন সাগরের অপর তীরে অর্থাৎ ইউরোপে ছিল ছোট ছোট নগররাষ্ট্র। স্পার্টা, ব্যাকটেরিয়া, মিডিয়া, থার্মোপলি প্রভৃতি নগররাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে পারস্য সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধ করা তো দূরের কথা, যুদ্ধ করার কথা কল্পনাও করতে পারত না। এভাবেই চলল প্রায় দুইশত বছর। এরপর গ্রিসের ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের পুত্র আলেকজান্ডার মাত্র ৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে পারস্য আক্রমণ করেন এবং জয়লাভের পর আমৃত্যু তা দখলে রাখেন, তবে তা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পারসিকরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং আরও সাড়ে তিনশ বছর দাপটের সঙ্গে সমসাময়িক দুনিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে। তাদের সময়ে একমাত্র শক্তিশালী নগররাষ্ট্র ছিল কার্থেজ। ভূমধ্য সাগরের এক তীরে কার্থেজ আর অন্য তীরে রোমের নগররাষ্ট্র-যুগ যুগ ধরে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে এমন ব্যস্ত থাকত যে, পারস্য সম্রাটগণ কার্থেজ বা রোমের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করার প্রয়োজনই বোধ করতেন না।
কোনো ভূখণ্ড কিংবা সাম্রাজ্যে যখন স্বর্ণ সময় আসে তখন সেই জমিনে পয়দা হতে থাকে একের পর এক মহান বীর এবং রাষ্ট্রনায়ক। প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে জৌলুসপূর্ণ শহর কার্থেজেও জন্ম নিয়েছিলেন মহাবীর হামিলকার এবং হানিবলের মতো সফল সমরনায়ক এবং যুদ্ধজয়ী রাষ্ট্রনায়কগণ। ইতিহাসের নির্মম নিয়তির ফাঁদে পড়ে পৃথিবীর সব সফলতাই এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মহাবীর হানিবলের মৃত্যুর পর ৭০০ বছর ধরে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে আধিপত্য বিস্তারকারী কার্থেজ নগরী দুর্বল হয়ে পড়ে। রোমানরা কার্থেজ আক্রমণ করে পুরো শহর জ্বালিয়ে দেয়। সেদিন কার্থেজ নগরীতে একটি প্রাণীও জীবিত ছিল না এবং একটি বসতবাড়ি কিংবা একটি বৃক্ষ- তরুলতা-ঘাসও অবশিষ্ট ছিল না। কার্থেজের পতনের পর রোমান নগররাষ্ট্র ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে এবং জুলিয়াস সিজারের আমলে এসে এটি পারস্য সাম্রাজ্যের জন্য প্রথম হুমকি হয়ে দেখা দেয়।
জুলিয়াস সিজার থেকে অগাস্টাস সিজার- তারপর আরও অনেক রোমান সম্রাট রাজত্ব করলেন রোম সাম্রাজ্যে। তাদের মধ্যে সম্রাট নিরো, সম্রাট জাস্টিনিয়ান, সম্রাট কন্সটাটাইন তো ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তাদের নানমুখী কর্মকাণ্ডের জন্য। জুলিয়াস সিজার ক্ষমতা লাভ করেন ৪৯ খ্রিঃ পূর্বাব্দে। অন্যদিকে মুসলমানগণ পারস্য জয় সম্পন্ন করেন ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে। আয়তনের দিক থেকে পারস্য সাম্রাজ্য ছিল রোমানদের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ বড় ২৬ লাখ বর্গমাইল। ৪৯ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকে ৬৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৭০০ বছর ধরে রোমানরা এবং পারসিকরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল, কখনো থেমে থেমে আবার কখনো বিরতিহীনভাবে। ফলে মুসলমানগণ যখন এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হলেন তখন আপাতত যুদ্ধ বন্ধ হলেও স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল ব্যাপকভাবে। এ স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল সিরিয়া এবং পারস্যের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক যুদ্ধ।
৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ সিরিয়া জয় করেন যখন মুসলমানদের খলিফা ছিলেন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)। ইতিপূর্বে বহু শতাব্দী ধরে সিরিয়া শাসিত হয়ে আসছিল রোমান সম্রাটদের দ্বারা। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম ছিল খ্রিস্টবাদ। মুসলমানগণ জয়লাভ করার পর রোমান সাম্রাজ্যের সব সামরিক ও বেসামরিক আমলা, জমিদার, জায়গীরদার এবং সামন্ত প্রভুগণ রাতারাতি মুসলমান বনে যান এবং কেবল ধর্মের লেবাস পরিবর্তন করে পূর্বের মতো শাসন করতে থাকেন। উমাইয়া আমলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক যখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রস্থল হলো তখন খ্রিস্টবাদের প্রভাবমুক্ত সাবেক রোমান আমলারা প্রবল প্রতাপ নিয়ে তাদের ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে লাগল। তাদের এই দাপট সবাই মেনে নিলেও পারস্যের অভিজাত সম্প্রদায় কোনো দিন মেনে নিল না। তারা ভুলেও উমাইয়া খলিফাদের দরবারে যেতেন না এবং সিরিয়া বা দামেস্কের মাটিতে পা রাখতেন না। পারস্যবাসী অভিজাতগণ বলতেন, ২০০০ বছর ধরে দুনিয়া শাসন করেছি আর নতুন গজিয়ে উঠা রোমান সাম্রাজ্যের কিছু পরাজিত দালালের কাছে আত্দসমর্পণ করব! অসম্ভব! মরে গেলেও না। এভাবেই তারা উমাইয়া যুগের প্রায় ৯০ বছর কাল সময় ধরে নিজেদের খলিফা, রাজকার্য এবং মুসলিম সালতানাত থেকে দূরে রাখল। শিয়া মতবাদ চালু করে তারা মুসলমান নাম ধারণ করেই পূর্বতন পারস্য সাম্রাজ্যের মতো নতুন একটি সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখতে থাকল। এসব স্বপ্নের প্রধান কারিগর ছিল বার্মেকি বংশ।
আমি টাইগ্রিসের স্বচ্ছ পানিতে আমার প্রাণপ্রিয় ঘোড়া সাইমুমকে নিয়ে গোসল করছিলাম আর ফাঁকে ফাঁকে নজর দিচ্ছিলাম নদী তীরের ফাঁকা তটের দিকে। যা আশঙ্কা করছিলাম ঠিক তাই ঘটল। ওরা নিশ্চয়ই আমার শিক্ষককে খবর দিয়েছে। বয়োবৃদ্ধ উজিরে আজম হজরত ইয়াহিয়া বার্মেকির আগমনের দৃশ্য আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। লক্ষ্য করলাম, তিনি আসছেন। পড়ন্ত বিকালে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকা রাশির ওপর ধুলোর ঝড় তুলে তিনি আমার দিকেই অগ্রসর হচ্ছেন। তার সঙ্গে আসছে প্রায় একশ অশ্বারোহীর বিশেষ রক্ষী দল। নদী তীরের নিরাপদ দূরত্বে-আমার রক্ষীদলও দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু সাহস করে কাছাকাছি আসতে পারছিল না। উজিরে আজম এবং তার রক্ষীদল কাছাকাছি হতেই আমার দেহরক্ষীরা তাদের সঙ্গে মিশে গেল। সবাই মিলে নদীর তীরে এসে ঘোড়া থামালেন। উজিরে আজম ঘোড়া থেকে নামলেন এবং পানির কাছাকাছি আসতে লাগলেন। আমার খুব লজ্জা হলো, আমি পোলাপানের মতো ডুব দিয়ে আমার ঘোড়াটির পেটের নিচে লুকোতে চেষ্টা করলাম।
উজিরে আজম ইয়াহিয়া বার্মেকি ঘোড়া থেকে নেমে ধীরপায়ে নদীর পানির কিনারে চলে এলেন। অন্যান্য দিন হলে তিনি শুধু ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মুখে কিছু না বললেও মিটি মিটি হাসতেন। আর তাতেই কাজ হয়ে যেত। আমি পানি থেকে উঠে একান্ত বাধ্য বালকের মতো তার সঙ্গে প্রাসাদে ফিরে যেতাম। ফিরতি পথে আমরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতাম না। এমনকি পরবর্তী সময়ে এসব নিয়ে কোনো আলোচনাও করতাম না। উনি বুঝতেন আমার মর্ম বেদনার কারণ এবং আঘাতের ভয়াবহ ক্ষত সম্পর্কে। উনি এত্ত বুঝতেন- একজন দায়িত্বপূর্ণ শিক্ষিত মানুষ কখন এবং কিভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন কেনইবা বড় বড় পদে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ হঠাৎ রেগে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড করে বসেন! আর এত্তসব বুঝতে পারার কারণে তিনি আমার প্রধানমন্ত্রী এবং আমার আব্বা হুজুরেরও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারও আগে আমার দাদা হুজুর খলিফা আল মনসুর তাকে আজারবাইজানের গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন।
তিনি ছিলেন আমার বাবা খলিফা আল মাহদীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। তার শিক্ষাদীক্ষা আভিজাত্য এবং জ্ঞান গরিমার ওপর আব্বা হুজুর এতটাই নির্ভর করতেন যে, আমাকে মানুষ করার দায়িত্ব তিনি উজিরে আজমকে দিলেন। ফলে আমি ভালোভাবে কথা বলতে শেখার আগেই আমাকে দেখতে পেলাম উজিরে আজমের মহলে। আব্বা হুজুর আমাকে খলিফার শাহী প্রাসাদের পরিবর্তে উজিরে আজমের প্রাসাদে বসবাস করে সব কিছু হাতে-কলমে শেখার ব্যবস্থা করলেন যাতে করে হাজার বছরের পারসিক ঐতিহ্য, ভদ্রতা, সামাজিকতা এবং রাজকীয়তার জৌলুসপূর্ণ আচরণ রপ্ত করতে আমার কষ্ট না হয়। সেই শৈশব থেকে ১৩-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত আমি নিজেকে উজিরে আজমের পুত্র বলেই জানতাম। আমার যেদিন জন্ম হয়েছিল ঠিক সে দিনই তার এক পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, নাম ছিল ফজল ইবনে ইয়াহিয়া। আমি মনে করতাম ফজল এবং আমি হলাম একই মায়ের গর্ভজাত জড়োয়া ভাই এবং আমরা সেভাবেই বেড়ে উঠছিলাম।
ফজল ছাড়াও আমার আরও দুজন ভাই ছিলেন। তাদের নাম জাফর এবং মুসা। আমি এবং ফজল সমবয়সী হলেও আমার বেশি খাতির ছিল জাফরের সঙ্গে আর মুসাকে প্রচণ্ড আদর করতাম ছোট ভাইয়ের মতো। আমি, ফজল, জাফর, মুসা- আমরা চারজনে মিলে সেই স্বর্ণালি শৈশব ও কৈশোরে কত যে আরব্য রজনী পয়দা করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা সবাই ছিলাম হরিহর আত্দা। সবাই ছিল ছাত্র হিসেবে অতিশয় মেধাবী, মানুষ হিসেবে অতি উঁচু মার্গের মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। ফলে আমাদের খেলাধুলা কিংবা দুষ্টমীর মধ্যেও এক ধরনের সৃষ্টিশীলতা ফুটে উঠত। শিক্ষক হিসেবে আমাদের পিতা ইয়াহিয়া বার্মেকির কথা আর কি বলব! এত বড় রাজপুরুষ অথচ সাধনার জগতে তিনি এক মহান ওলি আল্লাহ। মারেফতে তার ব্যুৎপত্তি যেমন দিবানিশি শরিয়তের এলেমের সঙ্গে পাল্লা দিত তেমনি তার ধর্মবোধ এবং আধুনিক জ্ঞান গরিমা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে লোকটিকে দিনকে দিন উঁচু থেকে উঁচুতর আসনে পেঁৗছে দিচ্ছিল।
উজিরে আজমের পরিবারে থেকে একদিনের জন্য- এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি, আমি এই পরিবারের কেউ নই অথবা ফজল, জাফর ও মুসা আমার আপন ভাই নয় কিংবা উজিরে আজম আমার পিতা নন। সম্ভবত ১৪ বছর বয়সে আমি প্রথম আমার জন্মদাতা পিতার মুখোমুখি হলাম এবং জানতে পারলাম-আমিই হলাম খিলাফতের উত্তরাধিকারী। সেই দিনের রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, দুঃখ, আনন্দ, হতাশা সব কিছু প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু একটি কথাই বলব, বার্মেকি পরিবারের সঙ্গে আমার বন্ধন এমন পর্যায়ে পেঁৗছে ছিল যে, আমি আমার পালিত পিতা এবং শিক্ষক হজরত ইয়াহিয়া বার্মেকি এবং তার ঔরসজাত তিন সন্তানকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। ফলে খিলাফতের দায়িত্ব লাভের পর বাবাকে বানিয়েছি প্রধান উজির আর অন্য ভাইদেরও দিয়েছি মহা গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব। এদের মধ্যে জাফর আমার উজির হিসেবে কাজ করছে। ফজলকে নিয়োগ দিয়েছি খোরাসানের গভর্নর হিসেবে এবং মুসাকে বানিয়েছি দামেস্কের গভর্নর।
আমি যখন বার্মেকি পরিবার নিয়ে আমার স্মৃতিগুলো স্মরণ করছিলাম ঠিক তখনই লক্ষ্য করলাম উজিরে আজম তার রাজকীয় পোশাক এবং মুকুট পরিহিত অবস্থায় টাইগ্রিসের পানিতে নেমে এসেছেন। ভিজতে ভিজতে তিনি একদম গলা পানিতে নামলেন। অভূতপূর্ব এ ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। আমি তাকে সালাম দিয়ে সাঁতরে তার কাছাকাছি চলে এলাম। আমার ঘোড়াটির লাগাম ছেড়ে দেওয়া মাত্র ওটি লাফিয়ে তীরে উঠে গেল। রইলাম কেবল আমি আর বাবা। আমি বাবার খুব কাছাকাছি পেঁৗছে তার ডান হাতটি টেনে নিলাম এবং পরম শ্রদ্ধায় হাতে চুমো খেয়ে বললাম, আস্সালামু আলাইকুম বাবা। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে তারপর আমার ললাটে চুমু খেয়ে বললেন, আমিরুল মোমেনীনের মন এখন কেমন? এই বৃদ্ধ মানুষটি কি এই মুহূর্তে আপনার বিরক্তির প্রধান কারণ বলে বিবেচিত হচ্ছে? আমি বেশ লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে তার হাতটি আবার টেনে নিলাম এবং শক্ত করে আমার বুকে চেপে ধরলাম। এরপর সেই হাত দিয়ে আমার মুখমণ্ডলে স্পর্শ করালাম কয়েকবার এবং সবশেষে হাতটিতে চুম্বন করলাম। বাবা আমার মনের বেদনা বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, আমি যেভাবে হোক জাবির ইবনে হাইয়ানকে আপনার দরবারে হাজির করব এবং ইনশাল্লাহ তিনি বাকি জীবন আপনার সানি্নধ্যে কাটাতে
পছন্দ করবেন। (চলবে)