বুধবার, ১২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্রিকেটবিশ্ব কাঁপানো ব্রায়ান লারা

সাইফ ইমন

ক্রিকেটবিশ্ব কাঁপানো ব্রায়ান লারা
‘একমাত্র তার খেলাই গাঁটের টাকা খরচ করে দেখতে চাইব আমি’-  ব্রায়ান লারা সম্পর্কে কথাগুলো বলেছিলেন ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড়। ক্রিকেটবিশ্বে লারার মতো নিখুঁত ব্যাটসম্যান নেই আর একজনও। ক্রিকেট বল পেটানোটাকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান এই ক্যারিবীয় বাটসম্যান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও টেস্টে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটিও তার দখলে। টেস্টে ৯টি ডাবল সেঞ্চুরি ও ২টি ট্রিপল সেঞ্চুরি করা একমাত্র ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা...

 

কৈশোরে কাজ করেছেন দোকানে

২০০৭ বিশ্বকাপ চলছে তখন। ইংল্যান্ড আর উইন্ডিজের বিপক্ষে গুরুত্বহীন নিয়ম রক্ষার একটা ম্যাচ। কিন্তু সেই ম্যাচটাই অনেক বিগ ম্যাচের চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে গিয়েছিল। কারণ এ ম্যাচটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্রায়ান লারার শেষ ম্যাচ ছিল। মাঠ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকদের দিকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন ব্রায়ান লারা, ‘ডিড আই এন্টারটেইন?’ উত্তরটা সবারই জানা। রেকর্ড ভাঙা-গড়াটাকে নিয়মিত অভ্যাস বানিয়ে ফেলায় রেকর্ডের বরপুত্র বলা হয় তাকে। ক্রিকেট দেবতার আশীর্বাদপুষ্টও ভাবেন অনেকে। এক পায়ে ভর দিয়ে খেলা তার পুল শটগুলো ছিল রীতিমতো চোখ ধাঁধানো। তার উইকেটে থাকা মানেই ছিল বাড়তি বিনোদন। তাই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানদের একজন ভাবা হয় তাকে। দ্য প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ নামে খ্যাত ব্রায়ান লারা ১৯৬৯ সালের ২ মে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোব্যাগোর স্যান্টা ক্রুজে জন্মগ্রহণ করেন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে দশম ছিলেন লারা। আদর করে সবাই তাকে প্রিন্সি বলে ডাকতেন। ছয় বছর বয়সেই স্থানীয় ক্রিকেট কোচিং ক্লাবে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল তাকে। এখানেই ব্যাটিংয়ে হাতেখড়ি।

লারার প্রথম স্কুল ছিল সেন্ট জোসেফ রোমান ক্যাথলিক প্রাইমারি স্কুল। এরপর তাকে সান-জুয়ান সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। এক বছর পর ১৪ বছর বয়সে তিনি ফাতিমা কলেজে ভর্তি হন। যেখানে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন কোচ হ্যারি রামদাসের অধীনে।

স্কুলে থাকতেই তার ব্যাটে রানের বন্যা বয়ে যায়। পেশাদার ক্রিকেটের পাঠটা এখানেই শেখেন তিনি। স্কুল বয়েজ লিগে ১২৬ গড়ে করেন ৭৪৫ রান। দুর্দান্ত এ পারফরম্যান্সের কারণে সেই বছরই তিনি ত্রিনিদাদ অনূর্ধ্ব ১৬ দলে ডাক পান। তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। ১৯৮৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুব ক্রিকেট টুর্নামেন্টে কার্ল হুপারের করা ৪৮০ রানের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ৪৯৮ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন। পরের বছর প্রথম শ্রেণির ম্যাচে অভিষেক হয় ব্রায়ান লারার। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেই ম্যালকম মার্শাল ও জোয়েল গার্নারদের বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে করেন ৯২ রান। লারার বয়স তখন মাত্র ১৯। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হয়ে খেলার আগে একটা দোকানে কাজ করতেন। পরিবারের খরচ চালাতে লারার সব ভাইবোনই তখন কিছু কিছু করছে। বাবাই ফোন করে জানিয়েছিলেন জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ দিনে লারার জায়গা হয়েছিল বাথরুমের পাশে। লারা বলেন, ‘খেলোয়াড়রা গোসল করতে আসত। আমাকে আমার ব্যাগটা একবার ডানে, একবার বাঁয়ে সরিয়ে রাখতে হতো। সেই ম্যাচে চূড়ান্ত একাদশে আমার জায়গা হয়নি। এদিকে বাবা এসেছিলেন কয়েকটা টিকিটের আশায়। ম্যানেজার ক্লাইভ লয়েডকে বলে বাবার বন্ধুদের জন্য কয়েকটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলাম। ‘কাল দেখা হবে’ বলে বাবার কাছে বিদায় নিয়ে টিম হোটেলে উঠলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সে রাতেই হার্ট অ্যাটাকে আমার বাবা মারা যান।’ বাবার মৃত্যু অনেকটাই ভেঙে দেয় তাকে। তবে শোক কাটিয়ে আবার ক্রিকেটে ফেরেন তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত লারার সময়টাকে বলা যায় ‘লারা যুগ’। টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটের ব্যাটিংয়ে ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন লারা।

এদিকে পরিবারের সদস্যরাই একটা ক্রিকেট দল।

লারার জীবনে ক্রিকেটের শুরু হয়েছিল ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোব্যাগোর একটা ছোট্ট গ্রামে। লারারা ছিলেন সাত ভাই, চার বোন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে লারা দশম। লারা তার জীবনীতে বলেছেন, পরিবারের সদস্য সংখ্যাই একটা ক্রিকেট দল গঠন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। অতএব, পারিবারিক ম্যাচের মধ্য দিয়ে আমার ক্রিকেট খেলার হাতেখড়ি। বয়সের বিচারে আমাকে ১০ নম্বরে ব্যাট করতে হতো। প্রথমে ব্যাট করতেন বড় ছয় ভাই। মারলিন, অ্যাগনেস আর ক্যাটলিন-  তিন বড় বোনও আমার আগে ব্যাট করতেন। তাদের বক্তব্য সোজাসাপ্টা-  পৃথিবীতে আমরা আগে এসেছি, অতএব আমরা আগে ব্যাট করব! বড় ভাই গাছের ডাল কেটে একটা ব্যাট বানিয়ে দিয়েছিলেন। চার বছর বয়সে পাওয়া সেই ব্যাটটাই আমার জীবনের প্রথম ব্যাট।

লারা মানেই এক অনুপ্রেরণার নাম। যার অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আলো ছড়িয়েছেন অসংখ্য ক্রিকেটার। লারার একটা বিখ্যাত উক্তি-  ‘অন্য কিছু না ভেবে তুমি আগে সেঞ্চুরিটা কর। এটা তোমাকে বাড়তি অনুপ্রেরণা দেবে, আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।’

 

শুরুতে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি

ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফুলঝুরি ছোটানোর পর সবার দৃষ্টিতে আসেন লারা। ১৯৯০ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের হয়ে। সেবার অভিষেকে পাকিস্তানের শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ভালো করতে পারেননি লারা। প্রথম ইনিংসে করেন ৪৪ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫। সেই সিরিজেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতেও অভিষেক হয় লারার। ভালো করতে পারেননি অভিষেক ওয়ানডেতেও। মাত্র ১১ রান করে ওয়াকার ইউনিসের বলে আউট হয়েছিলেন তিনি। শুরুর কয়েকটা বছর সেভাবে সাফল্য পাননি তিনি। লারা নিজেকে পুরোপুরিভাবে মেলে ধরেন ১৯৯২-৯৩ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে। তৃতীয় টেস্টের আগে সিরিজের ১-০-তে পিছিয়ে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রেইগ ম্যাকডরমেট, মার্ভ হিউজ, শেন ওয়ার্নদের মতো বোলারদের সামনে ২৭৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলেন লারা। টেস্টে এটাই লারার প্রথম সেঞ্চুরি। পরের বছর আরও বিস্ফোরক হয়ে ওঠেন এ ক্রিকেটার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৭৫ রানের একটা ইনিংস খেলে স্যার গ্যারিফিল্ড সোবার্সের ২৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেন তিনি। এরপর কাউন্টি ক্রিকেটে ইয়র্কশায়ারের হয়ে ৭ ইনিংসের ৬টিতেই সেঞ্চুরি করেন এ বরপুত্র। যা আজও বিশ্বরেকর্ড হয়ে আছে। তিনি এখানেই খেলেন ৪২৭ বলে ৫০১ রানের বিরল এক ইনিংস।

 

ব্রায়ান লারার যত রেকর্ড

লারার অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরি সিডনিতে। ইনিংসটিকে তিনি টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ২৭৭ পর্যন্ত। অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরিতে সবচেয়ে বেশি রান করার তালিকায় চতুর্থ স্থানে আছে লারার এ ইনিংসটি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৮ ইনিংসে ৭ সেঞ্চুরি পাওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান লারা। শুরুটা হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত ৩৭৫ দিয়ে, আর শেষ হয়েছিল অপরাজিত ৫০১ রানের ইনিংস দিয়ে।

ম্যাথিউ হেইডেনের ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর ২০০৪ সালে আবারও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪০০ রানের ইনিংস খেলে হারানো রেকর্ড পুনরুদ্ধার করেন লারা। এ অমর ইনিংসটির মধ্য দিয়ে তিনি দুটি ৩৫০+ রানের ইনিংস খেলা একমাত্র ব্যাটসম্যান হয়ে যান।

এ ছাড়া ক্যারিয়ারে দুটি কোয়াডরুপল সেঞ্চুরি পাওয়া দ্বিতীয় ব্যাটসম্যানও হন লারা। আর দুটি রেকর্ডই নিজের বগলদাবা করেছেন এমন ব্যাটসম্যান কেবল লারাই। সর্বোচ্চ ইনিংসের বিশ্বরেকর্ড দুবার ভাঙা একমাত্র ব্যাটসম্যান লারা। একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে একই সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোর ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরের মালিক।

অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোরের মালিকও লারা (৪০০*)। এ ইনিংস দিয়েই পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন বছরে ১০০০ টেস্ট রান করার বিরল রেকর্ডের মালিক হন লারা। ইনিংস বিবেচনায় দ্রুততম ১০ ও ১১ হাজার রান করার রেকর্ড লারার। ১০ হাজার রানের রেকর্ডের ক্ষেত্রে টেন্ডুলকার সঙ্গী হিসেবে থাকলেও দ্রুততম ১১ হাজার রানের মালিক কেবলই লারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরি তার। ক্যারিয়ারে মোট ৯টি টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও কুমার সাঙ্গাকারারই তার চেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরি আছে। টেস্টে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি করা দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান তিনি। সব মিলিয়ে টেস্ট ইতিহাসে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি আছে মোট ৪ জন ব্যাটসম্যানেরÑ স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, ব্রায়ান লারা, বীরেন্দর শেবাগ ও ক্রিস গেইল। সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে অন্তত একটি করে টেস্ট সেঞ্চুরি আছে লারার। ২০০৫ সালে কেনসিংটন ওভালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে এ চক্র পূরণ করেন তিনি। এক সেশনে সেঞ্চুরি করা ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান ছিলেন লারা। লারার ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অধ্যায়গুলোর একটি ২০০১-০২ এর শ্রীলঙ্কা সফর। সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হোয়াইটওয়াশ হলেও শ্রীলঙ্কান বোলারদের বিপক্ষে বলতে গেলে একাই লড়ে গেছেন লারা। ৩ ম্যাচের ৬ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি ও এক ফিফটিসহ রান করেছেন মোট ৬৮৮, সর্বোচ্চ স্কোর ২২১। ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এটি। ৩ ম্যাচের ৬ ইনিংসে ৭৫২ রান নিয়ে সবার ওপরে আছেন ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ। ১৯৯০ সালে ভারতের বিপক্ষে এ রেকর্ড করেছিলেন তিনি। সিরিজে লারার গড় ছিল ১১৪.৬৭। ওই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট রানের ৪২% রান একাই করেছিলেন লারা। ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের জন্য যা বিশ্বরেকর্ড।

একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ডাবল সেঞ্চুরির বিরল রেকর্ডের মালিক লারা। টেস্টে পরাজিত দলের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড লারার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই সিরিজেই কলম্বো টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩৫১ রান করেছিলেন লারা (২২১+১৩০), কিন্তু ম্যাচটা শ্রীলঙ্কাই জিতেছিল ১০ উইকেটে। এই কলম্বো টেস্টেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট রানের ৫৩.৮৩% রান একাই করেছিলেন লারা। ৬৫২ রানের মধ্যে ৩৫১ রানই তার। যা কিনা বিশ্বরেকর্ড। ১৬৪ ক্যাচ নিয়ে উইকেটকিপার ছাড়া আউটফিল্ডারদের মধ্যে অষ্টম সর্বোচ্চ ক্যাচের রেকর্ড লারার। ২১০ ক্যাচ নিয়ে সবার ওপরে আছেন রাহুল দ্রাবিড়। লারার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমনই রেকর্ডের ছড়াছড়ি।

 

লারানির্ভর ওয়েস্ট ইন্ডিজ

ব্রায়ান লারা যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পুরোপুরি তার ওপর নির্ভর ছিল। একজন ব্যাটসম্যান একটা দলের কতটা সমার্থক হতে পারে তা বুঝতে হলে ব্রায়ান লারার যুগকে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। ব্রায়ান লারার সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট রানের ২০% তার করা। এ ক্ষেত্রে তার ওপরে আছেন মাত্র দুজন। একজন ব্র্যাডম্যান (২৩%)  এবং অন্যজন হলেন ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান খ্যাত জর্জ হেডলি (২১%)। ব্র্যাডম্যান আর জর্জ হেডলি ছিলেন ব্যতিক্রম। তারা এতটাই রান করতেন যে দলের বাকি ব্যাটসম্যানরা হয়তো সুযোগই পেতেন না। কিন্তু ব্রায়ান লারার সময়ে উইন্ডিজ দলে সত্যিকার অর্থেই ব্যাটসম্যান আর বোলারের আকাল পড়ে গিয়েছিল। ব্রায়ান লারা একাই পুরো দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দলের একমাত্র বিজ্ঞাপন যেন ব্রায়ান লারাই। প্রতিপক্ষ দলও তাই ব্রায়ান লারাকে কেন্দ্র করেই তাদের পরিকল্পনা করত। কিন্তু ব্রায়ান লারা এমনই এক ব্যাটসম্যান যে নিজের ফোকাস থেকে কখনো সরে যাননি। দুর্দান্ত রান করে গেছেন ক্যারিয়ারের সব সময়ই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ টেস্টের একটা সিরিজে দলের মোট রানের ৪২% ছিল তার করা, যা কিনা একটি রেকর্ড। ৩ টেস্টে রান করেছিলেন ৬৮৮ রান। সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে মুরালিধরন আনপ্লেয়েবল হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম টেস্টে নিলেন ১১ উইকেট, দ্বিতীয় টেস্টে ১০ উইকেট। উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা তার বল বুঝতেই পারছিলেন না। কিন্তু এর মাঝেও ব্যতিক্রম ছিলেন ব্রায়ান লারা। সেই সিরিজের একটা ঘটনা। রামনরেশ সারওয়ান কিছুতেই মুরালির দুসরা বুঝতে পারছিলেন না। কীভাবে দুসরা পিক করতে হবে সেটা ব্রায়ান লারা বারবার বুঝিয়ে বলার পরেও কোনো কাজ হচ্ছিল না। পরের ওভারে ছক্কা মারার পর সারওয়ানকে ডেকে বললেন, ‘ওটা ছিল দুসরা’। সেই সিরিজে মুরালির বিপক্ষে লারার রুদ্রমূর্তি দেখে হোয়াটমোর বলেছিলেন, ‘ও যেভাবে স্পিনের বিপক্ষে ড্রাইভ করছে, সুইপ করছে, এক কথায় তা অবিশ্বাস্য। সাপের মতো স্পিনিং ট্র্যাকে টার্নের বিপক্ষে অমন শট খেলতে আমি আর কাউকে দেখিনি।’ 

 

টেন্ডুলকার না লারা কে সেরা?

শচীন টেন্ডুলকার নাকি ব্রায়ান লারা- কে সেরা? প্রশ্নটা নিয়ে বিতর্ক হয় প্রায়শই। টেন্ডুলকার ক্রিকেটের প্রায় সব রেকর্ডই নিজের করে নিয়েছেন। অন্যজন দ্বীপরাষ্ট্র থেকে উঠে এসে সব আলো কেড়েছেন গোটা বিশ্বের। মাঝে মাঝেই এ দুজনের মধ্যে কে সেরা তা নিয়ে শুরু হয় ক্রিকেট বোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। দুজনের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কেউ কারোর চেয়ে কিন্তু কম যান না। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ অবশ্য এগিয়ে রাখেননি কাউকেই। দুই ব্যাটিং কিংবদন্তির বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে রেখেছেন একই সমতলে- ‘আমি তাদের মধ্যে তুলনাকে অপছন্দ করি। কারণ এটা অপ্রয়োাজনীয় বিতর্কের জন্ম দেয়। দুজন ভিন্ন ভিন্ন দল থেকে খেলেছে। তাদের ওপর চাপও ভিন্ন ছিল। আমি তাদের একই স্থানে রাখতে চাই।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াহ বলেন, ‘এক কোটি ৩০ লাখ লোকের চাপ মাথায় নিয়ে খেলতে হয় শচীনকে। অন্যদিকে একটা দুর্বল দলের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন লারা। খেলোয়াড় হিসেবে দুজনই অবিশ্বাস্য।’ রান বা সেঞ্চুরির আলোকে অবশ্য টেন্ডুলকারের চেয়ে পিছিয়ে লারা। ক্রিকেটের এই বরপুত্রের টেস্টে রান সংখ্যা ১১ হাজার ৯৫৩, ওয়ানডেতে ১০ হাজার ৪০৫। টেস্ট ও ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি যথাক্রমে ৩৪ ও ১৯টি। একটা দিক থেকে অবশ্য এগিয়ে লারা। টেস্টের এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪০০ রানের ইনিংসটা তার। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মহাকাব্যিক ইনিংসটি খেলেছিলেন লারা। অবশ্য সার্বিক দিক বিবেচনায় টেন্ডুলকার ও লারাকে ‘সমান’ বলে মনে করছেন স্টিভ ওয়াহ। তবে রিকি পন্টিংয়ের চোখে এগিয়ে লারাই।

 

২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে লারার ভাবনা

ক্রিকেটের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভাসছে বিশ্ব। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মর্যাদাপূর্ণ আসরে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সম্ভাবনা নিয়ে চলছে আলোচনা। রেকর্ডের বরপুত্র হিসেবে খ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা বিশ্বকাপ নিয়ে তার ভাবনা তুলে ধরেছেন। তিনি ফেভারিটের তকমা দিয়েছেন ইংল্যান্ড আর ভারতকে। দল দুটিকে নিশ্চিত সেমিফাইনালের টিকিটই দিয়ে দিলেন। তার মতে, এবারের উইন্ডিজ দল বিশ্বকাপে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। তবে আফগানিস্তানকে নিয়ে ভীষণ শঙ্কায় আছেন লারা। তিনি মনে করেন এ দুটি দল বেশ বিপজ্জনক। আর এদের কাছে হেরে বসলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সব কিছুই শেষ অর্থাৎ সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্নই ভেস্তে যাবে। ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রায়ান লারা বলেন, ‘ইংল্যান্ড আর ভারতকে নিশ্চিত সেমিফাইনালে দেখছি। তবে নিজ দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও সেমিফাইনালে দেখতে চাচ্ছি। এ জন্য উইন্ডিজদের ধারাবাহিক ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। আগেও দেখেছি শক্তিধর ইংল্যান্ড আর ভারতকে হারাতে সক্ষম আমরা কিন্তু তার পরেই আবার দেখেছি তারা বাংলাদেশের কাছে হেরে বসেছে।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ লিজেন্ড লারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রান করেছেন। লারা আরও বলেন, ‘ইংল্যান্ডের কন্ডিশন ভিন্নধর্মী। সহসাই রূপ পাল্টে ফেলে। এটা অবশ্যই মজার ব্যাপার। যখন আমি ইংল্যান্ডে খেলেছি সেখানে আমি দারুণ উপভোগ করেছি। তবে ইংলিশ কন্ডিশনে ভালো করতে হলে প্রতিটি দলকে নিজেদের সামর্থ্য, সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি কাজে লাগাতে হবে, তার ওপরই তাদের সাফল্য নির্ভর করছে। ইংল্যান্ডের পরিবেশ এমন যে, আপনি মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে ব্যাটিং করছেন, তখন হয়তো পিচটি আর্দ্র ছিল, এর ঘণ্টা দুই পরেই দেখবেন পিচটি শুষ্ক হয়ে গেছে। আপনি যতদ্রুত মানিয়ে নিতে পারবেন তখনই আপনি সফল হতে পারবেন।’ সাধারণত প্রত্যেক দলের প্রথম এক বা দুই ম্যাচ খেলার পর আমি বাছাই করি সেমিফাইনালিস্ট। তবে এবার আমি আগেভাগেই বলে দিলাম নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ড আর ভারত। এবার তারা দুর্দান্ত। আমি বিশ্বাস করি ইংল্যান্ড আর ভারত এ দুই দল নিঃসন্দেহে সেমিফাইনাল খেলবে।’

সর্বশেষ খবর