১৯৬৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই গাদ্দাফি পশ্চিমা দুনিয়ার এক সোচ্চার সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। সামরিক পোশাক ছেড়ে তিনি তার আরব পোশাক পরা শুরু করেন। জাতীয়তাবাদী চেতনায় আরব দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তার আকর্ষণীয় পোশাক, জ্বালাময়ী ভাষণ এবং মহিলা দেহরক্ষী তাকে বিশ্বমঞ্চে এক বিশেষ নেতা হিসেবে পরিচিত করে তোলে। ৪২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের রক্তিম চক্ষু উপেক্ষা করে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেছেন দোর্দ- প্রতাপে। এই শাসকের জীবনের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন- সাইফ ইমন
১৯৪২ সালে লিবিয়ার উপকূলীয় শহর সির্তের অদূরে এক গ্রামের দরিদ্র বেদুইন যাযাবর পরিবারের তাঁবুতে জন্ম নেন গাদ্দাফি। পুরো নাম মুয়াম্মার আবু মিনিয়ার আল গাদ্দাফি। বেদুইন সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই বড় হতে থাকেন তিনি। যার ছাপ পরবর্তী সময়ও তার মাঝে বিদ্যমান ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি অধিকাংশ সময় তাঁবুতে কাটাতেন। শহরের চেয়ে মরুভূমিকে বেশি পছন্দ করতেন। ১৯৬৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর যখন তৎকালীন লিবিয়ার রাজা ইদ্রিস আল সেনুসি তার শারীরিক অসুস্থার জন্য তুরস্কে সফরে গিয়েছিলেন তখন মাত্র ২৭ বছর বয়সী কর্নেল মোয়াম্মার আল গাদ্দাফি তার অল্প কয়েকজন সামরিক অফিসারের সহায়তায় রাজধানী ত্রিপোলিতে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করেন। গাদ্দাফির এ ক্ষমতা গ্রহণে তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন গাদ্দাফির ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের। এর অল্প পরই তার এবং তার অল্প বয়সী সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সিনিয়র অফিসারদের এবং কিছু প্রভাবশালী বেসামরিক নাগরিকের সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর ফলে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে শাসনব্যবস্থা। এসব সমস্যা নিরসন করে ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে গাদ্দাফি একজন সফল শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তবে পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে গাদ্দাফিকে উপস্থাপন করছে তাতে মনে হবে যে, গাদ্দাফি ছিলেন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক স্বৈরশাসক। তিনি দেশটিকে একেবারে লুটেপুটে খেয়ে ছারখার করেছেন। কিন্তু আসলে কি তাই! অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করছেন গাদ্দফি বিষয়ে। ভয়ঙ্কর এক স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত হলেও তিনি লিবিয়াকে উন্নত করেছিলেন বলে দাবি তাদের। মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি যখন লিবিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করেন তখন লিবীয়রা ছিল পুরোদস্তুর যাযাবর জাতি। তাদের আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে তেমন ধারণাই ছিল না। দেশের সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য নানাভাবে ছিল পশ্চিমাদের দখলে। বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও জনগণ ছিল দরিদ্র। ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে সম্পদের পাহাড় গড়লেও গাদ্দাফি তার চার দশকের বেশি শাসনামলে দেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। দেশের মানুষের জন্য এনেছেন বিপুল সুযোগ-সুবিধা ও উন্নয়ন। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা অন্য কারও কাছে লিবিয়ার এক পয়সাও দেনা নেই। উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে সাক্ষর দেশ লিবিয়া। দেশটির শিক্ষিত জনসংখ্যার ৮০% লোক পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। একটি আধাকেজি রুটির দাম লিবিয়ায় পনেরো ইউএস সেন্ট। লিবীয়দের জন্য ঋণের সুদের হার শূন্য শতাংশ অর্থাৎ কোনো সুদ নেই। আরকেটি বড় দিক হচ্ছে দেশটিতে কোনো দরিদ্র লোক নেই। লিবিয়া একটি ভিক্ষুকহীন দেশ। দেশটিতে ১০০% বেকারের বেকারভাতা নিশ্চিত করেছিলেন গাদ্দাফি। বিয়ের পর নবদম্পতির জন্য বিনামূল্যে ফ্ল্যাট বা বাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। পৃথিবীর যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ তৈরি করেছিলেন। সে জন্য মাসে ২,৫০০ ইউএস ডলার বৃত্তির সঙ্গে গাড়ি ও আবাসনভাতা নিশ্চিত করেছিলেন। ন্যাটোর বোমাবর্ষণের আগে পর্যন্ত শূন্য শতাংশ ছিল গৃহহীন নাগরিক। উৎপাদন মূল্যে গাড়ি কেনার সুযোগ পেতেন নাগরিকরা। ছাত্ররা যে বিষয়ে পড়াশোনা করে সে বিষয়ে পড়াশোনা করে চাকরিরতরা গড়ে যে বেতন পেত সে পরিমাণ টাকা তাদের দেওয়া হতো। প্রতিটি লিবীয়র জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করেছিলেন। যারা ‘স্বৈরশাসক’ আখ্যা দিয়ে গাদ্দাফিকে নিজের দেশের মাটিতে হত্যা করেছে, তারা কি পারছে লিবিয়ার এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে- এ বিষয়ে ভবিষ্যৎ কথা বলবে।
রাজনৈতিক উত্থান
গাদ্দাফি যখন সেনাবাহিনীতে চাকরিরত তখন লিবিয়ায় পশ্চিমাপন্থি সেনুসি রাজতন্ত্রের শাসন চলছিল। তৎকালীন লিবিয়ার শাসক ছিল রাজা ইদ্রিস। ১৯৫১ সালে ইতালির কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই লিবিয়া শাসন করে আসছিলেন রাজা ইদ্রিস আল সেনুসি। কিন্তু পশ্চিমাদের হাতের পুতুল বলে রাজা ইদ্রিসের দুর্নাম ছিল। গাদ্দাফি চেয়েছিলেন মুক্তি। পশ্চিমাদের দাসত্ব থেকে দেশকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এর জন্য কাজও করে যাচ্ছিলেন। পশ্চিমাপন্থি এই সেনুসি রাজতন্ত্রের পতনের জন্য গোপনে এক সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন গাদ্দাফি। ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীর উচ্চ প্রশিক্ষণ লাভ করার জন্য তিনি ব্রিটেনে যান। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে গাদ্দাফি কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের তালিকাভুক্ত হন এবং ১৯৬৬ সালে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই তিনি রাজা ইদ্রিসকে উৎখাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সেই সঙ্গে চলতে থাকে নিজের গুপ্ত সংগঠনের কাজ। এ সময় ১৯৬৯ সালের দিকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ইদ্রিস। ওই বছরের পয়লা সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য তুরস্ক সফরে যান ইদ্রিস। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন গাদ্দাফি। ১৯৬৯ সালে গাদ্দাফি তার মিত্রদের নিয়ে গড়া গোপন বাহিনী নিয়ে রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। রাজা ইদ্রিসের প্রশাসনকে উৎখাত করে লিবিয়ার শাসনক্ষমতায় আরোহণ করেন গাদ্দাফি। পরবর্তীতে রাজা ইদ্রিসকে মিসরে নির্বাসিত করে দেওয়া হয় এবং তিনি ১৯৮৩ সালে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন লিবিয়ার
গাদ্দাফি যখন স্কুলে পড়তেন সে সময় লিবিয়া ছিল ইউরোপের উপনিবেশ। গাদ্দাফি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ইউরোপিয়ানদের বিতাড়িত করে একটি স্বাধীন লিবিয়ার। সাবাহর স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন মিসরের। এই শিক্ষকদের মাধ্যমে গাদ্দাফি মিসরের খবরের কাগজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক আর্টিকেল, রেডিও অনুষ্ঠান পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। মিসরের বিপ্লবী নেতা কর্নেল জামাল আবদুল নাসেরের লেখা বই ‘বিপ্লবের দর্শন’ পড়ে গাদ্দাফি নাসেরভক্ত হয়ে যান। তার মাঝে গড়ে উঠতে থাকে রাজনৈতিক চেতনা। নাসেরের উপনেবিশবাদ ও ইসরায়েলবিরোধী মতবাদের পাশাপাশি আরব জাতীয়তাবাদের ধারণা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন গাদ্দাফি। তাকে গুরুর মতো সম্মান দিতেন। এমনকি নিজে কর্নেলের পরের ধাপে নিজের পদবি নেন, কারণ নাসের ছিলেন কর্নেল পদবির। নিজের গুরুর চেয়ে ওপরের পদবিতে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি! লিবিয়ায় সাধারণত কারও মূর্তি তৈরি করা হয় না। কিন্তু বেনগাজি শহরে রয়েছে কর্নেল নাসেরের একটি পাথরের মূর্তি। কর্নেল নাসেরের সঙ্গে স্কুলে থাকাকালীনই গাদ্দাফি তৎকালীন উপনিবেশবাদী অত্যাচারী রাজতন্ত্রকে উৎখাতের জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ফলে স্কুল থেকে বহিষ্কারও হয়েছিলেন। সাবাহ থেকে বহিষ্কার হয়ে তিনি মিসার্তা চলে আসেন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর বেনগাজির তৎকালীন ইউনিভার্সিটি অব লিবিয়ায় ভর্তি হন কিন্তু পড়ালেখা শেষ না করেই ১৯৬৩ সালে বেনগাজির সামরিক পরিষদে যোগদান করেছিলেন।
মৃত্যুর আগে অসিয়তনামা
২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ছোঁয়া লিবিয়ায় লাগার পর গাদ্দাফির নিজের কিছু ভুল ও অদূরদর্শিতার কারণে, আরব রাষ্ট্রগুলোর বিশ্বাসঘাতকতায় এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ষড়যন্ত্রে লিবিয়ার বিপ্লব রূপ নেয় সহিংস গৃহযুদ্ধে। দীর্ঘ আট মাসের এ গৃহযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে শত্রুবেষ্টিত এলাকা থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় ন্যাটোর বিমান হামলা এবং বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হন গাদ্দাফি। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবর্ণনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় প্রতাপশালী এই রাষ্ট্রনায়ককে। মৃত্যুর আগে গাদ্দাফি একটি অসিয়তনামা রেখে যান। আরবিতে লেখা অসিয়তনামার বঙ্গানুবাদ এরকম :
‘এটা আমার অসিয়তনামা। আমি মুয়াম্মার বিন মোহাম্মদ বিন আবদুস সালাম বিন হুমায়ুদ বিন আবু মানিয়ার বিন হুমায়ুদ বিন নায়েল আল ফুহসি গাদ্দাফি, শপথ করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর নবী। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি মুসলিম হিসেবেই মরব। নিহত হলে, আমি চাই আমাকে যেন মুসলিম রীতি অনুযায়ী সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর সময় যে কাপড়ে থাকব সে কাপড়েই এবং শরীর না ধুয়েই সির্তের গোরস্থানে যেন সমাহিত করা হয় আমার পরিবার ও আত্মীয়দের পাশে। আমি চাই, আমার মৃত্যুর পর আমার পরিবার বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সঙ্গে যেন ভালো ব্যবহার করা হয়। লিবিয়ার জনগণের উচিত তাদের আত্মপরিচয়, অর্জন, ইতিহাস এবং তাদের সম্মানিত পূর্ব পুরুষ ও বীরদের ভাবমূর্তি রক্ষা করা। লিবিয়ার জনগণের উচিত হবে না, স্বাধীন ও শ্রেষ্ঠ মানুষের ত্যাগের ইতিহাস বিসর্জন দেওয়া।
আমার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান, তারা যেন সবসময়ের জন্য আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিশ্বের সব স্বাধীন মানুষকে জানিয়ে দাও, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুস্থির জীবনের জন্য আমরা যথেষ্ট দরকষাকষি করেছি এবং সামর্থ্য খাটিয়েছি। এর বিনিময়ে আমাদের অনেক কিছু দিতে চাওয়া হয়েছিল কিন্তু এই সংঘাতের সময় দায়িত্ব ও সম্মানের রক্ষাকারী হিসেবে দাঁড়ানোকেই আমরা বেছে নিয়েছি। যদি আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিজয়ী নাও হই তবু আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই শিক্ষা দিয়ে যেতে পারব, জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব বেছে নেওয়া হলো সম্মানের আর এটা বিক্রি করে দেওয়া মানে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। যে দায়িত্ব বেছে নিলে ইতিহাস চিরকাল মনে রাখবে।’
গাদ্দাফি যেদিন ইন্তেকাল করেন এর পরের দিন মাহদি হাসান আদিব হিফজ সমাপনী পাগড়ি পান।
গাদ্দাফির শেষ দিনগুলো
৪২ বছর শাসন করে লিবিয়ার অবস্থা বদলে দিয়েছিলেন গাদ্দাফি। তার শাসনামলে লিবিয়ায় বাকস্বাধীনতা না থাকলেও সুখ-সমৃদ্ধির কমতি ছিল না। যদিও বাকস্বাধীনতাহীন সুখ লিবিয়ার মানুষ শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়নি। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে লিবিয়ার মানুষ গাদ্দাফিকে নিঃশেষ করেছে, তা পূরণ হয়নি আজো। গাদ্দাফি-পরবর্তী গত সাত বছর লিবিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শঙ্কার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়েছে। যে আরব বসন্ত গণতন্ত্রের বার্তা নিয়ে এসেছিল তা এখনো লিবিয়ার মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি। দিনশেষে কিছু প্রশ্ন থেকেই গেল। লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত হন ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর। গাদ্দাফিকে হত্যা করার সময়কার বেশকিছু ভিডিও দৃশ্য দেখে ধারণা করা যাচ্ছিল মৃত্যুর আগে নির্যাতন করা হয়েছে তাকে, বিদ্রোহীরা দেশের সাবেক এই রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন, এটা বোঝা গেছে মোবাইল ক্যামেরায় তোলা কিছু ভিডিও দেখেও। গাদ্দাফির শেষ দিনগুলো ছিল ভয়ঙ্কর। একসময়ের প্রতাপশালী এই নেতা সব হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার মধ্যে কোনোরকম ভাবাবেগ দেখতে পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেন তার সঙ্গে থাকা সঙ্গীরা। চারদিক থেকে বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ শহরে এবং আকাশ থেকে ন্যাটোর বিরামহীন বোমাবর্ষণের মধ্যেও তিনি মানসিকভাবে শক্ত ছিলেন অনেক। এরকম অনেক তথ্যই বিভিন্ন সময় পত্রিকার পাতায় উঠে এসেছে গ্রেফতার হওয়া গাদ্দাফির কাছের মানুষদের জবানবন্দিতে, যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গাদ্দাফির সঙ্গে ছিলেন। আগস্ট মাস পর্যন্ত গাদ্দাফি লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতেই ছিলেন। আগস্টের ২০ তারিখে বিদ্রোহীদের হাতে ত্রিপোলির পতনের প্রাক্কালে তিনি সপরিবারে ত্রিপোলি ত্যাগ করেন। তবে তাদের সবার গন্তব্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ত্রিপোলি থেকে বেরিয়ে গাদ্দাফি রওনা হয়েছিলেন ৪৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উপকূলীয় শহর সির্তে। সঙ্গে ছিলেন তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার এবং কয়েকজন বডিগার্ড। গাদ্দাফি সির্তে গিয়ে প্রথমে শহরের কেন্দ্রে কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে বিদ্রোহীরা সির্ত আক্রমণ শুরু করে। মর্টার এবং গ্র্যাড মিশাইলগুলো গাদ্দাফির বাসস্থানের আশপাশে এসে পড়তে শুরু করে। তখন উপায় না পেয়ে গাদ্দাফি ও তার সঙ্গীরা ধীরে ধীরে শহরের কেন্দ্রস্থল ছেড়ে ভিতরের দিকে ‘রক্বম এতনিন’ তথা ডিস্ট্রিক্ট নাম্বার টুতে অবস্থান নিতে বাধ্য হন। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সির্ত পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন একটি শহরে পরিণত হয়। বিদ্রোহীরা চতুর্দিক থেকে ধীরে ধীরে শহরটিকে ঘিরে ফেলতে থাকে। গাদ্দাফি এবং তার সঙ্গীরা ডিস্ট্রিক্ট টু-এর পুরনো আমলে তৈরি একতলা বাড়িগুলোতেই আশ্রয় নিতে থাকেন। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার কারণে তাদের তখন যথেষ্ট খাবারও ছিল না। তারা এলাকার মানুষের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর খাবার সংগ্রহ করে সেগুলো খেয়েই জীবন ধারণ করতেন। অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে শুরু করলে গাদ্দাফি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। একপর্যায়ে এক কালভার্টের ভিতরেও অবস্থান করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
ঘিরে রাখত নারী বডিগার্ডরা
গাদ্দাফি নারীদের প্রতি আসক্ত ছিলেন। এ নিয়ে তিনি ব্যপক তিরস্কারের শিকার হন। এদিকে তার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল একদল নারী বডিগার্ড। বিশ্বের আর কোনো নেতার এরকম নারী বডিগার্ড ছিল বলে শোনা যায় না। তার বডিগার্ডরা ছিল সুপ্রশিক্ষিত। গাদ্দাফির সাবেক নিরাপত্তাপ্রধান মানসুর দাউ দাবি করেন, নিজের ভোগবিলাসের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে নারী খুঁজে আনতে একটি আলাদা সরকারি বিভাগ খুলেছিলেন গাদ্দাফি। দেশটির সাবেক এই স্বৈরশাসককে নিয়ে মানসুরের বিভিন্ন মূল্যায়ন প্রকাশ করে ডেইলি মেইল’। ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা আইএনএস জানায়, কয়েক দশকের শাসনামলে শত শত নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছেন গাদ্দাফি। ত্রিপোলির প্রাসাদে অনেক নারীকে আটকে রাখতেন তিনি। আর গাদ্দাফির নানা খেয়ালি ইচ্ছা পূরণে সাহায্যকারী কর্মকর্তারা দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে যেতেন। এক কথায় নারীদের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত করেছিলেন গাদ্দাফি।
লিবিয়ার সাবেক এই শাসকের মৃত্যুর পর তার নানা কুকীর্তির খবর বেরিয়ে আসতে থাকে। তরুণীদের গোপন কক্ষে আটকে রেখে তাদের সঙ্গে যৌনদাসীর মতো ব্যবহার করতেন তিনি। বিবিসির এক প্রামাণ্যচিত্রে পিলে চমকানো এরকম আরও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। প্রামাণ্যচিত্রটিতে গাদ্দাফির ব্যবহৃত একটি গোপন কক্ষ দেখানো হয়েছে। ওই কক্ষে তরুণীদের আটকে রাখা হতো। গাদ্দাফি তাদের নিয়মিত ধর্ষণ করতেন। তরুণীদের তিনি জোর করে পর্নো সিনেমা দেখতে বাধ্য করতেন। দুই শয্যার চেয়ে একটু বড় ওই কক্ষ। এর লাগোয়া আরেকটি কক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তরুণীরা যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত কিনা, সেখানে তা পরীক্ষা করা হতো। পরে ইতিবাচক ফল পেলে সেই তরুণীদের পাঠানো হতো গাদ্দাফির প্রমোদকক্ষে। গাদ্দাফির নির্যাতনের শিকার তরুণীদের মধ্যে কেউ কখনো কৌশলে পালাতে সক্ষম হলেও পরিবারের সদস্যরা তাকে পরিত্যাগ করত। আর যারা পালাতে পারত না, তাদের অনেককেই বরণ করতে হতো নির্মম মৃত্যু। এদিকে গাদ্দাফি স্কুলছাত্রীদের অপহরণ করে এনে যৌনদাসী হিসেবে নিজের আস্তানায় রাখতেন বলে তার ওপর প্রকাশিত একটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। লিবিয়ার সাবেক এই লৌহমানবের নির্যাতনের শিকার উপকূলীয় সির্তে শহরের স্কুলছাত্রী সোরায়া (ছদ্মনাম)। ১৫ বছর বয়সে তাকে অপহরণ করে ত্রিপোলির বাইরে একটি দুর্গে পাঁচ বছর আটক রাখা হয়। তিনি বলেছেন, তাকে প্রায় নিয়মিতভাবে ধর্ষণ, মারধর ও অত্যাচার করা হতো। তার মতো অন্য মেয়ে ও ছেলেরাও গাদ্দাফির নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ‘গাদ্দাফির হারেম : এক তরুণ নারী ও লিবিয়ার ক্ষমতার অপব্যবহারের গল্প’ (গাদ্দাফি’স হারেম : দ্য স্টোরি অব এ ইয়াং উইমেন অ্যান্ড দ্য অ্যাবিউজ অব পাওয়ার ইন লিবিয়া) নামের একটি বইয়ে উঠে এসেছে গাদ্দাফির যৌনলোলুপ চরিত্র! ফরাসি লা মঁদের সাংবাদিক অ্যানিক কোজেন দাবি করেন, শুধু মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও গাদ্দাফির নির্লজ্জ আচরণ থেকে রেহাই পাননি। এমনকি তার দেশে সফররত তারকা, সাংবাদিক ও বিদেশি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদেরও ‘প্রস্তাব’ দিতেন গাদ্দাফি। ২০১২ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নিহত সাংবাদিক ম্যারি কোলভিনকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।