রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ইতিহাসের আয়নায় আল-আকসা

সাইফ ইমন

ইতিহাসের আয়নায় আল-আকসা

ইসলামের অন্যতম পবিত্র মসজিদ বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদ আল-আকসা। ইসরায়েলের চোখে এটি টেম্পল অব মাউন্ট। অসংখ্য নবী-রসুলের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক জেরুজালেম শহরে এই মসজিদ আল-আকসা অবস্থিত। বর্তমানে ইহুদিরা দখল করে রেখেছে এই পবিত্র মসজিদ। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আল-আকসা চত্বরে আজও অসংখ্য নবী-রসুলের সমাধি বিদ্যমান।  মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেকেরই অজানা।  ইতিহাসের আয়না থেকে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা নিয়ে আজকের রকমারি...

 

মুসলমানদের প্রথম কিবলা

৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ আবারও মুসলমানদের অধীনে আসে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ মসজিদটি কিছু দিনের জন্য মুসলমানদের কিবলা হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। খলিফা উমর (রা.) বর্তমান মসজিদের  স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন...

 

ইসলাম ধর্মের নবী হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর নাতি বনি ইসরাইলের প্রথম নবী হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ঐতিহাসিক শহর জেরুজালেমে মসজিদ আল-আকসা নির্মাণ করেন। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী হজরত সুলায়মান (আ.) জিন জাতির মাধ্যমে এ পবিত্র মসজিদ পুনর্নির্মাণ করেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি মুসলমানদের অধীনে আসে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ মসজিদটি মুসলমানদের কিবলা হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। খলিফা উমর (রা.) বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্র্মিত ও সম্প্রসারিত হয়।

এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্র্নির্মাণ করেন। পরে তাঁর উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুনর্র্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলী আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে। বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করার পর মসজিদটিকে একটি প্রাসাদ এবং একই প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাত আস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুজালেম জয় করার পর মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি কর্তৃক বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হওয়ার পর জেরুজালেমে দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দীব্যাপী মুসলমানরা খ্রিস্টানদের অত্যাচার থেকে মুক্ত ছিল। নানা সময়ে আল-আকসার নানাবিধ সংস্কার করা হয়।

 

বর্তমানে ইসরায়েলের দখলে

বর্তমানে ইহুদিবাদী ইসরায়েল ঐতিহাসিক মসজিদটি দখল করে রেখেছে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়। সেই থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস বা আল-আকসা তাদের দখলে রয়েছে। ১৯৬৯ সালে তারা একবার আল-আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগও করেছিল। বর্তমানে এ মসজিদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ইসরায়েলের মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসায় প্রবেশ ও নামাজ আদায় করতে পারে। আবার অনেক সময় বাধা দেওয়া হয়। এই বিধিনিষেধের মাত্রা সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়। কখনো শুধু জুমার নামাজের সময় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। গাজার অধিবাসীদের জন্য বিধিনিষেধ অনেক বেশি কঠোর। ইসরায়েল সরকারের দাবি, নিরাপত্তার কারণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ঐতিহাসিকভাবেই এটি মুসলমানদের পবিত্র স্থান।  ১১টি গেট দিয়ে এখানে ঢোকা যায়। ১০টি গেট মুসলিমদের জন্য আর একটি অমুসলিমদের জন্য।  প্রত্যেক দ্বারে রয়েছে ইসরায়েলি পুলিশের গার্ড পোস্ট।

 

এখান থেকেই মেরাজ

নবী করিম (সা.) মিরাজ গমনের সময় আল-আকসায় ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন...

ইসলামে আল-আকসা মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের বিশ্বাস এটি পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ যা মসজিদুল হারামের পরে নির্মিত হয়।  কোরআনে মিরাজের ঘটনা উল্লেখ করার সময় এই স্থানের নাম নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগেই আল-আকসাকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান বলে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। তাদের এক প্রস্তাবনায় বলা হয়, জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের ওপর ইসরায়েলের কোনো অধিকার নেই, আল- আকসা মুসলমানদের পবিত্র স্থান। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও বিশ্বসমাজে সর্বজনবিদিত বিষয় বলেও ইউনেস্কো জানিয়েছে। মুসলিমদের কাছে আল-আকসা মসজিদ নামে পরিচিত এই স্থাপনাটি ইহুদিদের কাছে ‘টেম্পল অব মাউন্ট’ নামে পরিচিত। আল-আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস হচ্ছে ইসলামের প্রথম কেবলা এবং মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র স্থান। হজরত রসুলে করিম (সা.) মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববী ও বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি। বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকা বহু নবীর স্মৃতিবিজড়িত। এ পবিত্র নাম শুধু একটি স্থানের সঙ্গে জড়িত নয় বরং এ নাম সব মুসলমানের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ পবিত্র মসজিদ থেকেই হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) ঊর্ধ্বাকাশে তথা মেরাজে গমন করেছিলেন। নবী করিম (সা.) মিরাজ গমনের সময় আল- আকসায় অতীতের সব নবী-রসুলের জামাতে ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআনেও এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘সব মহিমা তাঁর যিনি তাঁর বান্দাকে এক রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন, যার চতুর্পার্শ্বকে আমি বরকতময় করেছি। (আর এই ভ্রমণ করানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে) যাতে আমি আমার নিদর্শন তাঁকে প্রদর্শন করি।’  (সুরা বনী ইসরাইল : ১)

 

নিউটনের আল-আকসা গবেষণা

স্যার আইজ্যাক নিউটনের বাইতুল মুকাদ্দাস বা আল-আকসা   গবেষণা নিয়ে পৃথিবীতে অনেক বিতর্ক রয়েছে।

আমরা নিউটনের আপেলের সঙ্গে যতটা পরিচিত ঠিক ততটাই অপরিচিত নিউটনের ধর্ম গবেষণার বিষয়ে। নিউটন আল-আকসা নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। তাঁর হাতে আঁকা ড্রইংও পাওয়া যায় আল-আকসা বিষয়ক। ১৭০৪ সালের এক পান্ডুলিপিতে নিউটন লিখে গেছেন, ২০৬০ সালের আগে কোনোমতেই পৃথিবী ধ্বংস হবে না! নিউটনের আল-আকসা গবেষণা নবী সুলাইমানের (আ.) মসজিদ বা সলোমনস টেম্পল গবেষণা নামেও খ্যাত। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, এখানে সুলাইমান (আ.) নির্মাণ সম্পন্ন করেন ফার্স্ট টেম্পল বা বাইতুল মুকাদ্দাস। আইজ্যাক নিউটন গবেষণা করেন সলোমনের এ টেম্পল বা বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে। আর এ জন্য হিব্রু ভাষা জানা অনেক জরুরি। তাই নিউটন হিব্রু ভাষা শিখেন। পরবর্তীতে তিনি হিব্রু থেকে নিজে সব অনুবাদ করেন। নিজের হাতে টেম্পল অব সলোমন বা বাইতুল মুকাদ্দাসের কাঠামোর মূল নকশা আঁকেন। ধর্ম নিয়ে নিউটনের রয়েছে আরও অনেক গবেষণা। তাই তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়েও অনেকের প্রশ্ন জাগে। অনেকে বলেন, তিনি আস্তিক ছিলেন আবার অনেকের দাবি তিনি নাস্তিক। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, তাঁর ধর্মবিশ্বাস মূলধারার নয়। তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাস কখনো উন্মুক্ত করেননি।

 

পুনরুদ্ধার

জেরুজালেম নগরীর দীর্ঘ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ নগরী অন্তত দুবার পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছিল। এই নগরী ২৩ বার অধিকৃত হয়। আর ৫২ বার আক্রমণ করা হয় আর উদ্ধার করা হয় ৪৪ বার! ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দিক থেকে এই নগরী বহু পরিবর্তনের সাক্ষী এবং এখনো নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে নগরীটি ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই। এর আগে ৬৩৮ সালে জেরুজালেম বিজয়ের পর উমর (রা.) নামাজ পড়েন এখানে। যেখানে হজরত রসুলে করিম (সা.) মেরাজের সময় নামাজ পড়েছিলেন বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করে থাকেন। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে, উমর (রা.) এই স্থানটিকে মসজিদ হিসেবে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। তবে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক বেদনাদায়ক দিন ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই। সেদিন কোনো কোনো মুসলিম শাসকের বেইমানির ফলে খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনী সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এর পরই ঘটতে থাকে হৃদয়বিদারক অসংখ্য ঘটনা। যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। এ খ্রিস্টানরা ১০৯৯ সালের ৭ জুন প্রথমে জেরুজালেমে অবস্থিত ‘বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদ আল-আকসা’ অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভিতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে। অতঃপর এ পবিত্র মসজিদ তারা তাদের উপাসনালয় গির্জায় পরিণত করে। ১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর  সমরাভিযানের মাধ্যমে মসজিদ আল-আকসাসহ পুরো ঐতিহাসিক জেরুজালেম নগরী আবারও মুসলমানদের অধিকারে আসে। ২ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীর বেশে  বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন।

 

প্রথম নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে

মসজিদুল আকসা অর্থ ‘দূরবর্তী মসজিদ’। মিরাজের রাতে হজরত রসুলে করিম (সা.) বোরাকে চড়ে মক্কা থেকে এখানে এসেছিলেন। অনেক বছর ধরে মসজিদুল আকসা বলতে পুরো এলাকাকে বোঝানো হতো এবং মসজিদকে আল-জামি আল-আকসা বলা হতো। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে বাদশাহ সলোমন বা সুলাইমান (আ.) নির্মাণ করেন এই ‘প্রথম মসজিদ’ বা বাইতুল মুকাদ্দাস নামে চিরচেনা মসজিদ আল-আকসা। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয় মসজিদ কাঠামোটি। পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবেলের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে নির্মিত হয় দ্বিতীয়বার এই মসজিদ সেই আগের জায়গায়ই। মুসলিমদের প্রথম কিবলা এই মসজিদ আল-আকসা ইহুদিদেরও প্রার্থনার কেন্দ্রস্থল। এই মসজিদ আল-আকসার দিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করতেন মদিনায় হিজরতের ১৭তম মাস পর্যন্ত। মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মসজিদ আল-আকসার প্রথম নির্মাণের আগেই দাঁড়ানো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সুলাইমান (আ.)। অন্যদিকে ইহুদিদের কিতাবগুলোতে এই  আল-আকসা নিয়ে প্রচুর বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরাও ধ্বংস করে দিয়েছিল এই আল-আকসা। ইতিহাসের ঘাত- প্রতিঘাতে বহুবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মসলমানদের এই অন্যতম পবিত্র স্থানটি। বর্তমানেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে এই পবিত্র জায়গাটির ওপর দিয়ে। হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী এই মসজিদ আল-আকসা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর