বৃহস্পতিবার, ৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

পাসপোর্টের যত কাহিনি

সাইফ ইমন

পাসপোর্টের যত কাহিনি

বৈধভাবে পৃথিবীর যে কোনো দেশে ভ্রমণের অন্যতম প্রধান শর্ত পাসপোর্ট। এটি একজন নাগরিকের স্বীকৃতির সবচেয়ে বড় দালিলিক প্রমাণপত্র। সব দেশই তার নাগরিকদের জন্য পাসপোর্ট অনুমোদন করে থাকে। নানা দেশে ভ্রমণের চাবিকাঠি হচ্ছে পাসপোর্ট। কিন্তু সব দেশের পাসপোর্ট একই মর্যাদাসম্পন্ন নয়। কোনো দেশের পাসপোর্ট থাকলে ভিসার আর প্রয়োজন হয় না।  আবার কোনো দেশের পাসপোর্ট থাকলেও ভিসা দেওয়া হয় না। পাসপোর্টের নানা কাহিনি নিয়েই আজকের রকমারি...

 

পাসপোর্ট কী

পৃথিবীর যে কোনো দেশে ভ্রমণের অন্যতম প্রধান শর্ত পাসপোর্ট। এটি ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্বীকৃতির সবচেয়ে বড় দালিলিক প্রমাণপত্র। সব দেশই তার নাগরিকদের জন্য পাসপোর্ট অনুমোদন করে থাকে। এই পাসপোর্ট হলো এক ধরনের ভ্রমণ নথি। এটি আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় বাহকের জাতীয়তা ও পরিচয় প্রত্যয়িত করে। একটি পাসপোর্টে সাধারণত বাহকের নাম, জন্মের তারিখ ও স্থান, ছবি, স্বাক্ষর, এবং অন্যান্য চিহ্নিতকরণের তথ্য থাকে। ২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী ৬০টি দেশ বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট প্রচলন করে এবং ২০১৭ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৬ তে। বর্তমানে ২২০টি দেশে বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট চলছে।  আগে জারি করা একটি পাসপোর্ট সাধারণত নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বৈধ থাকে।

 

কীভাবে চালু হলো

প্রথম পাসপোর্টটির কথা জানা যায় প্রাচীন বাইবেলে। বুক অব নেহেমিয়াতে পারস্যের রাজা প্রথম আরটাজেরেস জুডিয়ার মধ্য দিয়ে নিরাপদে চলাচলের অনুমতি দিয়ে তার এক সরকারি কর্মকর্তাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। নিরাপদে চলাচলের ওই অনুমতিপত্রই মূলত পাসপোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে নিরাপদে চলাচলের অনুমতিপত্রই অফিশিয়াল আকারে পাসপোর্ট হিসেবে প্রকাশ পায়। অন্যদিকে মধ্যযুগীয় ইসলামী খিলাফতের সময়, শুল্ক প্রদানের রসিদ ছিল এক ধরনের পাসপোর্ট। যারা যাকাত (মুসলিমদের জন্য) ও জিজিয়া কর (জিম্মিদের জন্য) প্রদান করতেন, শুধু সেসব মানুষ খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করতে পারতেন। এক সময়ে পাসপোর্টে কোনো ছবি লাগত না। প্রথম ছবিযুক্ত পাসপোর্টের রীতি চালু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। এক জার্মান গুপ্তচর জাল আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে ব্রিটেনে ঢুকে পড়েছিলেন। ওই ধরনের জালিয়াতি প্রতিরোধের জন্যই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পাসপোর্টে ছবি লাগানোর প্রথা চালু হয়। এক সময় পাসপোর্টে ব্যবহার করা যেত পারিবারিক ছবি। পাসপোর্টের জন্য এখনকার মতো ধরাবাঁধা নিয়মের কোনো ছবি লাগত না। একটি পাসপোর্টে সাধারণত বাহকের নাম, জন্মের তারিখ ও স্থান, ছবি, স্বাক্ষর এবং অন্যান্য চিহ্নিতকরণের তথ্য থাকে। একটি পাসপোর্টে সাধারণত বাহকের নাম, জন্মের তারিখ ও স্থান, ছবি, স্বাক্ষর এবং অন্যান্য চিহ্নিতকরণের তথ্য থাকে।  যে কোনো ধরনের ছবি ব্যবহার করা যেত, এমনকি পারিবারিক ছবি হলেও চলত। 

 

যাঁর পাসপোর্ট লাগে না

রানী এলিজাবেথ নিজেই প্রত্যেক নাগরিকের জন্য পাসপোর্ট ইস্যু করেন; তবে নিজেরই নেই...

পাসপোর্ট ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। কিন্তু এমন একজন নারী আছেন যিনি পাসপোর্ট ছাড়াই বিশ্বের যে কোনো দেশে ভ্রমণ করতে পারেন। তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথ। বিশ্বের কোনো দেশে যেতে তাঁর পাসপোর্ট লাগে না। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পাসপোর্ট ছাড়াই বিশ্বের যে কোনো দেশে ঘুরতে পারেন। তবে রানী ছাড়া ব্রিটিশ রাজপরিবারের অন্য সব সদস্যকেই বিদেশ ভ্রমণে পাসপোর্ট বহন করতে হয়। এমনকি এটি রানীর স্বামী প্রয়াত ডিউক অব এডিনবার্গের জন্যও প্রযোজ্য ছিল। আসলে যত ব্রিটিশ পাসপোর্ট ইস্যু করা তার সবই রানীর নামে। যেখানে লেখা থাকে- ‘ব্রিটেনের মহিমান্বিত রানীর পক্ষ থেকে পাসপোর্টধারী ব্যক্তিকে গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।’ সুতরাং যেখানে স্বয়ং রানীই ব্রিটিশ পাসপোর্ট ইস্যু করেন এবং পাসপোর্টধারী ব্যক্তির দায় গ্রহণ করেন সেখানে তাঁর নিজের দায় নিয়ে কারও কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। শুধু পাসপোর্টের ক্ষেত্রেই নয়, আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে ছাড় পেয়ে থাকেন রানী এলিজাবেথ। যেমন- গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে তাঁর কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। এমনকি রানীকে বহনকারী গাড়ির কোনো লাইসেন্স প্লেটও জরুরি নয়। এ ছাড়া যে কোনো ধরনের বিচারেরও ঊর্ধ্বে রানী এলিজাবেথ। উল্লেখ্য, রানী এলিজাবেথ পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান না কেন তাঁর সঙ্গে থাকে বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী। সঙ্গে আরও থাকে মণি-মুক্তার মতো বহুমূল্যের রত্ন।  এমনকি তাঁর সঙ্গে থাকে পোষা কুকুর করজিসের জন্য বিশেষ খাদ্য।

 

পাসপোর্টবিহীন ভ্যাটিকান

ভ্যাটিকান সিটিতে নেই কোনো ইমিগ্রেশন  ব্যবস্থা; ভ্রমণে লাগে না কোনো পাসপোর্ট...

পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় তীর্থস্থান ভ্যাটিকান সিটি। দেশটিতে ভ্রমণে অনেক নিয়মকানুন রয়েছে। যেমন দেশটির কঠোর একটি নিয়ম হচ্ছে, আপনি চাইলেই যে কোনো পোশাক পরে ভ্যাটিকান সিটি থেকে ঘুরে আসতে পারবেন না। হাফপ্যান্ট বা শর্ট স্কার্ট পরিধানে বিধিনিষেধ আছে। আর যদি অতিরিক্ত চামড়া প্রদর্শনীদায়ক কোনো পোশাক থাকে সে ক্ষেত্রে দেশ থেকে বেরও করে দিতে পারে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে দেশটির কোনো পাসপোর্ট স্ট্যাম্প নেই। অর্থাৎ আপনি ভ্যাটিকানে বেড়াতে গেলেও আপনার পাসপোর্টে কোনো সিল বা স্ট্যাম্প পড়বে না। এমন রয়েছে আরও একটি দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। শুধু কুইন্সল্যান্ড হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে পাসপোর্ট লাগে না। কিন্তু তা প্রযোজ্য পাপুয়া নিউগিনির নয়টি উপকূলীয় গ্রামের জন্য। পাপুয়া নিউগিনি স্বাধীন হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এই চুক্তি করেছিল।

 

শক্তিশালী সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট

সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট নিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ১৯২টি দেশ ভ্রমণ করা যায়। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট অনেক মূল্যবান

পৃথিবীর মধ্যে সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। বর্তমানে শক্তিশালী পাসপোর্ট হিসেবে সিঙ্গাপুরের অবস্থান দ্বিতীয়। এটা হ্যানলি পাসপোর্ট ইনডেক্সের তথ্য। সিঙ্গাপুরের পাসপোর্টধারীরা পৃথিবীতে সর্বাধিক ১০১টি দেশে ভিসা ছাড়া বা অন অ্যারাইভাল ভিসাসহ সর্বমোট ১৯২টি দেশে ভ্রমণ করতে পারেন। এত দিন শক্তিশালী পাসপোর্টের তালিকায় জার্মানির সঙ্গে যৌথভাবে শীর্ষে ছিল সিঙ্গাপুর। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের পাসপোর্টের অবস্থান নিচে নেমে এলেও এর গুরুত্ব আগের মতোই রয়েছে। এদিকে সিঙ্গাপুরের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো এশিয়ার কোনো দেশ শক্তিশালী পাসপোর্ট সূচকের শীর্ষস্থান অর্জন করেছিল। সূচকে সিঙ্গাপুর ও জার্মানির পরই রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। সুইডেন বর্তমানে রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে এবং দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।

 

মূল্যবান জাপানের পাসপোর্ট

কেউ যদি প্রশ্ন করে কোন ভ্রমণ নথির মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দরজা খোলা যায়। তার এক কথায় উত্তর হবে জাপানের পাসপোর্ট। সম্প্রতি প্রকাশিত হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্সে জাপানের পাসপোর্টকেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন দশকের প্রথম সূচকটি গত সপ্তাহে প্রকাশ করে হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স। এতে ভিসামুক্ত ও ভিসা অন অ্যারাইভাল বিবেচনায় সূচকের শীর্ষস্থানটি দখল করেছে জাপান। বিশ্বের ১৯৩টি দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে দেশটির পাসপোর্টধারীদের আগে থেকে ভিসা নিতে হয় না।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন এ সূচকে জাপানের পাশাপাশি এশিয়ার অন্য দেশগুলোও বেশ ভালো করেছে। পাসপোর্টের শক্তি বিবেচনায় সেরা ১০-এর তালিকায় সবচেয়ে বেশি দেশ ইউরোপের। ফিনল্যান্ড ও স্পেন রয়েছে তালিকার চতুর্থ স্থানে। পরের অবস্থানে রয়েছে যৌথভাবে লুক্সেমবার্গ ও ডেনমার্ক। সুইডেন ও ফ্রান্স রয়েছে ষষ্ঠ অবস্থানে।

 

আমেরিকান পাসপোর্ট

শক্তিশালী পাসপোর্ট হিসেবে আমেরিকার অবস্থান সপ্তম। অবাক করা ব্যাপার হলো- অর্ধেকের বেশি আমেরিকানের কোনো পাসপোর্ট নেই। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তির ওজনের সঙ্গে পাসপোর্টের বিশেষ একটি সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে কারও ওজন কমলে কিংবা বাড়লে নতুন করে পাসপোর্ট তৈরি করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওজন কম-বেশি হওয়ার কারণে পাসপোর্ট নবায়ন করা লাগলেও যে কারও বিদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকলে মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগেই তা নবায়ন করতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ তাদের দেশে ঢোকার আগে পাসপোর্টে অন্তত ৯০ দিন মেয়াদ থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে থাকে। ১৮৭টি দেশে আমেরিকার পাসপোর্ট দিয়ে ভ্রমণ করা যায়।

 

পাসপোর্টে সুমেরু প্রভা

নানা দেশের পাসপোর্টে নানা রকমের ট্রেডমার্ক কিংবা শনাক্তকরণ চিহ্ন থাকে। অনেক দেশই এখন ব্যবহার করছে ই-পাসপোর্ট।  তার পরও পুরনো প্রিন্টেড পাসপোর্টের আবেদন কমেনি মোটেও। প্রিন্টেড পাসপোর্টের ক্ষেত্রে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো অদ্ভুত এক রীতি অনুসরণ করে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোনো দেশের পাসপোর্ট যদি ইউভি আলোর নিচে রেখে পরীক্ষা করা হয়, তাহলে সুমেরু প্রভা দেখা যাবে। এই সুমেরু প্রভা ‘নর্দার্ন লাইটস’ হচ্ছে প্রাকৃতিক মহাকাশীয় সৌন্দর্য যার দেখা কেবল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোর আকাশে মেলে।

 

জার্মানির পাসপোর্ট

২০১৭ সালে ভ্রমণ র‌্যাংকিং অনুযায়ী বিশ্বে শক্তিশালী পাসপোর্ট তালিকার শীর্ষে ছিল জার্মানি। সাম্প্রতিক সময়ে এসে পাসপোর্ট ইনডেক্সে কিছুটা অবনমন হলেও এখনো জার্মানির পাসপোর্টকে অন্যতম শক্তিশালী পাসপোর্ট বলেই বিবেচনা করা হয়।

জার্মানির পাসপোর্টধারীরা ভিসা ছাড়াই বিশ্বের ১৯১টি দেশে বা গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারেন। ফলে দেশটি তালিকার ওপরের দিকে অবস্থান করছে। মাঝে অনেক বছর জার্মানি তালিকার শীর্ষে অবস্থান করেছিল। তবে এই বছর জার্মানির পাসপোর্ট আবার শীর্ষে উঠে এসেছে। শক্তিশালী পাসপোর্ট হিসেবে জার্মানির অবস্থান তৃতীয়। তার পরেই রয়েছে ইতালি ওু ফিনল্যান্ড।

 

ফেরাউনের পাসপোর্ট

ফেরাওয়ের মৃতদেহ সংরক্ষণ নিয়ে আধুনিক যুগে মিসর সরকারকে যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয়। রামিসেসের মমিতে ব্যাকটেরিয়া জন্মে পচন ধরতে শুরু করে। তখন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকে। সে সময়ে পৃথিবীতে মমি পুনরুদ্ধারের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল ফ্রান্সে। দেশটির নিয়মানুসারে জীবিত অথবা মৃত যে কোনো ব্যক্তি প্রবেশ করতে চাইলে অবশ্যই তার সঙ্গে বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে। যেহেতু রামিসেসের মমি টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে ফ্রান্সে নিয়ে যেতেই হবে। বাধ্য হয়ে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার বছর আগের মৃত ফেরাউনের নামে পাসপোর্ট তৈরি করে। ফেরাউনের পাসপোর্ট বানানো হয় ১৯৭৪ সালে। পাসপোর্টে রামিসেসের জন্ম তারিখ দেওয়া হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩০৩ সাল এবং পেশা হিসেবে উল্লেখ করা হয় রাজা (মৃত)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর