রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

রেস্টুরেন্টের ওয়েটার থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী

আবদুল কাদের

রেস্টুরেন্টের ওয়েটার থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী

প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী

যুক্তরাজ্যের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। জন্ম ১৯৮০ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের বন্দরনগরী সাউদাম্পটনে। বড় হয়েছেন এই শহরেই। কিন্তু ঋষি সুনাকের জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও তাঁর বাবা-মা ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। কথিত আছে, ঋষি সুনাকের পরিবার তিন প্রজন্ম ধরে ভারতের বাইরে বসবাস করে আসছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ঋষির দাদা-দাদি দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে আফ্রিকায় পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য ভালো কাজের সন্ধান এবং বিদেশের মাটিতে উচ্চ শিক্ষা। ঋষির বাবা-মা উভয়ের জন্ম পূর্ব আফ্রিকায়। বাবা জশবীর সুনাক ও মা ঊষা সুনাক; যথাক্রমে কেনিয়া এবং টাঙ্গানিকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও ঋষির পরিবার এক সময় থাকতেন পূর্ব আফ্রিকায়। সেখান থেকে ১৯৬০-এর দশকে তাঁর দাদা-দাদি তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে পূর্ব আফ্রিকা থেকে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন এবং সাউদাম্পটনে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাঁর পরিবার। ঋষি সুনাকের বাবা ছিলেন একজন চিকিৎসক (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে জেনারেল প্র্যাকটিশনার)। আর মা ছিলেন একজন ফার্মাসিস্ট। তিন ভাই-বোনের মধ্যে ঋষি সবার বড়। বাকি দুই ভাই-বোন হলেন- সঞ্জয় সুনাক ও রাখি সুনাক। বেসরকারি এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে ঋষি সুনাক বলেছিলেন, সাউদাম্পটনে বাবা-মায়ের গল্প শেষ হয়নি, তবে আমার গল্পের শুরু এই শহরেই। পরিবারই আমার কাছে সব কিছু। পরিবারই আমাকে এমন সুযোগ দিয়েছে যা আমাকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করেছিল।

 

শিক্ষা কর্মজীবন

মেধাবী ঋষি সুনাক পড়াশোনা করেছিলেন সাউদাম্পটনের একটি প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুল ‘উইনচেস্টার কলেজে’। আর এই স্কুলের পড়াশোনার জন্য খরচ পড়ত ৪৩ হাজার ৩৩৫ পাউন্ড। ঋষি ছিলেন এই স্কুলের হেড বয়। এর আগে ঋষি সুনাক স্ট্রউড স্কুলে পড়াশোনা করেছেন (হ্যাম্পশায়ারের একটি প্রস্তুতিমূলক স্কুল)। আর গ্র্যাজুয়েশন করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অক্সফোর্ডের লিংকন কলেজে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি (পিপিই) বিষয়ে পড়াশোনা করেন। মেধাবী ঋষি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ঋষি সুনাক কৈশোরে একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্র বলছে, সাউদাম্পটনে অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ করেছেন। স্থানীয় এক গণমাধ্যমকে এ নিয়ে ঋষি সুনাক বলেছিলেন, এটি আনন্দের কাজ ছিল না। ওই সময় কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তবে কাজটি পাওয়া আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমবিএ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ঋষি একটি রক্ষণশীল প্রচারাভিযানের সদর দফতরে ইন্টার্নশিপ হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০১ সালে বিবিসি ডকুমেন্টারি মিডল ক্লাস : দিয়ার রাইজ অ্যান্ড স্প্রল-এ এক সাক্ষাৎকারে ঋষি সুনাক বলেছিলেন, ‘আমার বন্ধু আছে যারা অভিজাত, আমার বন্ধু আছে যারা উচ্চ শ্রেণির, আমার বন্ধু আছে যারা শ্রমিক শ্রেণির।’ ঋষি সুনাক স্নাতক শেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকান বিনিয়োগ কোম্পানি ব্যাংক অব গোল্ডম্যান শ্যাক্সের সঙ্গে কাজ করেন। পরে তিনি হেজ ফান্ড ম্যানেজমেন্টে চলে যান এবং অবশেষে ২০১০ সালে নিজস্ব ফার্ম থেলেম পার্টনার্স শুরু করেন। রাজনীতিতে আসার আগে ঋষি একটি বিলিয়ন পাউন্ডের গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। যা ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোয় বিনিয়োগে সহায়তা করত।

 

স্ত্রী সন্তান

আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়াশোনার সময় নিজের জীবনসঙ্গী অক্ষতা মূর্তির দেখা পান। তারপর প্রেম এবং প্রণয়। এই দম্পতি ২০০৯ সালে বেঙ্গালুরুতে বিয়ে করেছিলেন। দাম্পত্য জীবনে এই দম্পতি দুটি কন্যা সন্তানের জনক-জননী। তাঁদের মেয়েদের নাম যথাক্রমে- অনুষ্কা এবং কৃষ্ণা। ব্রিটিশ গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঋষি সুনাক বলেন, আমাদের কন্যারা আমাদের জীবনকে অত্যন্ত ব্যস্ত এবং বিনোদনে ভরিয়ে রেখেছে। স্ত্রী অক্ষতা ভারতীয় বিলিয়নিয়ার এবং ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণ মূর্তির কন্যা। তিনি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম ক্যাটামারান ইউকে-এর পরিচালক। দ্য সান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঋষি সুনাক বলেছিলেন, আমার শ্বশুর তাঁর জীবনে যা অর্জন করেছেন তার দশমাংশ যদি আমি অর্জন করি, তাহলে আমি একজন সুখী মানুষ হব। তিনি যা অর্জন করেছেন তাতে আমি সত্যিই গর্বিত। ঋষি সুনাক স্ত্রী অক্ষতা সম্পর্কে বলেন, অক্ষতা একজন নগণ্য মানুষ এবং অবশ্যই আমি আমার স্ত্রীর পছন্দকে সমর্থন করি।  যদিও ঋষি অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী ট্যাক্সের কারণে ‘নন ডমিসাইলড’ অর্থাৎ বিদেশে তাঁর উপার্জিত অর্থের জন্য তিনি ব্রিটেনে কোনো আয়কর দেন না। এতে তাঁকে অস্বস্তিতেও পড়তে হয়েছিল।

 



ঋষি সুনাক, তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি এবং কন্যারা (প্রথম ছবি) যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন ইংল্যান্ডের অভিবাসী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক (দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছবি)

 

সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী

ঋষি সুনাক প্রথম কোনো ভারতীয় অভিবাসীর সন্তান। একজন অশ্বেতাঙ্গ এবং প্রথম হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতা হিসেবে দেশ চালাবেন। এখানেই শেষ নয়, ইংল্যান্ডের গত ২০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ঋষি সুনাক। মাত্র ৪২ বছর বয়সে ব্রিটেনের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীর খেতাবটি রয়েছে ঋষি সুনাকের দখলে। ব্রিটিশ রাজনীতির ইতিহাসে সম্প্রতি ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডেভিড ক্যামেরনের চেয়ে ছোট ঋষি। ২০১০ সালে ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় টনি ব্লেয়ারও ছিলেন ৪৩ বছরের। এর আগে ১৮১২ সালে সর্বকনিষ্ঠ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন টোরি দলের রবার্ট ইয়াঙ্গেটসন। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের সময় তিনি সদ্য ৪২ বছরে পা দিয়েছিলেন। প্রাক আধুনিক যুগে ঋষি সুনাকের চেয়ে কম বয়সে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন আরও একজন। ১৭৮৩ সালে উইলিয়াম পিট যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল কেবল ২৪। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে তাঁর নতুন সরকারি বাসভবনের বাইরে বক্তৃতা করার সময় লিজ ট্রাসের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ট্রাসের পরিকল্পনা ভুল ছিল না। তবে তাঁর কিছু ভুল হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি আমার দলের নেতা এবং আপনাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছি সেই ভুলগুলোকে ঠিক করার জন্য।’

 

রাজার চেয়েও ধনী ঋষি!

সাবেক চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার, বর্তমানে হাউস অব কমন্সের সবচেয়ে ধনী এমপি বলে মনে করা হয় তাঁকে। ব্যাংকার হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ঋষি সুনাক। অন্যদিকে ভারতের অন্যতম সফল উদ্যোগপতির কন্যা অক্ষতা মূর্তির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। দুয়ে মিলে সম্পদের শিখরে ঋষি। সানডে টাইমস পত্রিকার দেওয়া তথ্য অনুসারে, ঋষি সুনাক ও তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৮২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ধনকুবেরদের তালিকায় ২২২ নম্বরে রয়েছে এই জুটি। ঋষি সুনাকের পারিবারিক সম্পদের পরিমাণ ৭৩০ মিলিয়ন পাউন্ড। অন্যদিকে রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামেলিয়ার সম্পদের পরিমাণ ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। ঋষির স্ত্রীও বর্তমান রাজার মা সদ্য প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের থেকেও ধনী। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী প্রধানমন্ত্রীও ঋষি সুনাক। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণকে নিয়ে যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের মাঝে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকে মনে করছেন ঋষি অত্যধিক ধনী হওয়ায় সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো হয়তো বুঝতে পারবেন না। সব মিলিয়ে সম্পদের নিরিখে যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লসকে ছাড়িয়ে গেছেন ঋষি সুনাক। ব্রিটিশ গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, রাজা তৃতীয় চার্লসের মোট সম্পদের পরিমাণ এখন ৪৪ কোটি ডলারের কাছিকাছি। এমনটিই মনে করছে যুক্তরাজ্যের গবেষণা সংস্থা ওয়েল্থ-এক্স। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে সম্প্রতি প্রথম রাজনীতিবিদ হিসেবে সানডে টাইমসের ধনীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন ঋষি সুনাক। তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির পাশাপাশি তিনিও প্রথম সারির রাজনীতিবিদ হিসেবে স্থান পেয়েছেন।

 

নেতৃত্ব দিতে পারবেন ব্রিটেনকে?

বরিস জনসন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিন পরেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য সুনাকের নাম আসে। স্বাস্থ্যসচিব সাজিদ জাভিদ এবং সুনাকসহ আরও ৪০ জনের পদত্যাগের ফলে জনসন ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। এখন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে বরিস জনসনের উত্তরসূরি হিসেবে লিজ ট্রাস ও ঋষি সুনাক ছিলেন শীর্ষ দুই প্রতিযোগী। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেতাকে এক্সচেকারের চ্যান্সেলর নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। এরপর কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে লিজ ট্রাসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে শেষ মুহূর্তে ছিটকে পড়েন কনজারভেটিভ পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য ঋষি সুনাক। পরে ট্রাস পদত্যাগের ঘোষণা দিলে ফের তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে ফেরেন। তবে সময়টা মোটেও স্বস্তির নয় বলে মনে করেন ব্রিটিশ গণমাধ্যমগুলো। একের পর এক উচ্চাকাক্সক্ষী সিদ্ধান্ত আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপর্যয়ের মুখে ব্রিটেনের অর্থনীতি। করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি ব্রেক্সিটের প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটেনের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে মৃত ইউরোপ- এমন অভিযোগ তুলে ইউরোপ থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলেও সেই ইউরোপীয় নেতারাই ব্রিটিশ অর্থনীতির বিপর্যয় নিয়ে সরব। যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই প্রথম ভাষণে  তাঁর পূর্বসূরি লিজ ট্রাসের ভুল সুধরানোর অঙ্গীকার করেছেন। এদিকে ঋষিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে তুলনা করেছেন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি, বাজারের গ্রহণযোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে আমাদের এমন একজন নেতার প্রয়োজন যাঁকে বিশ্বাস করা যায়। অবশ্য আমাদের একজন নেতা ঋষি সুনাক তা হয়তো পারবেন।’

 

রাজনীতিতে ঋষি সুনাকের উত্থান

জাতির ক্রান্তিকালে নেতৃত্বে এই নেতা

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এবার জিতে গেলেন ঋষি সুনাক। তবে এবার ছিল না কোনো প্রতিযোগী। এককথায়, বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় প্রধানমন্ত্রী হন ঋষি সুনাক। প্রথম অশ্বেতাঙ্গ, প্রথম অভিবাসী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক।

বয়সের রেকর্ড ছাড়াও আধুনিক যুগে প্রথমবার এমপি হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে কম সময়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ঋষি সুনাক। ২০১৫ সালে পার্লামেন্ট সদস্য দিয়ে রাজনীতির শুরু। আর মাত্র সাত বছরেই হয়ে গেলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। রাজনীতির প্রেক্ষাগৃহে শীর্ষে ওঠার লড়াই ঋষির জন্য মোটেও সহজ ছিল না। ২০১৫ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রথমবার পার্লামেন্ট সদস্য হন ঋষি সুনাক। সে সময় তিনি ছিলেন উত্তর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টির রিচমন্ড এলাকার এমপি। যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল লেবার পার্টির বর্ষীয়ান নেতা ভিরেন্দ্র শর্মা ঋষি সুনাককে খুব ভালো করেই চেনেন। দুজনেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত এমপি আর দুজনেরই যোগ রয়েছে পাঞ্জাবের সঙ্গে। ঋষি সুনাকের ব্যাপারে শর্মা বলছিলেন, আজ আমরা এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছিয়েছি, যেখানে স্থানীয় সমাজ, রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছি আমরা। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাও বেড়েছে। রাজনীতিতেও দেখা যায় যে, প্রায় জনা চল্লিশেক এশীয় এবং কালো চামড়ার মানুষ পার্লামেন্টের সদস্য।

২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি পরিবেশ, খাদ্য এবং গ্রামীণবিষয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনকে বের করে আনার পক্ষে কাজ করেছেন ঋষি সুনাক। ব্রেক্সিট গণভোটের প্রচারণার সময় পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন ‘আরও মুক্ত, আরও সমৃদ্ধ দেশ হবে।’ সে সময় তিনি শক্ত অভিবাসন নীতির পক্ষে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যদিও আমি বিশ্বাস করি, যথাযথ অভিবাসন নীতি দেশের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু সীমান্ত আমাদের অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ থেরেসা মের সরকারে ঋষি সুনাক স্থানীয় সরকার বিভাগে জুনিয়র মন্ত্রী হন। ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ঋষি সুনাক তাঁর আসন থেকে পুনরায় এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি স্থানীয় সরকারের পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ছিলেন। ২০১৯ সালে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনে তিনি বরিস জনসনকে সমর্থন দেন। সে বছর ২৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁকে চিফ সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি নিয়োগ করেন। তখন চ্যান্সেলরের দায়িত্বে ছিলেন সাজিদ জাভিদ। পরদিন তিনি প্রিভি কাউন্সিলর সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে আরও বড় ব্যবধানের জয় নিয়ে পুনরায় এমপি হন ঋষি সুনাক। আর ২০১৯ সালে বরিস প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর গুরুত্ব আরও বাড়ে। এরপর সরাসরি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বর্তমানে ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টিতেও জনপ্রিয় মুখ ঋষি সুনাক।

পরের বছরটি ঋষির জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে বরিস জনসনের মন্ত্রিসভায় আসে ব্যাপক রদবদল। বরিস জনসনের সঙ্গে মনোমালিন্য তৈরি হওয়ায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করলে অর্থমন্ত্রী হন ঋষি সুনাক। এর আগে যুক্তরাজ্যের চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পান ঋষি সুনাক। তবে গেল জুলাই মাস থেকে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন ঋষি সুনাক। ৫ জুলাই হঠাৎ চ্যান্সেলরের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি। তার পরপরই ওই সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের পদত্যাগের ঘোষণা আসে। ২০২২ সালে কভিড লকডাউন ভেঙে পার্টি করা এবং তা নিয়ে মিথ্যা বলার অভিযোগে প্রচণ্ড চাপে বরিস জনসন যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন ঋষি সুনাক। অনেকে মনে করেন, তাঁর এবং সাজিদ জাভিদের পদত্যাগের মধ্য দিয়েই বরিস জনসনের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। বরিস সমর্থকরা তাঁর বিরুদ্ধে সুযোগ-সন্ধানী আচরণের অভিযোগ আনলেও সুনাক বলেছিলেন, নৈতিক কারণে সে সময়ে তিনি সরে গিয়েছিলেন। বরিস জনসনের পদত্যাগের পরপরই নেতৃত্বের নির্বাচনে প্রার্থী হন ঋষি সুনাক। প্রচারণায় তিনি নিজেকে চৌকশ একজন আর্থিক ব্যবস্থাপক হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর প্রচারণার প্রধান বার্তা ছিল- কভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ব্রিটিশ অর্থনীতি ভীষণ সংকটে এবং তাঁর প্রধান কাজ হবে এর সমাধান করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনের ভোটে তিনি লিজ ট্রাসের কাছে হেরে যান।

সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে আর্থিক খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় দলের ভিতর প্রচণ্ড চাপে পড়ে গত সপ্তাহে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। এর পরপরই আবারও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের জন্য নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন ঋষি সুনাক। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নাম আসে বরিস জনসন ও পেনি মর্ডান্টের। শেষ পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঋষি সুনাক দলের নেতা নির্বাচিত হন। মাত্র ৪২ বছরের ঋষি সুনাক হন ব্রিটেনের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী এবং ১৮১২ সালের পর সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর