সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিচিত্র বরফকান্ড

বিচিত্র বরফকান্ড

গোটা বিশ্ব যেন এখন ডিপ ফ্রিজ। কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়ায় অনেক সৃজনশীল শিল্পীও মাতেন ভাস্কর্য নির্মাণে। ডাইনোসর থেকে শুরু করে ক্লিওপেট্রা! ভাইকিং যুগ থেকে শিল্পবিপ্লব। প্রাসাদ সেতু, রেলগাড়ি, গির্জা, ৫০ ফিট উঁচু টাওয়ার, কয়েক সহস্রাব্দের এমন নিদর্শন শোভা পায় উৎসবগুলোয়।  তাই তো বরফ ও তুষারপ্রেমীদের কাছে চীনের ‘হারবিন ইন্টারন্যাশনাল আইস অ্যান্ড স্নো স্কাল্পচার ফেস্টিভ্যাল’ এবং নেদারল্যান্ডসের ‘স্নো স্কাল্পচার ফেয়ার’ বেশ জনপ্রিয়। এর বাইরেও বিশ্বের নানা প্রান্তে বরফে সাজিয়ে রাখা আছে অসংখ্য হোটেল ও স্থাপনা। বিচিত্র এমন বরফকান্ড নিয়ে আজকের রকমারি...

 

এস্কিমোদের ঘর [আটলান্টিক]

উত্তর মেরু তথা আটলান্টিক অঞ্চলের বাসিন্দাদের বলে এস্কিমো। এরাই ইগলু ঘর তৈরি করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বরফই ইগলু বাসিন্দাদের গরমে রাখে। কিন্তু কীভাবে! এর প্রধান কারণ, ইগলুতে বরফ তাপ যাওয়া-আসা করতে বাধা দেয়। এ অবস্থাকে তাপ অপরিবাহী বলে। যেসব জিনিসপত্রে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করতে পারে না সেসব জিনিসপত্রকে বিদ্যুৎ অপরিবাহী পদার্থ বলে। বিশেষভাবে স্থাপিত বরফখন্ড তাপ ও উষ্ণতা অপরিবাহী। তাই তাপ ভিতর-বাইরে যাতায়াত খুবই কম পরিমাণে করে। ফলে বরফখন্ড দিয়ে তৈরি বাড়ি ইগলুর ভিতরে গরম থাকে। ইগলু বা বরফঘরের তিনটি অংশ থাকে। একেবারে উঁচুতে মানুষ থাকে আর নিচের অংশে পানি থাকে যা ঠান্ডা। আর মাঝখানে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা থাকে। কী মজার তাই না? ইগলুর ভিতরে পরিচলন পদ্ধতিতে (আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়, পেছনে অন্য বাতাস এসে দখল করে) বাতাস চলাচল করে। আমরা জানি, গরম বাতাস হালকা। তাই উপরের দিকে ওঠে। আর ঠান্ডা বাতাস নিচের দিকে নামে বা শূন্যস্থানে চলে যায়। তাই মানুষ থাকা উপরের অংশ গরম থাকে। এস্কিমোরা শিকার করে। বিশেষ করে মাছ। মাছ শিকারের সময় বরফের মাঝে অস্থায়ীভাবে বাসা তৈরি করে। অস্থায়ী বাসা তৈরি করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে এস্কিমোদের। পরিবারের জন্য মাঝারি ইগলু তৈরি করে। আর এক প্রকার হচ্ছে ছোট ছোট ইগলু দিয়ে বড় একটি ইগলু। ছোট এক ইগলু থেকে অন্য ইগলুতে যাতায়াত করার জন্য সুড়ঙ্গপথের মতো রাস্তা থাকে। কয়েকটি বড়-মাঝারি ইগলু দিয়ে একটি গ্রাম তৈরি হয়। বোঝাই যাচ্ছে, কত রকমের সমস্যা নিয়ে এখানে এস্কিমোদের বসবাস!

বরফের জাদুঘর [আলাস্কা]

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্য। সেখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রাই থাকে হিমাঙ্কের ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। যেখানে পর্যটকদের আকর্ষণে নির্মিত হয়েছে বরফের জাদুঘর। অরোরা আইস মিউজিয়াম। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বরফের স্থাপনা। প্রথমে মনে হতেই পারে, বাইরের পরিবেশের মতো বরফের জাদুঘরের ভিতরের পরিবেশও সম্ভবত প্রচন্ড ঠান্ডা হবে। তবে জাদুঘরের ভিতরের তাপমাত্রা বাইরের চেয়েও কম। প্রযুক্তির সাহায্যে ঘরের ভিতরের তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি পর্যন্ত রাখা হয়। এর বেশিও হয় না, আবার কমও হয় না। এখানকার সবই বরফের তৈরি। আছে বরফের ভাস্কর্যের আশ্চর্যজনক কাজ। সাজিয়ে রাখা হয়েছে বরফের তৈরি নানা কারুকার্য আর ভাস্কর্য। এখানে আগত পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হিয়ামিত রাখা বরফের দেবদূত, বরফের অক্টোপাস, হিমায়িত ড্রাগন আর নানা ফুলেল নকশা। সবচেয়ে মজার হলো- সাজিয়ে রাখা চেয়ার আর সামনের টেবিলগুলো। আছে খাটপালঙ্কও। এগুলোর সবই বরফ দিয়ে তৈরি। জাদুঘরের ঠিক মাঝখানে একটা পানঘর! যেখানে অতিথিদের জন্য পানীয় পরিবেশন করা হয় বরফের তৈরি একবার ব্যবহার উপযোগী গ্লাসে। বরফ জাদুঘরের পাশেই রয়েছে আরেক বিস্ময়। হট স্প্রিং। আলাস্কার হিংস্র ঠান্ডায় লেক, নদী সব যখন জমে বরফ হয়ে যায়, তখনো এই উষ্ণ প্রস্রবণে ফুটতে থাকে পানি। উষ্ণ প্রস্রবণে গোসলের সময়টা ছিল অন্য রকম। পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত গরম পানি। বাকি অংশ শীতে জমে যাওয়ার দশা। সময়টা তখন ২০০৪ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশলী স্টিভ এবং হিদার ব্রাইস আলাস্কা নগরীর অদূরে এই বরফের জাদুঘরটি তৈরি করেছিলেন।

বরফের হোটেল [ফিনল্যান্ড]

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সব থেকে শীতলতম দেশ হলো ফিনল্যান্ড। শীতকালে এই দেশের তাপমাত্রা থাকে ০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কখনো শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমে যায়। দেশটির ল্যাপল্যান্ড অঞ্চলে বরফে ঢাকা বনপ্রান্তরের মাঝখানে রয়েছে মানুষের তৈরি ‘বরফের গ্রাম’। এখানকার হোটেল, খাটপালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, পানশালা বা গির্জা, এমনকি পানপাত্র, সবই বরফের। প্রায় ২০ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে এই ‘স্নো ভিলেজ’ বা বরফের গ্রাম। এখানকার তৈরি মূর্তিগুলোর পাশাপাশি ১২ টন বরফ দিয়ে তৈরি ড্রাগন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ড্রাগনটির প্রতিটি দাঁত একটি একটি করে বরফের তৈরি। ড্রাগনটিকে দিয়ে তথাকথিত ‘আইস বার’ সাজানো হয়েছে। ‘স্নো ভিলেজে’ সারা পৃথিবী থেকে আসা অতিথিরা বারে বসে বরফের তৈরি গ্লাসে ড্রিঙ্কস করে থাকেন। মাইনাস তাপমাত্রায় বিয়ে করতেই বা আপত্তি কী? বরফের তৈরি গির্জায় প্রায়ই দম্পতিরা শুভপরিণয়ে আবদ্ধ হন। তবে সে বন্ধন নিশ্চয় বরফের মতো অত সহজে গলে যায় না। এস্কিমোদের বরফের তাঁবুর অনুকরণে তৈরি ১০টি ‘ইগলু’ সুইটে রাত কাটানো যায়। এখানে বেড়াতে আসা দুজন অতিথিকে এক রাত ইগলু-বাসের জন্য গুনতে হয় ৩৫০ ইউরো।

বরফের রাজ্য [হারবিন]

চীনের হেইলংজিয়াং প্রদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর হারবিন; যা বরফের ভাস্কর্য এবং উৎসবের জন্য বিশ্বখ্যাত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বরফ ও তুষার উৎসবগুলোর একটি। উৎসবটি ১৯৬৩ সালে প্রথম শুরু হয়। এরপর দেশটির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় অনিয়মিতভাবে চলতে থাকে এবং ১৯৮৫ সাল থেকে নিয়মিত হয়। ২০০১ সালে হার্বিন আইস ফেস্টিভ্যাল, হেইলংজিয়াং স্কি ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে যোগ হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বরফের ভাস্কর্য উৎসবের খেতাব পায়। জানুয়ারিতে হারবিন শহরের পারদ  নামে হিমাঙ্কের নিচে (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। নদীর পানিও বরফ হয়ে যায়। আর সেই বরফের নদী থেকেই টুকরো টুকরো করে বরফ তুলে শ্রমিকরা নির্মাণ করেন বরফের রাজ্য। শিল্পীরা অপেক্ষা করছেন নদীর ধারে। নদী থেকে তুলে আনা বরফের খন্ড জুড়ে জুড়ে তাঁরা তৈরি করেন অদ্ভুত সব স্থাপত্য। কোথাও মধ্যযুগের দুর্গের আদলে প্রাসাদ। কোথাও আবার বরফ দিয়েই তৈরি রেস্টুরেন্ট। পর্যটকরা ভিড় জমান বরফের তৈরি চেয়ার-টেবিলে বসার জন্য। এমনকি প্যাগোডা, বিরাট বিরাট মূর্তি- সবই তৈরি হবে নদী থেকে তুলে আনা বরফ দিয়েই। এ জন্য ২ লাখ ২০ হাজার কিউবিক মিটার বরফ ও তুষার দরকার হয়। রাতের রঙিন আলোকসজ্জায় অপরূপ হয়ে ওঠে গোটা বরফের রাজ্য। ভাস্কর্য ছাড়াও দেখা যায় আইস হকি, ফুটবল, স্কেটিং এবং স্কি প্রতিযোগিতা। সংহুয়া নদীতে রক্ত জমে যাওয়ার মতো ঠান্ডা পানিতে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় সাহসী প্রতিযোগীরা।

ভাস্কর্য উৎসব [নেদারল্যান্ডস]

ফেব্রুয়ারিতে নেদারল্যান্ডস হিয়ামিত বরফের উৎসবের আয়োজন করে। কী নেই সেখানে! ডাইনোসর থেকে শুরু করে ক্লিওপেট্রা! ভাইকিং যুগ থেকে শিল্পবিপ্লব। দেশটির সভলে শহরের তুষার উৎসবে কয়েক সহস্রাব্দের নিদর্শন শোভা পায়। প্রাসাদ সেতু, রেলগাড়ি, গির্জা, উঁচু টাওয়ারসহ আরও অনেক কিছু তৈরি করা হয়। বিশ্বের অসংখ্য স্বনামধন্য ভাস্কর শিল্পীরা নেদারল্যান্ডসে নিজেদের সৃষ্টিকর্ম তুলে ধরেন। ভাস্করদের জন্য শুধু নিখুঁত শিল্প তৈরি করাই চ্যালেঞ্জ নয়, বিশাল হলের তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি রাখা হয় বলে শরীর উষ্ণ রাখা বেশ কঠিন। বরফের চাঙড়গুলোর উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত ছুঁতে পারে। করাত ও ছেনি দিয়ে খোদাই করতে বেশ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। কানাডিয়ান শিল্পী ডেনিস ক্লাইনে উৎসব নিয়ে বলেন, ইউরোপে এসে এত বড় আকারে এমন কাজ করার দারুণ মজা। এত দ্রুত এমন কাজের সুযোগ সহজে পাওয়া যায় না। ভিন্ন ভিন্ন ভাস্কর্যের দেখা মেলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর