শয়তানের প্ররোচনায় ও প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ ভুল করে ফেলে। ভুল ক্ষমার সুযোগ না থাকলে মানবজীবন কঠিন হয়ে উঠত। সেজন্য আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম মানব আদম (আ.) এবং হাওয়া (আ.)-কে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বান্দাদের জন্যও ক্ষমার সুযোগ অবারিত রেখেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আর যারা মন্দ কাজ করে ও এরপরে তওবা করে ও ইমান আনে, নিশ্চয়ই আপনার প্রভু উক্ত তওবার পরে ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’ সুরা আরাফ : ১৫৩।
ক্ষমায় সুন্দর হয়ে ওঠে আমাদের সামাজিক জীবন। সেজন্য আল্লাহতায়ালা আমাদের পারস্পরিক জীবনেও ক্ষমার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তুমি ক্ষমার নীতি অবলম্বন কর, লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল।’ সুরা আরাফ : ১৯৯। আমি যাকে ক্ষমা করব তার যেমন আমার কাছে ত্রুটি রয়েছে, হয়তো আমার এর চেয়ে অনেক বড় বড় ত্রুটি রয়েছে আল্লাহর কাছে। আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমাদের জীবনকে দয়া, ক্ষমা ও উদারতার মাধ্যমে সজ্জিত করলে আল্লাহতায়ালাও আমাদের ওই ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যদি ওদের মার্জনা কর, ওদের দোষত্রুটি উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ সুরা তাগাবুন : ১৪। প্রতিশোধ না নিয়ে অন্যকে ক্ষমা করা মুত্তাকি তথা আল্লাহভীরু মানুষের বৈশিষ্ট্য। মুত্তাকি ও সৎ কর্মশীলদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সর্বাবস্থায় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎ কর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ সুরা আলে ইমরান : ১৩৪। প্রতিশোধের সুযোগ পেয়েও কারও ওপর প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দিলে ক্ষমাকারীর মর্যাদাও আল্লাহ বাড়িয়ে দেবেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা সমুন্নত করে দেন।’ সহিহ মুসলিম।
প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দেওয়া নবীদের বৈশিষ্ট্য। দশজন বিমাতা ভাই মিলে আল্লাহর নবী ইউসুফ (আ.)-কে মেরে ফেলার ব্যর্থ ষড়যন্ত্র করার পরও আল্লাহতায়ালা যখন ইউসুফ (আ.)-কে রাজত্ব দান করলেন তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়ে মানবতাকে শিখিয়েছেন, কীভাবে ক্ষমার মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর করে নিতে হয়। আল্লাহতায়ালা সেই বর্ণনা পবিত্র কোরআনে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘(সেদিন ইউসুফ বলেছিলেন) আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সব দয়ালুর চেয়ে অধিক দয়ালু।’ সুরা ইউসুফ : ৯২। মানবতার মহান শিক্ষক মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ক্ষমার ব্যাপারে শুধু উৎসাহই দেননি, নিজে অন্যকে ক্ষমা করে আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে ক্ষমা করতে হয়। আনাস (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে হাঁটছিলাম। তাঁর পরনে ছিল মোটা কাপড়ের একটি নাজরানি (ইয়েমেনি) চাদর। এক বেদুইন তাঁর কাছে এসে সেই চাদর ধরে সজোরে টান দিল। আমি দেখলাম মোটা কাপড়ের ঘষায় নবীজির কাঁধে দাগ বসে গেল। লোকটি কর্কশ স্বরে তাঁকে বলল, ‘আল্লাহর যে সম্পদ তোমার কাছে আছে তা থেকে আমাকে কিছু দিতে বল!’ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটির দিকে ফিরে তাকান এবং মুচকি হাসেন। এরপর তাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দেন। বুখারি।
তৎকালীন আরবের বিখ্যাত কবি কা’ব ইবনু জুহাইর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখতেন। পরবর্তীতে ভুল বুঝতে পেরে তিনি যখন ক্ষমা প্রার্থনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সে কবিও ইসলাম গ্রহণ করে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় কবিতা লিখেছিলেন। নির্যাতনের শিকার হয়েও তায়েফবাসীকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানানোয় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করতে চাওয়া সুমামা ইবনুল উসাল যখন সাহাবায়ে কেরামের হাতে বন্দি হন, তখন প্রতিশোধ নিয়ে তাকে হত্যা করার পূর্ণ সুযোগ থাকার পরও রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন এবং এ মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ ও পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর