পাপিয়া আপার (পাপিয়া সারোয়ার) টেলিফোন আর আসবে না। কথাটা লেখা যত সহজ, ভাবা যত সহজ, জীবনটা ঠিক তত সহজ নয়। বুধবার সন্ধ্যা থেকেই অনেকের টেলিফোন আসছিল। পাপিয়া আপার অবস্থা কেমন, সবাই উৎকণ্ঠায় ছিলেন। শুধু দেশ থেকে নয়, দেশের বাইরে থেকেও অনেকেই তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইছেন। ভার্চুয়াল জগতে তাঁর সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। পাপিয়া আপা যে এত মানুষের এত প্রিয় ছিলেন বুঝতে পারিনি। একটা সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীতকে যে কজন শিল্পী জনপ্রিয় করেছিলেন, পাপিয়া সারোয়ার তাঁদের অন্যতম। তিনি প্রায় একাই ব্যাপকসংখ্যক মানুষের হৃদয়ের কাছে নিয়ে গেছেন রবীন্দ্রসংগীতকে। তাঁর জাদুময় সুললিত কণ্ঠে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁর গায়কি ঢং ছিল অনেকের চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র। তিনি নিজের মতো করে দরদ দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতকে শুদ্ধভাবে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। পাপিয়া সারোয়ারের মতো অসামান্য প্রতিভাধর শিল্পীকে হারালাম; তাঁর অভাব পূরণীয় নয়। তাঁকে আমরা অকালে হারিয়ে ফেললাম।
পাপিয়া সারোয়ার দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। কিছু দিন আগে ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। চ্যানেল আই পরিবারের সদস্য, বার্তাপ্রধান, পরিচালক শাইখ সিরাজসহ কয়েকজন গিয়ে পাপিয়া আপাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেন। আপা তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। অসুস্থতার জন্য এ সময় ভালো করে, নিজের সন্তুষ্টি অনুযায়ী গাইতে পারতেন না। তবু তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে এসেছেন। কখনো না করেননি। কথা বলেছেন। কয়েক দিন আগেও বলছিলেন, ‘সাদী’ (সাদী মহম্মদ) চলে গেল। সে থাকলে তার সঙ্গে একটা অনুষ্ঠান করার সাহস করতাম। এই যে সাহস করতাম বললেন, এ কথা পাপিয়া সারোয়ারের জন্য প্রযোজ্য। পাপিয়া সারোয়ারই স্বাধীনতার পর প্রথম বৃত্তি নিয়ে ভারতের শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদী মহম্মদরা গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। একটি তথ্য এক্ষণে দিয়ে রাখি, পাপিয়া সারোয়ার শান্তিনিকেতনে থাকতেন ৩০২ নম্বর রুমে। ঠিক সেই ভবনেই তাঁর পাশের ৩০৪নং রুমে থাকতেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। পাপিয়া যে ভঙ্গিতে গান করতেন, যে রকম রুচিশীল পোশাক পরতেন, ঠিক তেমনি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও তাঁর রুচিতে প্রভাবিত হয়ে পাপিয়ার রুচিকে ধারণ করেছেন।
আমার মনে আছে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে মালঞ্চ নামে একটি অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানে একজন শিল্পীর একক অনুষ্ঠান হতো। বরকতউল্লাহ ছিলেন প্রযোজক। একবার কোনো কারণে বরকতউল্লাহ ছুটিতে ছিলেন। তখন সেই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পড়ে আলী ইমামের ওপর। আলী ইমামের কোনো অনুষ্ঠান পাওয়া মানে আমাদেরও দায়িত্ব বেড়ে গেল। কারণ আমরা আলী ইমামের সঙ্গে কাজ করতাম। যদিও বেশির ভাগ ছিল ছোটদের অনুষ্ঠান। কিন্তু মালঞ্চ ছিল আধুনিক গানের অনুষ্ঠান। আলী ইমাম যেহেতু দায়িত্ব পেলেন, সেই অনুষ্ঠান সাজাতে হবে অন্যরকমভাবে। আমরা পরিকল্পনা করলাম, এবার অনুষ্ঠানটি সাজাব রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গান করেন এমন কাউকে আনব। পাপিয়া আপা তখন তুমুল জনপ্রিয়। আমরা পাপিয়া আপার নাম প্রস্তাব করলাম। তিনি জানালেন অনুষ্ঠানে আপা গান করবেন। কিন্তু তিনি বললেন, যেহেতু অনুষ্ঠানে একজন শিল্পীই গান করবেন, তাহলে রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি দু-একটি আধুনিক গানও গাইবেন। আমরা তো আরও খুশি। তাঁর সেই বিখ্যাত গান, মনিরুজ্জামান মনিরের কথা এবং মনসুর আলীর সুরে- ‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন’ গানটি গাইবেন পাপিয়া আপা। আলী ইমাম বললেন, এটি একটি অন্যরকম প্রোডাকশন, তাই অনুষ্ঠানটিতে বরকতউল্লাহর ছোঁয়া থাকতে হবে। এ জন্য আরেকটি আধুনিক গান হলে ভালো হতো। ঠিক করলেন ‘পাপিয়ারে পাপিয়া’ গানটি। আলী ইমাম একটি বড় আয়নার সামনে আপাকে দাঁড় করিয়ে শুট করলেন। একজন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী গাইবেন আধুনিক গান। আপা কোনো সংকোচ করলেন না। যেহেতু এটা টেলিভিশন অনুষ্ঠান, তাই প্রযোজকের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতিবিম্বের বিপরীতে গাইলেন গানটি। পাপিয়া আপার সেই পারফরম্যান্স অসম্ভব সুন্দর হলো। অনুষ্ঠানটি ব্যাপক সাড়া ফেলল। দর্শক-শ্রোতা দারুণভাবে গ্রহণ করল। একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া আধুনিক গানও গাইলেন। আমরা নিজেরাও খাবারদাবারে বসে অনুষ্ঠানটি নিয়ে আলোচনা করলাম। তখন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন কাজ করতেন ‘রোববার’ পত্রিকায়। তিনিও ছিলেন সেখানে। তিনি বললেন, আমাদের পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার নেব।
![পাপিয়া সারোয়ার [২১ নভেম্বর ১৯৫২-১২ ডিসেম্বর ২০২৪]](https://cdn.bd-pratidin.com/public/news_images/share/photo/shares/Print/2024/December/13-12-2024/BD-Pratidin_2024-12-13-18.jpg)
সেখানে ছিলেন বাচসাসের কয়েকবারের সভাপতি বিখ্যাত সাংবাদিক আবদুর রহমান। তখন তাঁরও একটি পত্রিকা বের হতো। তিনিও বললেন, আমি সাক্ষাৎকার নেব। তুমি আগে নিও না মিলন।
দুজনের ভিতর প্রতিযোগিতা হলো কিন্তু জয়ী হন মিলন। তিনিই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক রোববারে ছাপা হয়েছিল পাপিয়া আপার সেই বিশেষ সাক্ষাৎকার। আমরাও ছিলাম বেশ কৌতূহলী। সাক্ষাৎকার নিয়ে আসার পর মিলনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাপিয়া আপা কি তোমাকে সামনাসামনি গান শুনিয়েছিলেন? তিনি কি বিশেষ কোনো গানের কথা বলেছেন? নানা প্রশ্ন করলাম মিলনকে। পাপিয়া আপার বাড়ির ছাদে ছিল ছনের ঘর। সেখানেই তিনি রেওয়াজ করতেন। সেখানে যেতে বলেছেন। আমাদের অনেকবার তাঁর বাসায় যাওয়ার জন্য বলেছেন। বাসা চেনানোর জন্য বলতেন, এই রাস্তা দিয়ে এলে দেখবে দুটো দেবদারুগাছ। এই গাছ যেখানে, সেখানেই আমাদের বাসা। আপা বোধ হয় গাছ খুব ভালোবাসতেন। তাঁদের বাড়ির ছাদের ওপর গানের আসর বসত। নিশ্চয়ই পাপিয়া আপা সেখানে গান গাইতেন। আপার সঙ্গে কিছু দিন আগেও কথা হয়েছে। তিনি বললেন, আর তো গাইতে পারব না রে। মাঝেমধ্যে আমার দু-একটা গান চালানোর ব্যবস্থা কর। অন্তত যেন নিজের গানের অনুষ্ঠান দেখতে পারি। তারপর তাঁর বোনের কথা বললেন, জলি রহমান তাঁর বোন। তিনিও গান করতেন, আমাদের সংগঠনে ছিলেন। তিনিও কিছু দিন আগে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। আমি বললাম, জলির গানও আমাদের কাছে থাকতে পারে। অবশ্যই চালানোর চেষ্টা করব। আর কোনো দিন টেলিফোন করবেন না। বলবেন না তাঁর গানের কথা। আমরাও ‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন’ গানটি যখন শুনব মনে করব, আমাদের গানের জগৎ সমৃদ্ধ করার জন্য একজন পাপিয়া সারোয়ার ছিলেন। আমরা তাঁর কথা ভুলব না।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব