কালের পরিক্রমায় বিদায় নিতে চলেছে আরও একটি বছর। প্রতি বছরই পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের মধ্যে বেশ কিছু দেশে ক্ষমতার বলয়ে পরিবর্তন হয়। এসব পরিবর্তনের নেপথ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তথা ভোট, স্বেচ্ছায় বা চাপে ক্ষমতায় ছেড়ে দেওয়া কিংবা কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের স্বাভাবিক মৃত্যু। এর বাইরে অনিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ও কিছু পরিবর্তন ঘটে। অনিয়মতান্ত্রিক এসব প্রক্রিয়ার অন্যতম গণ অভ্যুত্থান, সামরিক অভ্যুত্থান, বিদ্রোহী দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতা দখল এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ক্ষমতার পালাবদল ইত্যাদি। তবে ২০২৪ সালে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান পর্যায়ে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত, এমনকি চিন্তারও বাইরে ছিল।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে একটি বিরাটসংখ্যক দেশে ২০২৪ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা সরকারপ্রধান নির্ধারণের জন্য নির্বাচন পূর্বনির্ধারিত, পরিকল্পিত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। তবে এসব নির্বাচনে ক্ষমতার বলয়ে এমন পরিবর্তন অনেকেরই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তাই বছর শেষে একদল গবেষক ও বিশ্লেষক ২০২৪ সালকে ‘ভোটার কর্তৃক শাস্তির বছর’ তথা ভোটের মাধ্যমে অপশাসন বা অজনপ্রিয় শাসকদের শাসনের অবসান ঘটানোর বছর বলে আখ্যায়িত করছেন।
বছরের শুরুটা ছিল তাইওয়ানে সংসদীয় নির্বাচনে চমকের মধ্য দিয়ে। সে দেশের ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) প্রার্থী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সংসদে তারা বহু দিন পর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। অন্য দল ‘দ্য কাওমিন টাং’ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তা সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। তাই তাদের সাহায্য নিতে হয় সংসদে আটটি আসন পাওয়া তাইওয়ান পিপাস পার্টির (টিপিপি)। ফলে এ টিপিপি হয়ে ওঠে কিং মেকার বা নিয়ামক শক্তি।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ফিনল্যান্ড ২০২৩ সালে ন্যাটোতে যোগ দেয়। এরপর ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন দেখা যায় ন্যাটোতে যোগদানের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়া তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও কোয়ালিশন পার্টির নেতা ৭৭ বছর বয়সি শাওলী নিনিস্টোকেই তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছিল সাধারণ জনগণ। কিন্তু সংবিধানে দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ না থাকায় তিনি জনগণের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তাঁর দলেরই প্রার্থী আলেকজান্ডারকে মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং তিনি ভোটে জয়লাভ করেন।
জটিল রাজনৈতিক আবর্ত আর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির দেশ পাকিস্তানে সংসদ নির্বাচন হয় এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি। এ নির্বাচনে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। রাত পর্যন্ত ইমরান খানের দলের নেতারা প্রায় ১২৭টি আসনে এগিয়েছিলেন। কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির আসনসংখ্যা বাড়তে থাকে আর কমে ইমরান সমর্থকদের আসন লাভের সংখ্যা। শেষ পর্যন্ত ইমরান সমর্থকরা পান ৯৩টি আসন আর পাকিস্তান মুসলিম লীগ পায় ৯৮টি আসন। ধারণা করা হয়, সেনা সমর্থনে ভোটে কারচুপি হয় এবং সেনারাই ৬৮টি আসন পাওয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির সমর্থনে মুসলিম লীগকে তথা মুসলিম লীগের মিয়া মোহাম্মদ শাহবাজ শরিফকে ৩ মার্চ ক্ষমতায় বসায়।
এ ছাড়াও ২০২৪ সালের ২৪ মার্চ আফ্রিকা অঞ্চলের দেশ সেনেগালে অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এ নির্বাচনে সেনেগালের দুবারের রাষ্ট্রপতি ও রিপাবলিকান দলের ঐক্যজোট নেতা সাংবিধানিক কারণে অংশ নিতে পারেননি। তাঁর দল ও জোটের পক্ষে নির্বাচন করেন আমাডো বা। কিন্তু দল বা জোটের ওপর আস্থা না থাকায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ১০ বছর আগে জন্ম নেওয়া দ্য আফ্রিকান পেট্রিয়টস অব সেনেগাল ফর ওয়ার্ক, এথিকস অ্যান্ড ফ্র্যাটারনিটি (সংক্ষেপে পিএএসটিইএফ) ৫৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে বদলে দেয় এক দশকের শাসনধারা।
২১ এপ্রিল ২০২৪ মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। এর আগে ২০১৯ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল ভারতপন্থি নেতা ইব্রাহিম মো. সলিহ (জন্ম ১৯৬২ সাল) ও তাঁর দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ২০২৪ সালে জনগণ বেছে নেন চীনপন্থি ও ভারতবিরোধী কংগ্রেস দল ও তার নেতা মোহামেদ মুইজ্জুকে (জন্ম ১৯৭৮ সাল)। তাই প্রবীণ ও ভারতপন্থিদের বদলে মালদ্বীপে আসে চীনা বসন্ত ও নতুনের আবহ।
বর্ণবাদের জন্য কুখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ নির্বাচন হয় ২০২৪ সালের ২৯ মে। একসময়ের শ্রমিকনেতা এবং বর্তমানকালের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ গাইরিল রমা ফোসা এ নির্বাচনে ৫৭.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস আগের তুলনায় ১৭.৩০ শতাংশ ভোট ও ৭১টি সংসদীয় আসন কম পায়। আর নতুন জন্ম নেওয়া বামপন্থি দল এম কে পার্টি ১৪.৫৮ শতাংশ ভোট ও ৫৮টি আসন পায়, যেখানে মোট আসন ছিল ৪০০টি। জুন মাসে ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে আগাম নির্বাচন দেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে থাকা ম্যাক্রোঁ ও তাঁর অনুসারীরা সংসদে আগের চেয়ে ৮৬টি আসন কম পান (২৪৫-এর স্থলে ১৫৯)। পক্ষান্তরে বামধারার নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিএফ) বেশি পায় ৪৯টি আসন। আর তাদের ভোট বাড়ে প্রথম রাউন্ডে ২৮.২১ শতাংশ ও দ্বিতীয় রাউন্ডে ২৫.৮%।
গণতন্ত্রের তীর্থভূমিতুল্য যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের জন্য নির্বাচন হয় ২০২৪ সালের ৪ জুলাই। এতে ক্ষমতাসীন ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টি অবিশ্বাস্যভাবে ২৫৪টি আসন কম পায় (৩৬৫-এর স্থলে ১২১)। তাদের ভোট কমে ২৩.৭ শতাংশ। অন্যদিকে ৩৩.৭ শতাংশ ভোট এবং ২১১টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে লেবার পার্টি। কেরির স্টেমারের নেতৃত্বাধীন এ দলের আসনসংখ্যা ৪১১টি। জুলাই বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় আগস্টে ক্ষমতা ও দেশ ছাড়েন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যা আমাদের সবার জানা।
সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কায় হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। অপরাজনীতি আর দুর্নীতির অপবাদ নিয়ে ২০২২ সালের ৯ জুলাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার অষ্টম রাষ্ট্রপতি এবং এসএলপিপি দলের নেতা রাজা পাকশে। তখন রাষ্ট্রের হাল ধরেন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির রনিল বিক্রমাসিংহে। ২০১৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থি দল জনতা বিমূর্তি ব্যারামনা (জেভিপি)-এর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপল পাওয়ার (এনপিপি) জোটের প্রার্থী অনুরা কুমারা দেশনায়েক জয়লাভ করেন।
অক্টোবরের ২৭ তারিখে জাপানের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ৪৬৫টি আসনের জন্য নির্বাচনে নামে সে দেশের ৯টি মূল দলসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। এ নির্বাচনে আগে ২৫৯ আসন পাওয়া লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আসন ৬৮টি কমে ১৫১-তে দাঁড়ায়। আর কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপানের আসনসংখ্যা ৯৬ থেকে ৫২টি বেড়ে হয় ১৪৮টি।
নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রবল শক্তি নিয়ে নতুনভাবে আবারও প্রেসিডেন্টরূপে ফিরে আসা আর ডিসেম্বরে বিপ্লবের মুখে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের লেজ গুটিয়ে পালানো বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবীবাসী।
এভাবেই ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন ও বিপ্লবে মানুষ অন্যায়, অবিচার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে গোপনে ও প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে।
২০২৪ সালের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার এ সুবর্ণ সুযোগ কাজে না লাগালে ভবিষ্যতে এর কড়া মূল্য দিতে হবে পৃথিবীবাসীকে, বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: [email protected]