ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। এ সরকার এখন জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। তাদের পেছনে সব দলের সমর্থন রয়েছে। এ সরকার পূর্বসূরিদের কালিমা মোচনে রাষ্ট্র সংস্কারের কঠিন দায়িত্ব পালন করছে। সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসন দেশকে যে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে তার সবকিছু ঠিকঠাক করা কঠিন দায়িত্ব-বই কি। বর্তমান সরকার চাইলেই সব কিছু সংস্কার সম্পন্ন করতে যে পারবে না তা তারাও জানেন। তাই এ সরকারের পর দরকার একটা জাতীয় সরকার। যারা রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু করা কাজগুলো সম্পন্ন করবেন। এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতীয় নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে নিজেই ইতিবাচক প্রস্তাব দিয়েছেন। বলেছেন, বিএনপি ‘জাতীয় সরকার’ ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা দেখতে চায়। জনগণের সমর্থন নিয়ে আগামীতে দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে বিএনপি ‘জাতীয় সরকার’ ব্যবস্থা ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট সংবিধানে সংযুক্ত করতে আগ্রহী। গত বুধবার তিনি বলেছেন, পূর্বসূরিরা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। সেই যুদ্ধ জয়ের মূল শক্তি ছিল প্রশ্নহীন জাতীয় ঐক্য। দুঃখজনক হলেও সত্যি, স্বাধীনতার পর আমরা সেই ঐক্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারিনি। অত্যাবশ্যকীয় একটা জাতীয় সরকারের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসায় দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে প্রথম দিন থেকেই। ফলে জাতির একটা বিরাট অংশ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশ গঠনে কোনো অবদান রাখতে পারেনি।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা পেয়েছে মাত্র এক মাস। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। পুলিশ বাহিনী কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ভাড়াটে মস্তান বাহিনীর মতো কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই বাহিনীকে বিশ্বমানের মানবিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে রূপান্তর করার কাজটি অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। আইনি ও বেআইনি প্রায় দেড় লাখ আগ্নেয়াস্ত্র, লাখ লাখ গুলি-গোলা ও বিস্ফোরক ইত্যাদি সারা দেশে সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্ত-ডাকাত-দস্যুদের হাতে রয়েছে। তদুপরি বিভিন্ন চরাঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে সমাজবিরোধীদের হাতে রয়েছে অসংখ্য দেশি অস্ত্র। এসব অস্ত্র জনজীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হানাহানি, মারামারি ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্র-প্রশাসনও বিব্রতবোধ করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। অবৈধ অস্ত্র এক্ষুনি দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার করা দরকার। পুলিশ স্টেশন ও ফাঁড়িগুলো সুশৃঙ্খল পুলিশ সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্ট মস্তান সদস্যদের পুলিশ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা জরুরি।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে দেশজুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাধিক মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং বাজার দর মধ্যবিত্ত, হৃমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা খুবই জরুরি কাজ বলে মনে করি। আর শিল্প-উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন এক্ষুনি ব্যাপক আয়োজনে সম্প্রসারণ করতে হবে। এমনকি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলার ডেপুটি কমিশনার ও সরকারি বিভিন্ন দফতরের অন্যসব আমলার মধ্যে সদ্য-পদত্যাগী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ট যারা রয়ে গেছেন, তাদের নিষ্ক্রিয় করা এবং বদলি করে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আইনের আওতায় আনতে হবে।
এসব কাজ নিয়ে এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলে এসেছেন-জরুরি রাষ্ট্র সংস্কার সম্পাদন করেই জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে তৎপর হবে তাঁর সরকার। তাঁরা এতটুকু সময়ও নষ্ট করবেন না। তাই আশা করছি রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই এ সরকারকে বিভিন্নভাবে ব্যতিব্যস্ত না করে সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দেবে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। নতুন সরকারের মূল কাজ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে পুলিশ বাহিনীসহ আনসার-ভিডিপি ও র্যাব ইত্যাদিকে শক্তিশালী অবস্থানে এনে সুসংগঠিত করা। দেশের সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা দানও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতীত সরকারের এজেন্টরা গার্মেন্ট শিল্পে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক প্রতিষ্ঠান। যে কোনো মূল্যে শিল্পকারখানায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বেকারত্ব বাড়ার কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। প্রতি বিপ্লবের উদ্দেশ্যেই যে কলকারখানার শ্রমিকদের উসকানি দেওয়া হচ্ছে তা ইতোমধ্যে সরকারের কাছেও স্পষ্ট। সরকারের কাছে নৈরাজ্য ঠেকানো জরুরি হয়ে উঠেছে। খেটে খাওয়া হতদরিদ্র, মধ্যবিত্ত এবং হৃমধ্যবিত্ত মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে নিত্যপণ্যের বাজার সুশৃঙ্খল করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার, আনসারদের সাম্প্রতিক বিদ্রোহ ও অন্য কর্মচারীদের দাবিদাওয়া নিয়ে সড়ক আটকানোর বিশৃঙ্খল ঘটনার পেছনে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের লুটের-টাকা ঢালার ঘটনা রয়েছে। তারা একটা পাল্টা-অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন সরকারি অফিস-দপ্তরে আওয়ামী লীগ সরকারের শক্ত সমর্থক আমলারা দায়িত্বে এখনো আছেন, তারা সাবেক কর্তৃত্ববাদী সরকারের পুনর্বহালের অপচেষ্টা চালাতেই পারেন নিজেদের লুণ্ঠন অব্যাহত রাখার স্বার্থে।
তাই অন্তত জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সাফল্য ধরে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে, তাদের কর্মী-নেতা-সংগঠকদের। রাষ্ট্র সংস্কারে অবশ্যই রাষ্ট্রের সংবিধান পুনর্লিখন তথা সংস্কার দরকার। দেশের একজন মেধাবী ও দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিঙ্গুইশড ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে সেমিনার-আলোচনা সভা করে যাচ্ছেন যা খুবই আশাব্যঞ্জক। এ বিষয়ে রাজনীতিকদেরও ভাবতে হবে।
দেশের অর্থনীতি একেবারেই দুর্দশাগ্রস্ত এবং নরকময় অবস্থা। এটার পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন খুবই জটিল ও কঠিন ব্যাপার, সেটা করতেও অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা দরকার। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে কমিটি হয়েছে। আমরা আশা করছি তার কাজকর্ম অনেকটাই ফলদায়ক হবে। যদিও কেউ কেউ ততটা ভরসা করতে পারছেন না। তাদের কথাবার্তায় ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ ভাবসাব থাকায়। তারা বলেছেন, দুর্নীতি কোথায় হয়েছে তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন, কারণ অনুসন্ধান করবেন এবং প্রতিকারের সুপারিশ দেবেন, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের পরিচয় প্রকাশ ও বিচারসহ আসল প্রতিকার করবে সরকারের অন্যসব প্রতিষ্ঠান। তাহলে এ ধরনের অর্থনৈতিক কমিটি কতটুকু অগ্রসর হতে পারবে তা সময়ই বলে দেবে। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে।
আমি স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে গঠিত এবং ড. জহুরুল হক পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি ও অন্য পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটির মোট ৬টি তদন্ত রিপোর্ট দেখতে অনুরোধ জানাব। কী অসাধারণ তদন্ত রিপোর্ট, এখনকার তদন্ত কমিটি বা কমিশনগুলোর জন্য বিশাল শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে ওইসব রিপোর্টে। ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি শতাংশ দুর্নীতি অনাচারের তথ্য-উপাত্ত এবং দায়ী দুর্নীতিবাজদের পুরো পরিচয়, বিস্তারিত প্রামাণ্য-তথ্যসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল মতিন চৌধুরীকে আটক করে জেলে বন্দি করা হয়েছিল। আর ওই রিপোর্টগুলো অনুসরণ করে পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো অনেকখানি সাবধানতা অবলম্বন করতে বাধ্য হন এবং শিক্ষা-পরিবেশের অনেক উন্নতি হয়েছিল। একইভাবে জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে গঠিত জেলা জজ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘আনট্রায়েড হেয়েনাস অফেন্সেস এনকোয়ারি কমিটি’ তদন্ত করেছিল সাত শতাধিক জঘন্য অপরাধের- সেখানেও পুলিশের জেলা পুলিশ সুপার পর্যায়ের অফিসারদের অপরাধ প্রামাণ্য দলিলের মতো উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেই রিপোর্টটিও অসামান্য একটি তদন্ত রিপোর্ট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ রিপোর্টের ঘটনাগুলো নিয়েও বিচারকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি, কারণ, ১৯৮১ সালের ৩০ মে জেনারেল এরশাদের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ায় সব কিছু থেমে যায়। এ তদন্ত রিপোর্টগুলো থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা নেওয়া উচিত বলে মনে করি।
আরেকটি জরুরি আলোচ্য বিষয় হলো, এদেশে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি বিস্ফোরক উদ্ধারে অনেকবার বিশেষ অভিযান পরিচালনা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি অভিযানেই দেখা গেছে, অপরাধীরা অতিমাত্রায় ধুরন্ধর হওয়ায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে (এমনকি কারফিউ দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ দিয়েও পর্যাপ্ত সাফল্য পাওয়া যায়নি) বেশির ভাগ অবৈধ অস্ত্রই উদ্ধার করতে পারেননি। সেই অপরাধীরা দিনে দিনে আরও অনেক বেশি ধুরন্ধর হয়েছে, তারা এখন মাফিয়া বাহিনীতে পরিণত। সাধারণ অভিযানে এদের কাছ থেকে বৈধ-অবৈধ সব অস্ত্র উদ্ধারে সফল হওয়া একটু কঠিনই হবে বৈকি।
তবে আশার কথা, অপরাধী ধরার প্রযুক্তিগত সামর্থ্য বেড়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমিক ও দায়িত্ববান প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের সবার মেধা-দক্ষতা ও যথার্থ শ্রম ব্যবহার করা গেলে সাফল্য আসার সম্ভাবনা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি। তার ওপরে আমাদের দেশপ্রেমিক বিপ্লবী শিক্ষার্থী ও সংগ্রামী-জনতা রাষ্ট্রের সব কাজে অংশ নিতে এগিয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে আশায় বুক বাঁধা যাবে, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতা ও অন্য সব সহযোগীকে কাজের সময় ও সুযোগ দিতে হবে। তাদের অবান্তর কথাবার্তা বলে অস্থির করে দেওয়া একেবারেই কাম্য নয়, হতে পারে না। সর্বোপরি যে কথাটি না বললেই নয় যে, হাজারো তরুণ ছাত্র-জনতাকে যারা বা যাদের নির্দেশে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের ক্ষমা নেই। তা সে পুলিশ কর্মকর্তা হোক আর আমলা বা রাজনীতিবিদ হোক। বিশেষ করে এক হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিচার হতেই হবে। অপরাধীরা যত বড় নেতা বা নেত্রীই হোক না কেন এ বাংলার মাটিতেই তাদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
♦ লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক