এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সংস্কার’ শব্দটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। রাষ্ট্র সংস্কার এখনকার রাজনীতির বলা যায় প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ২০০৭ সালের জানুয়ারি (যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন নামে খ্যাতি বা কুখ্যাতি পেয়েছে) মাসের পর ১১ তারিখের পর থেকে সংস্কার একটি ঘৃণা এবং ভয়ের শব্দে পরিগণিত ছিল। ওয়ান-ইলেভেনের পর যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন তারাও সংস্কারের কথা বলেছিলেন এবং সেই সংস্কারের পক্ষে একদল রাজনীতিবিদ দাঁড়িয়েও ছিলেন। কিন্তু তারা জন কিংবা রাজনৈতিক সমর্থন পায়নি। ‘মাইনাস টু’ কথাটি খুব চালু হয়ে গিয়েছিল। বোঝানো হচ্ছিল, দুজন নেত্রীর কারণে রাজনীতি দূষিত হয়েছে। তাদের রাজনীতি থেকে বাদ দিতে হবে। এই দুই নেত্রীর দল, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। সংস্কার শব্দটি কোনো বিবেচনায়ই খারাপ নয়, কিন্তু দুটি বড় দলের বিরোধিতার কারণে সেটি ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছিল।
সংস্কারের প্রশ্নে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সংস্কারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন দলটির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। যারা ক্ষমতায় ছিলেন, যাদের ইতিহাস এখন এক-এগারো সরকার বলে অভিহিত করে। তারা মান্নান ভূঁইয়ার গ্রুপকে সমর্থন, সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু মানুষ সরকারি এ অপতৎপরতাকে সমর্থন করেনি। প্রথমদিকে এক-এগারোকে মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সরকারি কিছু তৎপরতায় যেমন সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যের বাড়াবাড়ি এবং ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা, ব্যবসায়ীদের ওপর বলপ্রয়োগ ইত্যাদি ঘটনায় সেই সমর্থন ধীরে ধীরে চলে যায়। আওয়ামী লীগের মধ্যেও আমু, রাজ্জাক, তোফায়েল, সুরঞ্জিতদের মতো নেতার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সংস্কারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সরাসরি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বড় গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায় সংস্কারের বিরুদ্ধে। ফলে সেখানেও সংস্কার তথা মাইনাস টু পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়।
কিন্তু এবারের কাহিনিটি ভিন্ন। সে কথা শেষের দিকে বলব। এবারের সরকারের বয়স অবশ্য এখনো ৪০ দিনের কম। এক নিদারুণ রক্তক্ষয়ের পরে অধিষ্ঠিত সরকারের প্রশাসন বিপর্যস্ত। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যে পুলিশ প্রশাসনের তা কেবল নামমাত্রই আছে। তারা থানায় বসে, কিন্তু কাজ করে না। জিডি নেয় না, মামলা নেয় না, কোথাও কোনো তদন্তে যায় না। আর যাবেই বা কীভাবে? জুলাই অভ্যুত্থানের শুরু থেকে তারা যে নৃশংস বর্বরতা দেখিয়েছে তা এখন জাতিসংঘের তদন্তের বিষয়। ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার উদগ্র লালসায় আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ বাহিনীকে তাদের দস্যু বাহিনীতে পরিণত করেছিল। আর অল্প বয়সি শিক্ষার্থীসহ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। পরিণতি ছিল প্রতিহিংসার, জিঘাংসার, প্রতিশোধের। পুলিশ যেমন ঠাস ঠাস করে মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ, মুগ্ধকে গুলি করে হত্যা করেছিল, নিরীহ মানুষও তেমনি ক্রোধে অন্ধ হয়ে পুলিশকে মেরে গাছে টাঙিয়ে রেখেছিল। আমাদের জাতির ইতিহাসে এ বর্বরতা এবং হিংসার স্মৃতি মুছে যেতে কত সময় নেবে কে জানে! এখন ভয়ে অথবা ১৫ বছরের আচরণজনিত বদভ্যাসের কারণে থানার পুলিশ থানার বাইরে যেতে চায় না। ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, কেবল দাঁড়িয়েই থাকে; কোনো কাজ করে না। পুরো শহরে জ্যাম লেগে যায়।
হত্যা, প্রতিশোধের এ দগদগে স্মৃতি থেকে সরকার পুলিশকে এখনো বের করে আনতে পারেনি। ডিউটি পালন করতে গিয়ে তারা যে নিরাপত্তার ভয় করছে সে ব্যাপারে তাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। আমি সরকারের সমালোচনা করছি না। বাস্তব অবস্থার কথা বলছি। আরও বাস্তবতার কথা এই যে, পুলিশ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা, আইন রক্ষা করা যাবে না। হয় তাদের বুঝিয়ে, অভয় দিয়ে ডিউটিতে আনতে হবে নতুবা যাদের দিয়ে কাজ হবেই না, তাদের বাদ দিয়ে নতুনদের আনতে হবে। জনপ্রশাসন সম্পর্কেও একই কথা বলতে হবে। জনপ্রশাসনে অবশ্য এরকম ভয়াবহ স্মৃতি তাড়া করে না। কিন্তু সেখানে বিগত ১৫ বছরে দলীয়করণ করা হয়েছে তা ভয়ংকর। সহকারী সচিব মাত্র ছয় মাসে, এক বছরে একেবারে সচিব বা সিনিয়র সচিব হয়ে গেছেন। কেবল দলীয় পরিচয় বিবেচনায় অনেককে পদ বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। আর এরকম সময় যা হয়, কুৎসিত প্রতিযোগিতা। জনপ্রশাসনে নির্লজ্জ দালালি করা হয়। পেশার সম্মান বা মূল্যবোধ কেবল লঙ্ঘিত হয় না, রীতিমতো পদদলিত হয়। চূড়ান্ত অদক্ষতা গ্রাস করে পুরো জনপ্রশাসনকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বৈঠকে, এমনকী সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও আমাদের প্রতিনিধিরা ভালো করে কথা বলতে পারেন না। সভার মিনিটস লিখতে পারেন না।
ডয়েচে ভ্যালেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ঠিকই বলেছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের কাজ হচ্ছে প্রশাসনকে ফিরিয়ে আনা। বিশেষ করে পুলিশকে। কাজটা সহজ নয়; বরং খুব কঠিন। এমনকী মাঝে মাঝে অসম্ভব বলেও মনে হয়। সরকার প্রথমে ঘোষণা করেছিলেন তারা পদবঞ্চিতদের পদায়ন করবেন। সে কাজ তারা শুরুও করেছিলেন এবং খুব বড় ধরনের সমালোচনা ব্যতিরেকে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছেন। কিন্তু প্রচুর পরিমাণে অভিযোগ আছে, স্বৈরাচারের দোসরদেরও পদায়ন হয়েছে। যারা ছেড়ে গেছেন বা পালিয়ে গেছেন তাদের জায়গায় আবার তাদেরই লোক বসেছে। ডিসিদের পোস্টিং নিয়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে দুই তিন দিন ধরে যা ঘটল তা রীতিমতো মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মারামারির মতো। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন ভাই হচ্ছে কী, এভাবে কি চলবে? যারা ডিসি হওয়ার আশা রাখেন বা নিজেদের যোগ্য মনে করেন, তাদের এ ধরনের আচরণ কোনো নীতি বা মূল্যবোধের মধ্যেই পড়ে কি? জনপ্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের আচরণ যদি এরকম হয় তাহলে নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে কার হাত দিয়ে?
এখানে কর্তৃপক্ষ নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। মানে আমি সরকারের কথা বলতে চাচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের দায়িত্বে যারা আছেন এ ধরনের সিদ্ধান্তে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই কি রাখেন না তারা? যাদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের ব্যাপারে কি উদাসীন? নাকি বোঝার মতো যোগ্যতাই নেই? দুই দিন সচিবালয়ে যা হলো তার জন্য নিশ্চয়ই পদপ্রত্যাশীদের আচরণের সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু একই সঙ্গে এ ধরনের নির্দেশ বা সার্কুলার জারি করার মালিক/কর্তৃপক্ষ যে নেহাতই নাদান একটা কাজ করেছেন তাও না বললে চলবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন তাদের সম্পর্কে জনমনে বিরূপ কোনো ধারণা নেই। সবাই জানেন এই সরকার কোনো রাজনৈতিক সরকার নয়। সরকারে যারা আছেন তাদের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই। অথচ রাষ্ট্র ব্যাপারটাই রাজনৈতিক। সেই রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করবে তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে এমন হয়েছে, অরাজনৈতিক মানুষ বা মানুষগুলো সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করেছেন। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়া, এরশাদের কথা বলা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া ছাড়া তারাও রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন। হতে হয়েছে।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনোভাবেই একজন রাজনীতিবিদ নন। সম্ভবত প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মালেক উকিল বলেছিলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই; ভবিষ্যদ্বাণী তো করাই যায় না। কিন্তু তারপরও ভবিষ্যতে ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল করে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদে রূপান্তরিত হবেন ড. ইউনূস এরকমও প্রতীয়মাণ হচ্ছে না। এরকম যে হতেই হবে তারও কোনো কথা নেই। নির্দিষ্ট সময়ে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উপযোগী ও গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচন দিয়ে তিনি সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিতেই পারেন। তাতে হয়তো তার সম্মানের টুপিতে আরও একটি তিলক যুক্ত হবে। কিন্তু যতদিন তিনি আছেন ততদিন তিনি রাজনীতি বিযুক্ত থাকতে পারবেন না।
লেখার শুরুতে এক-এগারোর কথা বলেছিলাম। ১/১১-এর সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের পার্থক্য এই যে, জুলাই আপাদমস্তক একটি গণ অভ্যুত্থান ছিল, যার মানে এই আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ছিল। তাই এই চেতনা সহজে মরবে না। যে অন্তর্বর্তী সরকার এখন ক্ষমতায় তারা ১/১১-এর মতো সরকার নয়। তারা বাস্তবিকই আন্দোলনের ফসল। যেমন ড. ইউনূস বলেছেন, ওরাই আমাদের নিয়োগকর্তা। এ জন্য এই সরকারের এক-এগারোর’র মতো ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা কম।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া তার দ্বিতীয় ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ছয়টি বিষয়ে কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। এর মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের একটি পথ-নকশা পাওয়া গেছে। আশা করা যায়, ভালোভাবেই অগ্রসর হবে সবকিছু এবং আমরা সেই নতুন বাংলাদেশের তীরে তরি ভেড়াতে পারব।
তারপরও উপসংহারে এসে একটি কথা বলা দরকার বলে, মনে করছি। ইতোমধ্যে কিছু কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু ব্যাপারে মানুষ বর্তমান সরকারকে up to mark মনে করছে না। দাবি-দাওয়াভিত্তিক যে সমস্ত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেগুলোকে একভাবে সামাল দেওয়া গেছে। আশুলিয়া, সাভারে গার্মেন্ট বেল্টে যে বিক্ষোভ চলছিল সেটাও মনে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু গোপালগঞ্জে যা দেখা গেল কাণ্ড ঘটল তা স্বস্তি দিচ্ছে না দেশবাসীকে।
লেখক : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য