বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত বাঙালি, বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর সমপর্যায়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আর কেউ কোনো দেশে রাষ্ট্র বা সংস্কারপ্রধান আছেন বলে মনে হয় না। এটা জাতির গর্ব। তিনি দেশের এ যাবৎকালের একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি জাতির উদ্দেশে উদাত্তকণ্ঠে বলেছেন, ‘আপনারা সরকারকে উপদেশ-পরামর্শ দিন। সরকারের কাজের ভুল ধরুন। উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা করে সংশোধনের পথ বলে দিন।’ ড. ইউনূসের এ আহ্বানে অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ করছি। এগুলো সরকারের চলতি সংস্কার কর্মযজ্ঞে তালিকাভুক্ত করার জন্য ‘সবিনয় নিবেদন’ না লিখে সজ্ঞানে ‘নাগরিক নির্দেশ’ বলছি। জনগণের দ্বারা নিযুক্ত, জনগণের সরকারের প্রতি দেশের প্রকৃত মালিক, নাগরিকদের ভাষাভঙ্গি এমনই হওয়া উচিত। আশা করি, সরকারের গায়ে এতে ফোসকা পড়বে না। কোনো স্বৈরশাসক ক্ষমতায় থাকলে নিশ্চয়ই এই দুঃসাহস দেখানো যেত না!
১. গণতন্ত্রের সবক সবার আগে
দেশটা কারও বাবার না, ১৮ কোটি মানুষের। এ স্লোগান মুখে মুখে। চায়ের টেবিলে আড্ডায়, আলোচনায়। কিন্তু এর মানে কী? প্রকৃত গণতন্ত্র কী- নদীমাতৃক বাংলাদেশের সোজা-সরল মানুষগুলোকে তা জানাতে হবে। রাজনৈতিক দল কয়েকটি পরিবারের পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় বসার ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসা নয়- এটা জনগণকে জানাতে হবে। দেশের মানুষ রাজনীতির দাবার ছকের এক-একটি অসহায় সৈন্য নয়, বংশপরম্পরার রাজনীতিকদের ক্ষমতায় বসানোর সেবাদাস নয়- এটাও জনগণকে বোঝাতে হবে। তাদের বিশ্বাসে-অভ্যাসে, চিন্তায়-চেতনায় এটা প্রোথিত করতে হবে। দলগুলোকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে, গণতন্ত্রের নামে পরিবারতন্ত্র বা পরোক্ষ রাজতন্ত্র আর নয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করুন। না হলে আবারও স্বৈরাচারের দানবীয় উত্থানের আশঙ্কা থেকেই যাবে।
২. প্রশাসনে বার্তা দিন প্রশাসনিক শৃঙ্খলার
ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে দেশে দ্বিতীয় বিজয় অর্জিত হয়েছে। দেড় দশকের দুর্নীতি-দুঃশাসন আর দলীয়করণের দুরাচারে বঞ্চনার পাহাড় জমেছে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। অন্যদিকে অসৎ, অযোগ্য ও বর্জ্যদের হয়েছে আঙুল ফুলে কলাগাছ। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষোভ-বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের চল্লিশ দিন পেরোলেও শৃঙ্খলা ফেরেনি জনপ্রশাসনে। কর্মকর্তারা পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং, অনেকে ডিসি-যুগ্ম সচিব হওয়ার তদবিরে ব্যতিব্যস্ত। ৫ আগস্ট গণভবন লুটপাটের মতো দুরবস্থায় জনপ্রশাসন। সচিবালয়ে কদিন এ নিয়ে যথেষ্ট হট্টগোল করেছেন বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তারা; যাদের নিয়ে গর্ব করে পরিবার, সমাজ, দেশ। দুঃখজনক! গত ১৫ বছর নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনাই ছিল প্রধান বিবেচ্য। এতে পর্যায়ক্রমে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙে গেছে। এখানে বৈষম্য দূর করা, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং শৃঙ্খলা ফেরানো রাতারাতি সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকার সে প্রচেষ্টা নিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধসহস্র কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের যে কর্মযজ্ঞ সরকার চালিয়ে যাচ্ছে, অনিয়মের সব তালিকায় তার শোধন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় দিতে হবে। কদিন আগে কিছু কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল দাবি করেন একদল কর্মকর্তা। আবার ডিসি পদ পেতে ব্যাকুল একদল। এ নিয়ে হাতাহাতি, লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটেছে। প্রশ্ন, তাদের চাকরিবিধি কি এটা অনুমোদন করে? প্রশাসন কি হরিলুটের বাতাসায় পরিণত হতে চলেছে? সরকারকে বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে বুঝে নিতে হবে। ১৫ বছর বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ সঙ্গত, কিন্তু তার প্রকাশ সংযত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। সরকারকে দেখতে হবে, এর পেছনে কোনো তৃতীয় পক্ষ কলকাঠি নাড়ছে কি না! পতিত সরকারের অনুচরদের ষড়যন্ত্র সব ক্ষেত্রেই এখনো যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। তারা হাল ছাড়েনি। অচলাবস্থা সৃষ্টির অপচেষ্টা দেখা গেছে পোশাক ও ওষুধ শিল্পে।
ইমেজ ও আস্থা হারানো পুলিশ এখনো নৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে পেশাদারিত্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বেনজীর, আসাদুজ্জামান, হারুন, বিপ্লব, মনিরুল এই বাহিনীকে পচিয়ে দিয়ে গেছেন। জুলাই বিপ্লবে পুলিশের ভূমিকা জনমনে তাদের ঘৃণার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। প্রায় ২০০ পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি। তারা কি এলিয়েন? ভিনগ্রহ থেকে এসেছিলেন? কিছুই অসম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামাতে হয়েছে। এসব বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং ঘাটতি পূরণ যথাসম্ভব দ্রুতই করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। লক্ষ্য রাখতে হবে, বঞ্চিতদের বঞ্চনা দূর করতে গিয়ে যেন আবার কোনো বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতা করা না হয়।
ভরসা এটাই, এই সরকারের প্রধান, ৮৪ বছরের প্রাজ্ঞ ড. ইউনূসের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে বিশ্বের শতাধিক নোবেলজয়ীসহ প্রায় দুই শ সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের। সশ্রদ্ধ সমর্থন রয়েছে দেশের ১৮ কোটি মানুষের। যে স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা নিয়ে সহস্র তরুণ-জনতা জীবন দিয়েছেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে এই সরকারকে। বৈষম্যহীন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। গত শতকের নব্বই সালে এরশাদ পতনের আন্দোলনে ‘জনতার মঞ্চে’ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পেশাগত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের যে মহরত হয়েছিল, তা এত দিনে পরবর্তী সরকারগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার যথেষ্ট পুষ্টি পেয়ে ভালোই পুষ্ট হয়েছে। প্রশাসনে দলবাজির এ অপচর্চাই উপড়ে ফেলতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা হবেন জনগণের সেবক, কোনো দলের কর্মী নয়। হলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা। তখন আর রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ প্রাপ্তি বা বঞ্চনার প্রশ্ন উঠবে না। এটাই হবে জনপ্রশাসনের প্রধান শিরোধার্য আচরণ। তাদের শতভাগ সততা ও পেশাদারিত্বের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন। প্রশাসনিক পদক্ষেপের কঠোর বার্তা দিন প্রশাসনের প্রতি।
৩. সংবাদ সম্মেলনে ‘না’
সরকারপ্রধানের সংবাদ সম্মেলনের এক অদ্ভুত সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। জাতিসংঘসহ কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলন বা সভায় যোগ দিয়ে কিংবা কোনো দেশের সরকারপ্রধানের আমন্ত্রণে সে দেশ সফর শেষে ফিরে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করতেন। সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকরা আমন্ত্রিত হতেন। প্রধানমন্ত্রী সেখানে বিদেশে তাঁর কাজের ফিরিস্তি, বিশেষত অর্জনের দিকগুলো তুলে ধরতেন। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। প্রশ্নকারী সংবাদকর্মীদের অনেকের মধ্যেই এমন দুঃখজনক পেশাগত দীনতা, ব্যক্তিত্বহীনতা ও নির্লজ্জ চাটুকারিতা ফুটে উঠত যে, বিবেকবানরা লজ্জা পেতেন। এমন সংবাদ সম্মেলনেই বিভিন্ন সময় সদ্য পতিত প্রধানমন্ত্রীর মুখ ফসকে এমন কিছু বাক্য বেরিয়ে যায়, যা তাকে তীব্র সমালোচনার মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
দেশে-বিদেশে যেখানেই হোক, সরকারপ্রধানের কর্মকাণ্ডের খবর মানুষ এখন সঙ্গে সঙ্গেই জানতে পারে। গুরুত্ব বিচারে টেলিভিশনে সরাসরি দেখা যায়। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে উঠে আসে অল্পক্ষণের মধ্যেই। পর দিন প্রকাশ পায় সব ছাপা কাগজের পাতায়। তাহলে আলাদা করে জানানোর আর কী বাকি থাকে? তারপরও যদি রীতি রক্ষার কোনো দায় থাকে, পররাষ্ট্র সচিব বা প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সংশ্লিষ্ট বিটের সাংবাদিকদের ডেকে সফরের অর্জন-বর্জনের সারসংক্ষেপ জানাতে পারেন। বর্তমান সরকারপ্রধানও যদি ওই রকম আয়োজন করেন, নিশ্চিত আরও কিছু সংবাদকর্মী অভিধান ঘেঁটে বাছাই করা লাগসই সব স্তুতির বস্তা ভরে নিয়ে হাজির হবেন। সেগুলো উগড়ে দেবেন- আগে একদল যেভাবে দিয়েছে। ড. ইউনূসের এমন বিকৃত বিনোদন উপভোগের রুচি ও সময় হবে না বলেই মনে করি। ফলে এখানে ‘নিষিদ্ধ’ লেখা একটি লাল সিল মেরে দিন।
৪. এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি বাদ
সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ আমলে এ অন্যায় কাজটা চালু হয়েছিল। সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। একটা গাড়ির দাম যদি এক কোটি টাকা হয়, তার শুল্ক ৮ কোটি টাকা। সামর্থ্যবান সাধারণ কেউ কিনলে দাম দাঁড়াবে ৯ কোটি টাকা। কিন্তু সংসদ সদস্যকে ওই ৮ কোটি টাকা শুল্ক দিতে হয় না। অর্থাৎ তিনি জনপ্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্রকে কোটিতে ৮ কোটি টাকা বঞ্চিত করার লাইসেন্স পেয়েছেন! যে যত বেশি দামি গাড়ি আনবেন, তিনি রাষ্ট্রকে তত বেশি বঞ্চিত করবেন। তলে তলে এক্ষেত্রে একটা মর্যাদার লড়াইও চলে এমপিদের মধ্যে। তারা যেসব গাড়ি কেনেন, এক-একটিতে ১০-১২ কোটি টাকা শুল্ক প্রাপ্য হয় সরকারের। যদি জনপ্রতি গড়ে ১০ কোটি টাকাও শুল্কমুক্তি ধরা হয়, ৩৫০ জন এমপি জনগণকে বঞ্চিত করছেন ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কত বড় অন্যায়! গরিব দেশের জনপ্রতিনিধিদের কী মর্মান্তিক গাড়ি বিলাস! এবং আশ্চর্য, ব্যক্তিস্বার্থের কারণে পক্ষ-বিপক্ষ সব এমপি এ অন্যায়ের প্রশ্নে অন্ধ থেকেছেন; এই সুবিধাটা নিয়েছেন। এটা বন্ধ করুন।
৫. দেশটা কারও বাপের না, গনিমতের মাল না
স্বাধীনতা-উত্তর ৫৩ বছরে যত তথাকথিত ‘শত্রু সম্পত্তি’ ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ ব্যক্তি পর্যায়ে নামমাত্র প্রতীকী মূল্যে দান অথবা বরাদ্দ করা হয়েছে- তার তালিকা তৈরি করুন। এগুলোর যৌক্তিকতা বিচার করুন। অযৌক্তিক বিবেচিত হলে বরাদ্দ বাতিল করে রাষ্ট্রের জিম্মায় বুঝে নিয়ে জনকল্যাণে লাগান। দেশটা সুবিধাভোগীদের লুটেপুটে খাওয়ার গনিমতের মাল না। যথেচ্ছ ভোগ দখল এবং দান-ধ্যানেরও না। কারণ দেশটা কারও বাপের না।
উল্লিখিত অনিয়ম, অপচর্চাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার স্থায়ী বিধান করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন কোনোভাবে আবার এসব পাল্টে ফেলার পথ না থাকে, সে ব্যবস্থাও সিলগালা করে দেবেন। এগুলো সংস্কারসূচিতে রাখুন।
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারকে অপ্রতিরোধ্য লড়াকু মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। জনগণের সত্যিকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তা যত দুষ্করই হোক। অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বাণিজ্য ও কূটনীতিতে স্বার্থের সমতা অর্জনে আপসহীন দৃঢ়তা কামনা করে জাতি।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন