২০ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার কিছু আগে আমরা বিএসএমএমইউ অর্থাৎ আগের পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমরা মানে আমি, আমার স্ত্রী মেহের নিগার, ডাক্তার শোয়েব এবং নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিব আনোয়ার ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজ্জাক সজীব।
আগের দিন সন্ধ্যায় আমার বুকে ব্যথা উঠেছিল। অবশ্য ঠিক বুকে বলা যাবে না, বুক যেখানে খাদ্যনালিতে নেমেছে, ডাক্তারি ভাষায় সম্ভবত গ্যাস্ট্রিক রিজিয়ন বলে সেখানটায়। তখন আমি বাইরে ছিলাম। তাড়াতাড়ি করে বাসায় ফিরে এলাম। ভাবলাম, বাসায় গেলে নিশ্চয়ই ব্যথাটা কমবে। কিন্তু রাত যত বাড়ছিল ব্যথাটাও তত বাড়ছিল। আমার স্ত্রী বললেন, ওটা গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা হবে। একটা গ্যাসের ট্যাবলেট খাও। সঙ্গে আরেকটা ঘুমের। ঘুমিয়ে যাও। সকালে দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।
তাই করলাম। ঘুমালাম। সকালে উঠে মনে হলো ব্যথাটা আর নেই। কিন্তু নাশতা করার সঙ্গে সঙ্গে আবার ব্যথাটা বাড়তে থাকল। শেষ পর্যন্ত দুপুর নাগাদ ল্যাবএইডে গিয়ে একটা ইসিজি করলাম। ইসিজি ভালো ছিল। কিন্তু ব্যথা কমল না। বিকালে ডাক্তার শোয়েব বললেন, একটা টোপোনিন টেস্ট করে নেন। সেটা আপনাকে কনফার্ম করতে পারবে সমস্যাটা কী। তাই করলাম। কিন্তু টোপোনিনের রেজাল্ট পেতে পেতে রাত ১১টা পার হয়ে গেল। টেস্ট রেজাল্ট ডাক্তার শোয়েবকে পাঠিয়ে দিলাম। সেটা দেখে শোয়েব বললেন, আপনি বাসায় থাকেন। আমরা আসছি। আপনাকে এখন হাসপাতাল যেতে হবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখনই যেতে হবে? রাতে না গেলে হয় না? উনি বললেন, না রাতেই যেতে হবে। বুঝলাম ব্যাপারটা সিরিয়াস।
সেই রাতেই শোয়েব এলেন, সঙ্গে শাকিব এবং সানি। রাজ্জাক আমার বাসার কাছেই থাকে। ১০ মিনিটের মধ্যে সেও এলো। কিন্তু আমরা যাব কোথায়? আমি যে ডাক্তারদের কাছে এ পর্যন্ত হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য গেছি তাদের কাউকে তো এখন পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া তারা এখন হাসপাতালেও নাই। আমাকে নিশ্চয়ই হাসপাতালে যেতে হবে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে। আমার স্ত্রী মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে যাওয়ার পক্ষে। কোনো সন্দেহ নেই হার্ট ফাউন্ডেশন একটা নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল। কিন্তু ওটা আমার বাসা থেকে অনেক দূরে। ডাক্তার শোয়েবই বললেন, বিএসএমএমইউতেও যেতে পারেন। ওটা আপনার বাসার কাছে হবে। তা ছাড়া হাসপাতাল হিসেবেও বিএসএমএমইউ অনেক ভালো। আমার মনে পড়ল কয়েকদিন আগে বিএসএমএমইউর প্রিন্সিপ্যাল প্রফেসর সাইদুর রহমানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। ভদ্রলোক আমার ঠিক পূর্ব-পরিচিত নন। কিন্তু এক সময় উনি আমাদের ছাত্র সংগঠন করতেন, জাসদ ছাত্রলীগ। আমি তাকে সেই রাতে ফোন করলাম এবং তিনি ফোন ধরলেন। আমি তাকে আমার অবস্থার কথা জানালাম। তিনি বললেন, টোপোনিন পজিটিভ, তাহলে আপনি বাসায় বসে আছেন কেন? আমি বললাম, যাব কোথায়? উনি জবাব দিলেন, আপনি বেরিয়ে পড়েন। রাত ১২টার বেশি হয়ে গেছে। আমি জানি না কার্ডিয়াক ইউনিটে ইমারজেন্সিতে কাউকে পাব কি না। তবুও আমি দেখছি। আপনি বেরিয়ে পড়েন। আমি ১০ মিনিটের মধ্যে আপনাকে ফোন করব।
আমরা তার কথামতো সেই রাতে তখনই বেরিয়ে পড়লাম। ১০ মিনিটের মধ্যে তিনি ফোন করলেন। দুজন ডাক্তারের নাম বললেন। বললেন, আপনি ইমারজেন্সিতে গেলে তাদের পাবেন। তারাই সব ব্যবস্থা করবে।
আমরা যখন কার্ডিয়াক ইমারজেন্সিতে পৌঁছলাম তখন রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। একটা টিমটিম করে ভাল্ব জ্বলছে। ওই বারান্দাতেই দু-একজন শুয়ে আছেন। তারা রোগী বা কে তা জানি না। আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ বসার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তাররা এলেন। আমরা ইমারজেন্সিতে ঢুকলাম। তারা একটা চেয়ার দিলেন আমাকে বসতে। সেখানে বসে বসে তারা আমার ইতিহাস লিখতে শুরু করলেন। লেখা শেষ হয়ে গেলে অল্প কিছু পরীক্ষা, যেমন ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি করলেন। তারপর আমাকে তারা কার্ডিয়াক ইউনিটে নিয়ে গেলেন। সেই রাতে একটা কেবিন দিলেন তারা আমাকে। যদিও সেখানে এসি কাজ করছিল না, তবুও ভালো লাগল। সঙ্গে সঙ্গেই আমার ইসিজি করা শুরু হলো বলতে গেলে মিনিটে মিনিটে এবং প্রতি মিনিটেই ইসিজি খারাপ হতে লাগল। ওখানকার ডাক্তাররা জানালেন ১৩ জন প্রফেসর সমন্বয়ে একটা মেডিকেল বোর্ড করা হয়েছে তারা আমার কেসটা দেখছেন। আমার সঙ্গে, আগেই বলেছি, আমার স্ত্রী ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, পার্থক্যটা দেখেছ? আমি প্রশ্ন করলাম, কী পার্থক্য? উনি বললেন, ১০ বছর আগেও আমরা এখানে এসেছিলাম এই হাসপাতালে। তখন তুমি জেলে ছিলে। তোমার বুকে ব্যথা উঠেছিল। জেলখানা তোমাকে এই হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। আমি আর নিলম (নিলম আমাদের মেয়ে। ও তখন দেশে ছিল। কিন্তু আমাকে গ্রেপ্তার করার পরে তৎকালীন সরকার এবং তাদের গুন্ডাপান্ডারা আমার পরিবারের ওপর যে সন্ত্রাস শুরু করেছিল তাতে আমাদের মেয়েকে আমরা দেশের বাইরে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলাম) এসেছিলাম। ওরা তখন আমাদের ভিতরে ঢুকতেই দেয়নি।
আমার মনে পড়ল সেই দিনের কথা। এখন দিন তারিখ মনে নেই; তবে আমি ‘কারাবাসের বাইশ মাস’ বলে যে বই লিখেছি তাতে বিশদ বর্ণনা আছে। কেবিন ওয়ার্ডের সামনে আমার স্ত্রী-কন্যা দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ভিতরে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। ওরা আমার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু পুলিশ যেতে দেয়নি। ভিতরে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ বসেছিলাম। তারপর একজন ডাক্তার এসেছিলেন। তিনি আমার সব কথা শুনে এবং আমাকে পরীক্ষা করে ভর্তি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন হাসপাতালে ডিজি ছিলেন না। ছয় ঘণ্টা পর তিনি এসেছিলেন এবং এসে আমার ভর্তির আদেশ বাতিল করে চলে গিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা করেননি, কথা বলার তো প্রশ্নই নেই। আমার স্ত্রী-কন্যা অপেক্ষা করতে করতে কখন চলে গিয়েছিল আমি বলতে পারব না। সেদিন বুকে ব্যথা নিয়ে নাকের জলে, চোখের জলে সবার অলক্ষ্যে একাকার হয়ে আবার জেলে ফিরে গিয়েছিলাম।
কত অমানবিক ছিল সেই ১৫ বছরের লাগাতার দুঃশাসন। এখন সরকার বদলেছে তাই এই পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আমি মোট চার-পাঁচ দিন হাসপাতালে ছিলাম। ডাক্তারসহ স্টাফ যারাই ছিলেন, আমার প্রতি যথেষ্ট কেয়ার নিয়েছেন। তাদের সবার প্রতি অবশ্যই ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
আজ অক্টোবর মাসের ২ তারিখ। আমি বাসায় চলে এসেছি। আমার সঙ্গে এখনো আছে পাঁচ দিনের বিএসএমএমইউর স্মৃতি। একটা হসপিটালের স্মৃতি এরকম করে কি থাকার কথা? এমনিতেই হাসপাতাল আমার কাছে কোনো সুখকর জায়গা নয়। সম্ভবত কারও জন্যই নয়। কিন্তু অতীতের যে দুঃসহ স্মৃতি, অপমানজনক ব্যবহার, তার বিপরীতে বর্তমান স্মৃতিটা মনে এক ধরনের আনন্দের হিল্লোল তৈরি করে। আমাকে আমার দলের একজন প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি যদি মাহমুদুর রহমান মান্না না হতেন তাহলে কি এরকম ব্যবহার পেতেন? নিশ্চয়ই না। রাত ১২টার পর আমার জন্য নিশ্চয়ই কেউ বসে থাকত না এত তাড়াতাড়ি একটা কেবিন পাওয়া যেত না। কিন্তু তারপরও একটা পার্থক্য সূচিত হয়েছে বলেই আমার মনে হয়।
আমি সব হাসপাতাল ঘুরে দেখিনি। সবগুলো কেন, বস্তুত আমি কোনো হাসপাতালই ঘুরে দেখিনি। মানুষের কাছে খুব একটা পরিবর্তনের কথা শুনিনি। কিন্তু তারপরও মানুষের মনে একটা পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা দেখি। ৫ আগস্ট এর আগেও যে মানুষকে হতাশ মনে হতো সেই মানুষের মনে আশার আলো দেখতে পাই। এটা মানা উচিত এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের দেশে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনআকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটেছে এভাবে : শুধু সরকার বদল নয়, আমরা দেশটাকেই বদলে দিতে চাই। ডক্টর ইউনূসের মতো মানুষ; সঙ্গে আরও একঝাঁক দেশ এবং সমাজ বদলাবার আকাক্সক্ষী জ্ঞানী ও প্রতিভাবান মানুষ দেশের হাল ধরেছেন। গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অনেকেরই ব্যাপারটা বুঝতে ভুল হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। কেবল একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান বা তত্ত্বাবধান তার দায়িত্ব নয়। একটি নির্বাচনের মতো নির্বাচন যা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যা সেই ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জমি তৈরি করে দেবে। সে জন্যই সংস্কার।
ব্যাপারটা নিশ্চয়ই অনেক বড়। নতুন বাংলাদেশের যে ভিত্তি সেই ভিত্তি নির্মাণের কাজ এই সরকারের ওপর। সরকার সেটা একা করবে না অংশী যারা তারা সবাই মিলে এটা করবেন। তবে হ্যাঁ মানতে হবে, এর প্রধান দায়িত্ব এখন যাদের হাতে স্টিয়ারিং তাদের ওপর অর্থাৎ এই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। যদি তারা ব্যর্থ হন তাহলে বাংলাদেশ এই যাত্রায় ব্যর্থ হবে। এ সরকারের বয়স মাত্র দুই মাস। এখনই তাদের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করা যাবে না। তবে এটা ঠিক, পুরনো কাঠামো দিয়ে, পুরনো খোলনলচে দিয়ে, পুরনো প্রশাসন (সিভিল বা যে কোনো কিছু) দিয়ে সেই নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা যাবে না। এ দিক থেকে এই দুই মাসের সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার কথা বলা যাবে। অনেকেই বলছেনও। সরকার যদি সেগুলো কানে তোলে তবেই মঙ্গল।
♦ লেখক : নাগরিক ঐক্য, সভাপতি