অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা এবং সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতি হয়েছে। এরই মধ্যে ইনভেস্টিগেশন টিম, প্রসিকিউশন টিম গঠিত হয়েছে। আদালত পুনর্গঠনের চিন্তা চলছে।
অচিরেই দেখবেন বিচার শুরু হয়েছে। এরপর আমরা ভারত থেকে (শেখ হাসিনার) প্রত্যর্পণ চাইব।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংস্কার কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রস্তাবিত ছয় সংস্কার কমিশনের প্রধান ছাড়াও আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম প্রমুখ অংশ নেন।
বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ সম্পর্কে ব্রিফ করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
সংস্কার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা জানান, কমিশনকে ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাস সময় দেওয়া হবে রিপোর্ট পেশের জন্য। ওই রিপোর্ট পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ হবে।
ভারতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান স্ট্যাটাস এবং তাঁকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সঙ্গে ভারতের বন্দি-প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারতে যদি বাংলাদেশের কোনো অভিযুক্ত থাকে, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী হন আর যাই হোন না কেন, তাঁর প্রত্যর্পণ আমরা চাইতে পারি।
চার ধরনের সংস্কার প্রস্তাব আসতে পারে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, কিছু সংস্কার থাকবে তাৎক্ষণিকভাবে করতে পারব, কিছু প্রস্তাব থাকবে মধ্যমেয়াদি, কিছু প্রস্তাব দীর্ঘমেয়াদি, কিছু প্রস্তাব থাকবে- যেটা আগামী নির্বাচনে বিজয়ী সরকার বাস্তবায়ন করবে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে ভোটার তালিকা হালনাগাদের পর নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করব, তারপর আমরা ভোটার তালিকার কাজ চূড়ান্ত করব। আমরা শুধু সংস্কারে নিজেদের আবদ্ধ রাখব না। তার সঙ্গে সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের জন্য, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য, ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা বিলোপ করার জন্য যেসব বাস্তবসম্মত কাজ আছে- তার সবই করব।
আইন উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষে আরও বড় পরিসরে আলোচনা হবে, যেখানে সবস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এমনকি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট সবার মতামতের জন্য অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যাতে আর কোনোদিন কখনো ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা জাঁকিয়ে বসতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সংস্কার প্রয়োজন। সেটার লক্ষ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো প্রাথমিক স্তরে কাজ শুরু করেছে। সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, সংবিধান কীভাবে গৃহীত হবে এটা যদি আমি বলে দেই, তাহলে তো সংস্কার কমিশনের প্রয়োজন পড়ে না। যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তারা সব সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে দেখবে। কীভাবে সংবিধানের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হতে পারে, কীভাবে সংবিধান পরিবর্তন হতে পারে, আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে কোনো সংবিধান প্রণয়নের কাজ চলতে পারে, কী হবে- এ সিদ্ধান্ত আমরা নেব না। এ সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের জনগণ। জনগণের পক্ষ থেকে কাজ করার জন্য কমিশন করা হয়েছে। কমিশনে যতটুকু পারা যায়, সমাজের সব অংশের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। গণহত্যার সঙ্গে জড়িত কারও সঙ্গে সরকার সংস্কার বিষয়ে কোনো আলোচনা করবে না বলে জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সকল অংশের মতামত বলতে সুষ্পষ্টভাবে বলতে চাই, যারা গণহত্যাকারী ছিল, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, অন্তত এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, অনেক অনেক মানুষকে গুরুতর আহত করেছে এবং যারা বিচারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে- তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না।
তাদের বাদে সমাজের যত প্রতিনিধিত্বকারী আছে, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সামাজিক, ছাত্র সংগঠন যারা বিপ্লবে অংশ নিয়েছেন, প্রত্যেকটি সেক্টরের সঙ্গে যতভাবে পারা যায়, তাদের মতামত নেওয়া হবে।
এর আগে প্রশাসন সংস্কারে অনেক কমিশন কাজ করলেও তাদের রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি; এবার নতুন করে কী ধরনের সংস্কার আসবে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা বলেন, আগের কমিশনগুলো সেভাবে জনগণের মতামত গ্রহণ করেনি। আমাদের কমিশনগুলো যেসব সংস্কারের সুপারিশ করবে- সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। যাতে পরবর্তীকালে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে সে-ও এর মধ্যে এক ধরনের মালিকানা অনুভব করে এবং এটা অব্যাহত রাখে। সংস্কার বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সংস্কার কাজ করতে চাই।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘসময় ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট ছিল। এখন একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে, জনগণের অংশগ্রহণের ভিতর দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি যেমন আছে, তেমনিভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে, জনগণের সমর্থনে গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। সেটা হলো যে প্রতিষ্ঠানগুলো গত পনেরো বছরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, যেগুলো জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারছে না, সেগুলোকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ছয়টি সংস্কার কমিশন করা হয়েছে। এই সংস্কার কমিশন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে কাজ করবে, যেমন- জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন- এসব সংস্কার যদি আমরা গুছিয়ে আনতে পারি, পরবর্তীতে আরও সংস্কার প্রস্তাব অলরেডি আছে আমাদের টেবিলে। এই সংস্কার কমিশনগুলো আগামী তিন মাসের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করবে, যার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা একটা কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীন ছিলাম। এ সময় ভোটাধিকার থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়েছি। ভবিষ্যতে যেন এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য কতগুলো পরিবর্তন আনতে হবে, সংস্কার করতে হবে- এসব নিয়েই তথ্য বিনিময় হয়েছে আজকের বৈঠকে।