মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

বৈচিত্র্যময় আর চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী

বৈচিত্র্যময় আর চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী

বাংলাদেশে চিকিৎসক, শিক্ষকতা ও ব্যাংকার হিসেবে কাজ করা নারীর সংখ্যা কম নয়। কিন্তু নাবিক, সৈনিক, নিরাপত্তাকর্মী, হোটেলের অভ্যর্থনাকর্মী ও গাড়ির মেকানিকের কাজ করেন এমন নারীর সংখ্যা খুব কম। একসময় এ ধরনের বৈচিত্র্যময় ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর অংশগ্রহণের কথা চিন্তা করা যেত না। কিন্তু নারীরা এখন এ পেশায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন। পারিবারিক বিভিন্ন কাজ করার পাশাপাশি সংসারে সচ্ছলতা আনতে এবং দেশের জন্য নিজ মেধার স্বাক্ষর রাখতে গতানুগতিক পেশার বাইরে গিয়ে কাজ করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে বিভিন্ন পেশায় নারীর সরব অংশগ্রহণে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। মেধা ও যোগ্যতা থাকলে সব বাধা-বিপত্তিই যে মোকাবিলা করা সম্ভব, বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার কর্মজীবী নারীরা তা প্রমাণ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, ব্যাংক, রেস্টুরেন্ট, পার্ক, পোশাক কারখানা ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এখন নারী নিরাপত্তাকর্মীর চাহিদা অনেক। সাধারণত এ স্থানগুলোতে কর্মরত নারীকর্মী ও আগত নারীদের তল্লাশি করতে তাদের বেশ প্রয়োজন। আর সে কারণে রাজধানীর বিভিন্ন সিকিউরিটি সার্ভিস প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে আসা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ভিত্তিতে নারীকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটিসহ বিভিন্ন শপিং মল ও বেসরকারি ব্যাংককে এখন নারীকর্মীদের দেখা যাচ্ছে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে। সাধারণত একজন নারী নিরাপত্তাকর্মীকে কর্মদিনগুলোতে ছয় ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। পুরুষ নিরাপত্তাকর্মীদের থেকে তাদের বেতনও কিছুটা বেশি। এ প্রসঙ্গে রাজধানীর এক মার্কেটের নারী নিরাপত্তাকর্মী রিনা আক্তার বলেন, ‘ইউনিফর্ম পরে আমাকে টানা কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ পেশায় আসার জন্য আমার পরিবার আমাকে উৎসাহিত করে। প্রথমে দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা কষ্ট হলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।’ ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন সিকিউরিটি সার্ভিসের কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে পাওয়া চাহিদা অনুযায়ী নারী নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়োগের ব্যবস্থা করি। যেসব জায়গায় নারীদের যাতায়াত বেশি, সে প্রতিষ্ঠানগুলোই নারীকর্মীদের নিয়োগ দিয়ে থাকে।’ এমনকি আন্তর্জাতিক হোটেলগুলোর সঙ্গে মিল রেখে এখন ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে নারীকে অভ্যর্থনাকর্মীর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনের প্রবেশমুখে সদা হাস্যোজ্জ্বল এক নারী নিরাপত্তাকর্মীকে দেখা যায় অতিথিদের স্বাগত জানাতে। ব্যতিক্রমী ইউনিফর্ম পরিহিত এ নারীকর্মী হোটেলে আসা অতিথিদের প্রবেশমুখে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। ইতিমধ্যে এ হোটেলের অতিথিদের দৃষ্টি কেড়েছেন এ নারী অভ্যর্থনাকর্মী। বাংলাদেশের মেয়েরা বহু আগে থেকেই গাড়িচালনায় জড়িত। তবে এবার তারা চালক নয়, গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ঠিক করার কাজ শুরু করেছেন। নারীদের মোটরসাইকেলের যাবতীয় সার্ভিসিংয়ের কাজ শেখানোর জন্য বগুড়ার মহিলাবিষয়ক অধিদফতর একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর মাধ্যমে গাড়ির মেকানিক হিসেবে কাজ শেখানোর জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ ও স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার নারীদের দেওয়া হয় এ প্রশিক্ষণ। গত বছর আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশের নারীরা বাণিজ্যিক জাহাজে নাবিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, যা দেশে প্রথম। আর প্রথম ব্যাচে মোট ১৩ জন নাবিক বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বিভিন্ন জাহাজে মেরিন অফিসার পদে যোগ দেন। এর আগে ডিসেম্বরে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষ করেন তারা। এদিকে প্রথমবারের মতো মোট ৮৭৯ জন নারী সৈনিক পেয়েছে বাংলাদেশ। টানা এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষে ২৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের শহীদ বীরউত্তম প্যারেড গ্রাউন্ডে নিজেদের সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে তারা সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঘাটাইল সেনানিবাসে কুচকাওয়াজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে নারী সৈনিকরা জানান, সব জেনেই তারা কঠিন কিন্তু গৌরবজনক এ পেশা বেছে নিয়েছেন। এ জন্য যদি জীবন দিতে হয়, এর পরও দায়িত্বের খাতিরে পিছিয়ে যাবেন না তারা। সৈনিক হ্যাপী খাতুন বলেন, ‘সৈনিক হিসেবে শপথ নিতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আমাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। আরও দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে আমরা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসের সামরিক হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের সহযোগী হিসেবে কাজ করব। এ জন্য শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন মৌলিক বিষয়েও শিক্ষা নিচ্ছি।’ আরেক ব্যতিক্রমী পেশায় জড়িত থেকে সাধারণ মানুষদের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন ‘তথ্যকল্যাণী’রা। দেশের বিভিন্ন জেলায় তারা কাজ করছেন। মাথায় সাদা ক্যাপ, আকাশি রঙের কামিজ ও গোলাপি ওড়না-পাজামা পরা এ মেয়েদের পিঠে লেখা ‘তথ্যকল্যাণী’। তাদের কাঁধের ব্যাগে থাকে ল্যাপটপ, মডেম আর স্বাস্থ্যসেবার উপকরণ। সাইকেলে চড়ে আইটিভিত্তিক তথ্য ও প্রযুক্তি সেবা বিক্রি করে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এ নারীদের কারিগরি সহায়তা দিয়ে সাহায্য করছে সেরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্র এবং ঢাকার ডি. নেট ও ফেয়ার প্রাইস ইন্টারন্যাশনাল। তবে চ্যালেঞ্জিং পেশার পাশাপাশি নারীরা যে কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গেও জড়িত এর প্রমাণ কৃষক নারী। নারীশ্রমিকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ কৃষিকাজে জড়িত। এক জরিপে জানা যায়, ফসল উৎপাদনে নারীর সক্রিয় অবদান ২৭ ভাগ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে, গ্রামীণ ৪১ শতাংশ নারী আলু চাষের সঙ্গে জড়িত, ৪৮ শতাংশ জড়িত মাছ চাষে। এ ছাড়া গ্রামীণ নারীরা বীজ বপন থেকে শুরু করে জমিতে সার দেওয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, ধান কাটা, ধান থেকে চাল পাওয়ার প্রক্রিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত তারা।

সর্বশেষ খবর