শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকরা নরক যন্ত্রণায়

জিন্নাতুন নূর

মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকরা নরক যন্ত্রণায়

উন্নত জীবনের আশায় প্রতি বছর পরিবার-পরিজন ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে দেশ ছাড়ছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি নারী শ্রমিক। কিন্তু দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর খপ্পরে পড়ে তারা একদিকে যেমন সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সহ্য করছেন নরক যন্ত্রণা।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গৃহশ্রমিক, নার্স, পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজের জন্য আকর্ষণীয় বেতন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারীদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হলেও তাদের মূলত দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি সেসব দেশের গৃহকর্তারাও বাংলাদেশি নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাচ্ছেন। প্রতিবাদ করলেই নারী শ্রমিকদের ওপর নেমে আসছে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। জানা গেছে, বেতন না দিয়েই দিনের পর দিন তাদের অভুক্ত পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা প্রবাসে ভালো আছেন কিনা— তা তদারকির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেই। এমনকি সেই দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতাও নারীরা পাচ্ছেন না। ফলে বিদেশে অভিভাবকহীনভাবে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে এ দেশের নারী শ্রমিকদের।  

সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, সিরিয়ায় কর্মী পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি যৌন ও গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রির জন্য বাংলাদেশ থেকে নারীদের যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় পাচার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে র্যাবও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। র্যাবের তথ্যে, অন্তত ৪০ জনের অধিক নারীকে সিরিয়ার পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত এই নারীদের ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে। সূত্রমতে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশের নারীদের যৌনদাসী হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে সিরিয়া, লেবানন, সৌদি আরব, জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশে নারী পাচারের ঘটনা ঘটছে। পাচার হওয়া নারীদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে বর্তমানে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন। বিদেশ ফেরত বেশ কয়েকজন নারী এই প্রতিবেদককে জানান, তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে দিনের পর দিন স্বল্প আহারে অভুক্ত রাখা হতো। অনেকেরই সেখানে বন্দী অবস্থায় দিন কাটছে। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না দেশে থাকা তার আত্মীয়স্বজনরা। কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। আবার প্রাণ হাতে নিয়ে যারা দেশে এসেছেন তাদের অনেকেই গুরুতর অসুস্থ। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। নারী পাচার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী শ্রমিকদের বিদেশে অবস্থান কেমন— তা নজরদারি করার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। এ ক্ষেত্রে জনবলেরও স্বল্পতা আছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগের থেকে বিদেশে নারী শ্রমিকদের যাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য দু-একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা জানতে পেরেছি সৌদি আরব হয়ে অবৈধভাবে নারীদের জর্ডান পাঠানো হচ্ছে। তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তিনি আরও জানান, সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে মেগা কোম্পানির সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়েছে। তারা ‘বাংলাদেশি নারীরা ভালো আছেন কিনা’— তার তদারকি করবে।  এদিকে সিরিয়া ফেরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে তাদের মতো অন্তত কয়েকশ’ বাংলাদেশি নারীকে যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব নারীর অনেককেই লেবাননে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সিরিয়ায় নেওয়া হয়। সিরিয়ার কিছু বাংলাদেশিও এই যৌন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেখানে বাংলাদেশি নারীদের সঙ্গে ইন্দোনেশীয়, নেপালি ও পাকিস্তানি নারীও ছিল। এমনকি যেসব বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মের কাজ করতেন তারাও বাড়ির পুরুষদের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন। প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। তাদের কাছ থেকে দুই ঘণ্টা ঘুমের বিশ্রাম, নিয়মিত খাবার না দেওয়া এবং বেতন না দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। অথচ এই নারীরা কমবেশি নিজেদের কষ্টের জমানো টাকা দালালদের দিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন উন্নত জীবনের আশায়। এ জন্য কমপক্ষে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা দালালকে দিতে হয়েছে। জানা যায়, সিরিয়ায় নেওয়ার কয়েকদিন পরই স্থানীয় দালালরা তাদের বিক্রি করে দিত। এরপর তাদের ওপর নেমে আসত অমানুষিক নির্যাতন। এর ফলে অনেক নারী প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিত্সা নেন। প্রবাস ফেরত কয়েকজন নারী বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে বলেন, কাজ করতে গিয়ে তারা কম বেতন বা না দেওয়া, অতিরিক্ত কাজের চাপ, ভাষাগত সমস্যা, মালিক কর্তৃক শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি হন। জানতে চাইলে দেশে ফেরত এক প্রবাসী নারী শ্রমিক সাবিনা বলেন, সংসারের খরচ জোগাড় করতে তিনি জর্ডানে কাজ করতে যান, কিন্তু তার মালিক তাকে প্রায়ই নির্যাতন করতেন। এমনকি দেশে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও দেওয়া হতো না। তিনি অসুস্থ স্বামীর জন্য টাকা চাইলে তাকে তা দেওয়া হয়নি। প্রায়ই সাবিনাকে মারধর করা হতো। গায়ে গরম পানি ঢালা হতো। খাবার পর্যন্ত খেতে দেওয়া হতো না। তাকে কুকুরের খাবার খেতে দেওয়া হতো। এভাবে এ নারী শ্রমিককে ৬ মাস আটকে রাখা হয়। এরপর সাবিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ওপর দেড় বছর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। সাবিনা জানান, এ ব্যাপারে জর্ডান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে তেমন সাহায্য করা হয়নি। উল্টো দুই বছর পর যোগাযোগ করতে বলা হয়। পরে (বিএমইটি) কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সাবিনা দেশে ফিরে আসেন। জানা যায়, সিরিয়ায় পাচার হওয়া নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে। এ ছাড়া র্যাব-৩ এ বিষয়ে পল্টন থানায় মামলাও করেছে। র্যাব-৩ এর অধিনায়ক খন্দকার গোলাম সরোয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে সিরিয়ায় পাচার হওয়া নারীদের শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের নারী শ্রমিকদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানো উচিত নয়। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কর্মে পাঠালে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো সম্ভব। তিনি আরও বলেন, ভালো রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নারী পাচারের ঘটনায় সম্পৃক্ত নয়, কিন্তু কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি সরকারের কাছ থেকে লাইন্সেস নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ অবৈধ চক্রের সঙ্গে মিলে নারী পাচার করছে। এদের সংখ্যাই বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে পাচার হওয়া এক বাংলাদেশি নারীর দাম প্রায় তিন লাখ টাকা। বাংলাদেশের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে নারী পাচার কাজে জড়িত। র্যাব জানায়, এরই মধ্যে আল রাবেতা, আল হাসিব ইন্টারন্যাশনাল, সিকদা ট্রাভেলস, বাংলাদেশ এক্সপার্ট করপোরেশন, হাসান ইন্টারন্যাশনাল ও নামিরা ওভারসিজের নামে পাচার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া  গেছে।

জানা গেছে, জর্ডান হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাঠানো অনেক নারী শ্রমিকের খোঁজ পাচ্ছেন না তাদের পরিবার। এ অবস্থায় সম্প্রতি জর্ডানে নারী শ্রমিকদের পাঠানো একটি রিক্রুটিং এজেন্সি এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ও সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করে র্যাব। র্যাব জানতে পেরেছে, সংঘবদ্ধ চক্র প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে মহিলা গৃহকর্মী পাঠানোর নামে তাদের দিয়ে জোরপূর্বক দেহ ব্যবসা করাতে বাধ্য করছে। সূত্র বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রবাসী নারীরা এসব বিষয়ে নানা অভিযোগ করলেও এগুলোর নিষ্পত্তির সংখ্যা হতশাজনক। সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে মোট ৭৬ হাজার অভিযোগ দাখিল হয়। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৪৮টি অভিযোগ।

সর্বশেষ খবর