কিছু অপেশাদার ও উচ্চাভিলাষী সদস্য পুরো পুলিশ বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান। তিনি বলেন, বাহিনীর যারা অপেশাদার আচরণ করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঊর্ধ্বতন পুলিশের অনেক কর্মকর্তা পলাতক রয়েছেন। পুরোপুরি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করতে আরও কিছু সময় লাগবে। বিশেষ কোনো জেলার সদস্যদের দিয়ে ডিএমপি পরিচালিত হবে না, ডিএমপি পরিচালিত হবে পেশাদার কর্মকর্তাদের দিয়ে। ডিএমপিকে ঢেলে সাজানো হবে। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারি দিয়ে ঢাকা মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চেষ্টা করে যাব। ঢাকা আপনার-আমার-সবার প্রিয় শহর। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজে অংশ নেবেন না। যে যেখানে আছেন সবাই আইন ও বিধি মেনে চলুন। ডিএমপি সব সময় আপনাদের পাশে আছে। একই সঙ্গে আমরা আপনাদেরও সহযোগিতা কামনা করি। ডিএমপিপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের অত্যন্ত সংকটকালে আমি ডিএমপি কমিশনার হিসেবে যোগদান করেছি। বিগত সময়ের উচ্চাভিলাষী ও অপেশাদার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। এর ফলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান এবং বিগত সরকারের পতন ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। ডিএমপিসহ সারা দেশে অনেক পুলিশ সদস্য আহত এবং নিহত হয়েছেন। প্রাণভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। অনেক স্থানে আমাদের অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। ট্রাফিকের প্রায় সব অফিস ও বক্স ভাঙচুর হয়েছে। ডিএমপির ৫০টি থানার মধ্যে ২২টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে। এ ধরনের ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন পুলিশ বাহিনী ইতঃপূর্বে কখনো হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করি যাতে পুলিশ সদস্যরা ভয় না পেয়ে দ্রুত কাজে ফিরে আসেন। কিন্তু ইতোমধ্যে কিছু উচ্চাভিলাষী ও অপেশাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাদের ব্যাপক ক্ষোভ জন্মায় এবং নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মবিরতি শুরু করেন। তাদের দাবিগুলো পর্যালোচনা করে কিছু তাৎক্ষণিক সমাধান করা হয়। বাকিগুলো দ্রুততম সময়ে মেটানোর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদস্যরা তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসেন এবং পুলিশি দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ সংকটকালে ভগ্ন মনোবলের পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগদানের ভীতি দূরকরণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দেশের প্রতিটি থানায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। তাদের উপস্থিতির ফলে ভীতসন্ত্রস্ত পুলিশ সদস্যসহ জনমনে আস্থা ফিরে আসে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় আমরা ঢাকা মহানগর এলাকায় সব থানার কার্যক্রমসহ ট্রাফিক ও অন্য সব বিভাগের কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে সচল করতে সক্ষম হই। এজন্য সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর সব স্তরের সদস্যকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আমাদের এ সংকটকালে বিজিবি ও আনসার সদস্যরাও তাদের সার্বিক সহযোগিতা আমাদের দিয়েছেন। এজন্য তাদের সব সদস্য এবং বিজিবি ও আনসার মহাপরিচালককে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। এর পাশাপাশি ছাত্র-জনতাসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৭৬ সালে মাত্র ১২টি থানা ও ৬ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়ে যাত্রা করা ডিএমপি নগরবাসীর আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে বর্তমানে ৫০ থানা ও ৩৪ হাজার জনবল নিয়ে ঢাকা মহানগরীর জনগণকে পুলিশি সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ডিএমপি একদিকে যেমন বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে; অন্যদিকে পুলিশি সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। দক্ষতা ও সর্বোচ্চ পেশাদারি দিয়ে ডিএমপির চৌকশ সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও সংঘটিত অপরাধের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে রহস্য উদ্ঘাটন করে নগরবাসীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রচলিত অপরাধের পাশাপাশি কিশোর অপরাধ, অনলাইন জুয়া, সাইবার ক্রাইম, ইকোনমিক ক্রাইম, সোশ্যাল মিডিয়া বুলিং, গুজবসহ নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ ডিএমপি আজ সাহসিকতা ও পেশাদারির সঙ্গে মোকাবিলা করে চলেছে। উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন সাপোর্ট সেন্টারে নারী ও শিশুরা আলাদাভাবে নারী পুলিশ সদস্যদের কাছে তাদের সমস্যার কথা বলতে পারছেন এবং সমাধান পাচ্ছেন। ডিএমপির ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি ডিভিশন সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে দূতাবাস ও সম্মানিত কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। আশা করি ভবিষ্যতেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক এলাকার নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে সক্ষম হব। তিনি বলেন, ট্রাফিক জ্যাম এ মহানগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে একদিকে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা, কার্যকর উদ্যোগ ও অন্যদিকে সব নগরবাসীর অকুণ্ঠ সহযোগিতা, সচেতনতা ও সতর্কতা। ছাত্রছাত্রী-স্কাউট, বিএনসিসিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে ঢাকা শহরসহ সারা দেশে ট্রাফিকব্যবস্থা সামলেছেন। আমরা তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।