নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমান। পাশাপাশি অব্যাহত রয়েছে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি সরকারের প্রতি সমর্থন এবং সমালোচনা উভয় ইস্যুতে সোচ্চার থাকার রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের কারণ দেশেব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সফর ও বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য প্রদান।
১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে জনগণ মানবে না। তাই দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচিত সরকারই ঠিক করবে কী সংস্কার হবে। আবার দুই দিন পর ১৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে এক সভায় তিনি বলেন, আমরা সরকারকে সময় দিতে চাই। বর্তমান সরকার বলছে সর্বত্র দুর্নীতি, দলীয়করণ রাতারাতি সব কিছু ঠিক করা সম্ভব না। সরকারকে আমরা সেই সময়টুকু দিতে চাই। তারা নিরপেক্ষ, আমাদের উচিত তাদের সহযোগিতা করা।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটি শুরু থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে আসছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়েও বিএনপির সমর্থনের কথাও বলছে। কিন্তু এখনো নির্বাচনি রোডম্যাপের ঘোষণা না আসায় বিএনপি নেতারা মনে করেন, এতে এই সরকার তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায় কিনা- তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু না হওয়া এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অগ্রগতি নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। সম্প্রতি গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম পর্যালোচনা বিষয়ে এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করেন, সরকার যেমন গত এক মাসে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দ্রুত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তেমনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানেও তাদের অগ্রাধিকার দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, সেই বিষয় নিয়ে যেভাবে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যায়নি। বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কারে কাজ বেশি হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনে যে রদবদল আনছে তা নিরপেক্ষ হয়নি। প্রশাসনের পরিবর্তনে ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্টরাই থাকছেন। তারা মনে করেন, প্রশাসনের এই রদবদল ছাত্র-জনতার বিপ্লবের বিপরীতমুখী কার্যক্রম। অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দেশের বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময়কালে বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য রাখছেন- এমন কথা জানিয়ে আরেকজন নীতিনির্ধারক বলেন, এতে দলের তৃণমূলে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কোনোভাবে তারা অস্বীকার করেন না। তবে তাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই আন্দোলন বহু বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও। সুতরাং ছাত্র সমন্বয়কদের এমন বক্তব্য দেওয়া উচিত হবে না- যাতে তাদের বিষয়ে ভুল ধারণা তৈরি হয়। বিএনপির নির্বাহী কমিটির নেতারা বলছেন, প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ‘সুদিনে ফেরার পথে’ নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে দলটি। তাই বর্তমান সরকারের দেশ পরিচালনায় প্রথম এক মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে হতাশ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। এ সময়ের মধ্যে সরকারের গৃহীত বেশ কিছু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট নন দলটির শীর্ষ নেতারা। তবে আপাতত হতাশ হলেও চাপে রাখতে রাজপথে থাকার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। সভা-সমাবেশ থেকে সমর্থন ও সমালোচনা উভয়ই করে যাবে। দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির বড় অংশই চায়, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সংস্কারকাজ সম্পন্ন করবে। এর বাইরে সংবিধান সংশোধনসহ রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জাতীয় সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে করার পক্ষে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ পরিস্থিতিতে সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়ন করে রাজপথে থেকে সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে বিএনপি। সরকারকে সমর্থনের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ছাড়াও রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে দাবি নিয়ে মাঠে থাকাবে তারা। এর অংশ হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে মঙ্গলবার ঢাকাসহ দেশব্যাপী সমাবেশ করে দলটি। আবার বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এটাও চান না যে, বর্তমান সরকার বিএনপির কর্মকাে যেন অখুশি হয়। আবার এ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে বসে থাকুক তাও চায় না বিএনপি। তাই বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন ও সমালোচনা উভয়ই করে যাবে দলটি। সমালোচনার প্রধান ইস্যু হবে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি।