শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
‘আমি সবার আগে কবি’

বব ডিলানের নোবেল প্রাইজ

আন্দালিব রাশদী

বব ডিলানের নোবেল প্রাইজ

সারা মারিয়া দানিউস সুইডিশ একাডেমির পার্মানেন্ট সেক্রেটারি পদে বসে সাহিত্যের মানচিত্রটি কি লণ্ডভণ্ড করে ফেললেন? বোমাবাজরা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, ভবিষ্যতেও হয়ত পাবেন। এটা গা-সহা হয়ে গেছে। সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারেও বড় মাপের লেখকদের বঞ্চিত করার অভিযোগ সুইডিশ একাডেমিকে হজম করতে হয়েছে। লেভ তলস্তয়কে উপেক্ষা দিয়েই নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে যাত্রা শুরু। তারপর সাহিত্যের মূল ধারাতেই পুরস্কারটি বিচরণ করেছে। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো বিশ্ব প্রতিভাকে যখন সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয়, রাসেলের যোগ্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি; প্রশ্ন করেছেন দার্শনিককে কেন?

উইনস্টন চার্চিলকে যখন সাহিত্যের পুরস্কারটি দেওয়া হলো, তিনি যে গ্রন্থই লিখে থাকুক না কেন তার মুখ্য পরিচিতি রাজনীতিবিদ—প্রশ্ন উঠল রাজনীতিবিদকে কেন? ২০১৫-তে বেলারুশিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক স্ফেওলানা আলেক্সিয়েভকে যখন নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করা হলো, প্রশ্ন উঠল সাংবাদিককে কেন? এবার আগেভাগই সারা মারিয়া দানিউসের প্রভাব এবং মূলধারার বাইরে তার যাওয়ার প্রবণতার কথা সন্দিহান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হলো।

সারা নন্দনতত্ত্বের অধ্যাপক, ৩০ বছর ধরে সুইডিশ দৈনিক Dagen Nyheter পত্রিকার সাহিত্য সমালোচক। তার প্রধান কাজ মার্শেল গ্রুস্ত, গুস্তাভ ফ্লবেয়র এবং জেমস জয়েসকে। ২০১৩-তে সুইডিশ একাডেমিতে যোগ দেন এবং ১ জুন ২০১৫ একাডেমির পার্মামেন্ট সেক্রেটারি পদে যোগ দেন। সারার বিচরণ সাহিত্যের মূল ধারাতেই। কিন্তু ২০১৫ তে মনে হয়েছে মূলধারাটি সম্পর্কে আমাদের পিউরিট্যান ধারণাটির বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। সাহিত্য আরও বহুকিছুকে ধারণ করতে পারে। ২০১৬-র নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন বব ডিলান। এ ঘোষণার পর এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে ফেলতে হবে অথবা সাহিত্যের নতুন কোনো সংজ্ঞা ও অধিক্ষেত্র একাডেমিকে জানানোর অনুরোধ করতে হবে।

সংগীতশিল্পীদের মধ্যে যদি কাউকে বেছে নেওয়ার প্রশ্ন আসে তাহলে বব ডিলান অবশ্যই শ্রেষ্ঠতম পছন্দ। সারা দানিউস ঠিকই বলেছেন গান হচ্ছে ‘কানের কবিতা’। নিঃসন্দেহে বব ডিলান সংগীত জগতের উজ্জ্বলতম আইকন এবং নোবেল সাইটেশনে যা বলা হয়েছে আমেরিকার মহান সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য নতুন কাব্যিক প্রকাশ সৃষ্টির জন্য তাও পুরোপুরি সত্য। তবে পার্মামেন্ট সেক্রেটারি আশা করেছেন এবার আর সুইডিশ একাডেমির চূড়ান্ত বাছাই নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না। তাই যদি হয় মার্কিন সংগীতের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, যার পর্বতপ্রমাণ কীর্তির কাছে বব ডিলানের ভাষায় তিনি ছোট্ট ঢিবিও নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নামও কেউ উচ্চারণ করলেন না, গোষ্ঠীগতভাবে বিটলসরাও উপেক্ষিত হলেন। বব ডিলান গীতিকার ও গায়ফ দুই-ই।

গানের প্রভাব কতটা তীব্র ও সুদূরপ্রসারী আমরাই তার সাক্ষ্য দেব। ১৯১৩-র নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিংবা গল্প নয়, উপন্যাস কিংবা মননশীল প্রবন্ধ নয় এখনো জীবন্ত এখনো অমলিন তার গান। ‘সঙ অফারিংস’-এর কিছু আরাধনা গীতিকবিতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে বিচার করার আর কোনো উপাদান একাডেমির সামনে ছিলও না। পার্মামেন্ট সেক্রেটারি আরও বলেছেন, এবারের বাছাইটা তেমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল না।

তা-ই হওয়ার কথা, সাহিত্যের সীমান্ত গীতিকারও শিল্পীর জন্য তুলে দিলে সিদ্ধান্ত সহজ হওয়ারই কথা।

বব ডিলানের পুরস্কার প্রাপ্তিতে বিশিষ্টজনের আহলাদিত টুইট বিশ্ব গণমাধ্যমে এসেছে, তারা তাদের শৈশব ও বব ডিলানের গান নিয়ে স্মৃতিচর্চা করেছেন, যাদের নাম পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়ে থাকে তাদেরও কেউ কেউ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যাদের নিয়ে প্রবল প্রত্যাশা করেছেন তাদের ভক্ত পাঠক ও প্রকাশক সেই গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, আদুনিস, মিলান কুন্দেরা, ইসমাইল কাদারে, ফিলিপ রথ, কো উন, হাভিয়ার মারিয়াস, জন ফসে, অ্যামোস ওজ, সিস নুটবুম এবং অবশ্যই হারুকি মুরাকামি—সবার প্রতীক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে যাবেন, যেমন ক’মাস আগে বেরিয়ে গেছে উমবার্তো একো।

‘মূলধারা’-র সাহিত্যিকরা হয়ত আরও পিছিয়ে যেতে পারেন। কোনো সন্দেহ নেই নবীন প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হ্যারি পটারের সঙ্গে পরিচিত। হ্যারি পটারের স্রষ্টা কেন থাকবেন নোবেল পুরস্কারের বাইরে? পোকেমন নামের ফিকশনাল প্রাণী চরিত্রের প্রণেতা সাতোশি তাজিরি কেন বাদ পড়বেন? থ্রিলার ক্রাইম, রোমাঞ্চ ফিকশনের লেখকও হবেন যোগ্য দাবিদার। ডেভিড ফ্রস্ট, ওরিয়ানা ফেলাসি (দুইজনই প্রায়ত)-র মতো সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী? সাহিত্যের সীমান্ত খুঁটিগুলো কেউ উপড়ে ফেলছে না তো?

বব ডিলানকে অভিনন্দন : বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের বন্ধু বব ডিলান। ১ আগস্ট ১৯৭১ ম্যাডিসন স্কয়ারে বাংলাদেশ কনসার্টে তিনি গান গেয়েছিলেন। তার যে কোনো সুকৃতিতে আমরা আনন্দিত। সংগীতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলো তিনি আগেই পেয়েছিলেন। হৃদয়ছোঁয়া গীত রচনা গাওয়ার জন্য পেলেন ২০১৬-র নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। বব ডিলানের আগে একজন লেখকই একই সঙ্গে অস্কার পুলিত্জার ও নোবেল বিজয়ী। তিনি নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ (২৬ জুলাই ১৮৫৬-২ নভেম্বর ১৯৫০)। ১৯২৫-এ পান নোবেল পুরস্কার এবং ১৯৩৮-এ পিগম্যারিয়ন নাটকের ওপর ভিত্তি করে চিত্রনাট্য রচনার জন্য অস্কার লাভ করেন। আর বব ডিলান ১২ বার গ্র্যামি, একবার অস্কার, একবার স্পেশাল পুলিত্জার, একবার গোল্ডেন গ্লোব এবং সর্বশেষ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। প্রথম গ্র্যামি আসে ১৯৬৪-তে উই শ্যাল ওভারকাম গানের জন্য, ২০০০ সালে থিঙ্গস হ্যাভ চেঞ্জড গানের জন্য অস্কার, ২০০১ সালে একই গানের জন্য গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড পান। ২০০৮-এ পান স্পেশাল পুলিত্জার। ১১৫ বছরে ১১৩ জন সাহিত্যে নোবেল লরিয়েট-সংগীত শিল্প একজনই—এ জন্যও বব ডিলান অভিনন্দন পেতে পারেন। তবে পুরস্কার ঘোষণার পর কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও তিনি মুখ খুলেননি। তিনি কি পুরস্কার পেয়ে বিব্রত?

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় সেইন্ট মেরি হসপিটালে ২৪ মে ১৯৪১ সালে এক ইহুদি পরিবারে বব ডিলানের জন্ম। তার জন্মকালীন নাম রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান। বাবার দিক থেকে বাবার পিতামহ জিগম্যান জিমারম্যান এবং পিতামহী আন্না জিমারম্যান ইহুদি হত্যাযজ্ঞের পর ১৯০৫ সালে ইউক্রেন থেকে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করেন। বাবা আব্রাম জিমারম্যান পোলিও রোগী ছিলেন। দারিদ্র্য ছিল বব জিমারম্যানদের নিত্যসঙ্গী। স্থানীয় লুইজিয়ানা স্রেভগোর্ট রেডিও স্টেশনের গান শুনতে শুনতে নিজেকে তৈরি করেন। হিব্বিং হাইস্কুলে পড়ার সময় শুনেন লিটন রিচার্ড এবং এলভিস প্রিসলের গান। নিজেই স্কুলে গড়ে তোলেন মিউজিক্যাল ব্যান্ড। এক সময় নিজের নামের ওপর কাঁচি চালান। প্রথমে বব ডিলন এবং পরে বব ডিলান নামে পরিচিত হতে থাকেন। কলেজ ড্রপ-আউট ডিলান ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে নিউইয়র্কের মঞ্চ মাতিয়ে তোলেন। তার সংগীত গুরু ও আদর্শ উডি গুথরির সঙ্গে দেখা করেন এবং নিজেই প্রতিজ্ঞা করেন গুথরির শ্রেষ্ঠ শিষ্য হয়ে ওঠবেন। তাই হলো। তার হাত ধরে হলো ফোক সঙ্স-এর পুনরুত্থান। ফোক, রক, ব্লুজ, কান্ট্রি এবং গোসপেল—লোক ঘরানার সব অঙ্গন মাতিয়ে রাখলেন বব ডিলান।

যাত্রাপথটি বিশাল—তিনি হয়ে উঠলেন প্রতিবাদের গায়ক। ১৯৬২-তে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম বদলে বব ডিলান হয়ে গিটার হাতে রাস্তায় নামলেন। অ্যাকাউস্টিক গিটার রেখে যখন ফোক গাইতে ১৯৬৫ সালে ইলেকট্রিক গিটার প্লাগ ইন করলেন, খুব প্রতিবাদ হলো, গানের শুদ্ধতা বিনষ্ট করার অভিযোগও উঠল—কিন্তু বব ডিলান মাতিয়ে গেলেন উত্তর আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত।

প্রতিবাদের অন্য নাম হয়ে উঠল বব ডিলান। তারপর এক সময় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। পড়ে রইলেন শুধু গান আর গান নিয়ে। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা এলভিস প্রিসলে জন লেনন— এমনই উচ্চতায় পৌঁছে গেলেন ষাটের দশকের প্রতিবাদী তরুণ। একটার পর একটা গান লিখে চললেন, উদ্ধার করতে থাকলেন হারিয়ে যাওয়া লোকসুর। ডিলানের অ্যালবাম বাজারে আসা মানেই দেখতে দেখতে বিক্রি ছাড়িয়ে যায় মিলিয়ন। তার লেখা গানের সংখা হাজার ছুঁই ছুঁই। সাহিত্য সমালোচক ক্রিস্টোফার রিক বব ডিলানের গীতি কবিতাকে এলিয়ট, কিটস ওই টেনিসনের পঙিক্ততে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। বব ডিলান নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেতে পারেন কি না সে বিতর্ক পাশ কাটিয়ে আমরা কি স্বীকার করতে পারি না তিনি আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ লিরিসিস্ট? তিনি বলেছেন, ‘আমি সবার আগে করি।’ নোবেল নিয়ে বব ডিলান নিশ্চুপ, কিন্তু কণ্ঠে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার গান: আই অ্যাম সেন্টিমেন্টাল, সো আই ওয়াক ইন দ্য রেইন—আমার কিছু অভ্যাস আছে যা বদলাতে পারি না। ওই কোণে যাব বলে যাত্রা করে চলে যাই স্পেন। আমাকে এখন বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছ কেন?—হোয়াই ট্রাই টু চেঞ্জ মি নাও? নোবেল প্রাইজ কি আর তাকে বদলাতে পারবে?

হ্যালো আমি বব ডিলান : ফোন বাজছে। রোম শহরে লা রিপাবলিকা পত্রিকার জিনো কাস্তালদো ফোন ধরলেন। এই অনুনাসিক স্বর অন্য কারো হতে পারে না। ‘হ্যালো আমি বব ডিলান।’ এমনটা তো আশা করাও যায় না। গ্রিস থেকে আমাকে ফোন করেছেন বব ডিলান, খুব সংক্ষিপ্ত সফরে ইতালি আসছেন (কাল ন্যাপল, শনিবার পিসা, রবিবার মিলান)। তিনি বললেন, গ্রিসে খুব গরম তবে সব ঠিকঠাক আছে। তিনি অল্প ক’টি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ইতালিতে একবারই ১৯৮৩ সালে। তখন তিনি ঠাট্টা মস্করা করে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। ১০ বছর পর ১৯৯৩-তে আবার একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। এটি ২৪ জুন ১৯৯৩ প্রকাশিত হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারের একাংশ :

প্রশ্ন : আপনার কনসার্টে গানগুলো এমনকি অনেক পুরনো, গানগুলো প্রতিবারই কিছু না কিছু বদলে যাচ্ছে। এত ঘন ঘন কেন বদলাচ্ছেন?

উত্তর : সময় আমাকে প্রতিটি গানের নতুন অর্থ খুঁজে পেতে সাহায্য করে, এমনকি পুরনো গানগুলো। আর এগুলোতে নতুন মানে খোঁজাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। গানের শরীরটা একই থাকে কিন্তু নতুন নতুন পোশাক পরে। তিনি ধীরে ধীরে কথা বলেন এবং স্টেজের চেয়ে অনেক বেশি বোধগম্য, স্টেজে তার বিখ্যাত পঙিক্তকেও নিয়ে দুর্বোধ্য করে তোলেন।

প্রশ্ন : ‘গুড অ্যাজ আই হ্যাভ বিন টু ইউ’—এমন ঐতিহ্যবাহী পুরনো লোকগান কেন রেকর্ড করতে গেলেন?

উত্তর : এটা ঘটনাক্রমে হয়ে গেছে, গান রেকর্ড করার জন্য হাতে সময় ছিল খুবই অল্প। কিন্তু এ গানগুলো আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; বছরের পর বছর ধরে গানগুলো আমাকে অনুসরণ করেছে, আমি এগুলোকে নিজের গানই বিবেচনা করেছি, রেকর্ডের প্রচ্ছদ হিসেবে নয়—আর এ ধরনের লোক ঐতিহ্যের গানে তেমন বেশি অলঙ্কার দরকার হয় না।

প্রশ্ন : অ্যাকাউস্টিক রেকর্ডের কথা বলি—এবার কি আনপ্লাগড গাইবেন? (ইলেক্ট্রিক গিটার বাজাবেন না?)

উত্তর : হ্যাঁ আপনি বলেছেন, হতে পারে, যখন গাইবো তখন দেখা যাবে কি করছি।

(বব ডিলানের ইলেক্ট্রিক গিটার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন ফোক গ্রুপ প্রতিবাদ করেছে।)

প্রশ্ন : আপনার প্রিয় অ্যালবাম কোনটি?

উত্তর : সেই অ্যালবাম এখনো হয়নি।

প্রশ্ন : এরপর আপনার কোন স্বপ্ন সত্যে পরিণত করতে চান?

উত্তর : আমার পরবর্তী সাঙ্গীতিক স্বপ্ন হচ্ছে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের রেকর্ড বের করবো। আমি এর মধ্যেই একটি সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে কাজ শুরু করেছি... একদিন হয়তো...

প্রশ্ন : কখনো কি মনে হয় না আপনি অবগুণ্ঠনে বন্দী? অন্যরা আপনার ওপর লেপ্টে আছে?

উত্তর : আমি কিছু মনে করি না। আমার নিজস্ব পন্থায় প্রতিটি দিন অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন। হ্যাঁ, আমার একটা সময় ছিল, মনে হতো আমি নিজেকে বোঝাতে পারিনি, এটা একটা সমস্যা। কিন্তু আমি এখন আর সেভাবে দেখি না। মানুষ বদলে গেছে, তারা আগে আমাকে যেভাবে দেখতো এখন সেভাবে দেখে না। আমি এখন অনেক স্বাধীন, সীমাবদ্ধ নই।

প্রশ্ন : ধর্ম যখন যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন আপনি একে কীভাবে দেখেন?

উত্তর : সমস্যা হচ্ছে ধর্মের ভিতর অতিরিক্ত রাজনীতি, আগেও তাই ছিল। রাজনীতি বাদ দিয়ে হয় না, সব জায়গাতেই রাজনীতি।

প্রশ্ন : এমনিতেই জানতে চাচ্ছি, ইতালিতে কী হচ্ছে আপনি কি সে সম্পর্কে অবহিত?

উত্তর : আমি জানি, রাজনীতি উপচে পড়ছে।

প্রশ্ন : এখানে কি সংগীত কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?

উত্তর : নির্ভর করছে আপনি কোন সংগীতের কথা বলছেন তার ওপর। সংগীত অবশ্যই সব বাধা ডিঙ্গাতে পারে।

প্রশ্ন : প্রথমবারের মতো আপনি কোন রাজনীতিবিদের জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন। আমি (বিল) ক্লিনটনের কথা বলছি। কেন?

উত্তর : এটা তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরের ঘটনা। আমি তার নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করিনি? এটা কি প্রথমবার? হ্যাঁ হতে পারে, না-ও হতে পারে। তবে তার আগে কেউ আমাকে আমন্ত্রণ জানাননি।

ডিলান তার শৈশবের কথা শোনান, যেখানে সংগীত নিয়ে নাক ছিটকানো হতো এমন পরিবারে বসবাসের সমস্যার কথা বলেন, প্রথম এলভিস প্রিসলির গান শোনার অভিজ্ঞতার কথা শোনান।

 

প্রতিবাদের অ্যানথেম : ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড

কতগুলো রাস্তা অবশ্যই পেরিয়ে এলে একজন মানুষ

তুমি তাকে  মানুষ বলবে?

কতগুলো সমুদ্র অবশ্যই একটি সাদা ঘুঘুকে পাড়ি দিতে হয়

সৈকতে ঘুমে ঢলে পড়ার আগে?

কতোবার কামানের গোলা অবশ্যই ছুড়তে হয়

চিরতরে তা নিষিদ্ধ হওয়ার আগে?

বন্ধু আমার জবাব তোমার বাতাসে ভাসছে

জবাব বাতাসে ভাসছে।

 

হ্যাঁ কতো বছর ধরে পর্বত টিকে থাকতে পারে

সমুদ্র তাকে ভাসিয়ে নেওয়ার আগে?

হ্যাঁ, কতো বছর ধরে মানুষ টিকে থাকতে পারে

স্বাধীনতার সুযোগ পাওয়ার আগে?

হ্যাঁ, কতোবার মানুষ দেখতে পাচ্ছে না ভান করে

মাথা ঘুরিয়ে রাখতে পারে?

বন্ধু আমার জবাব তোমার বাতাসে ভাসছে

জবাব বাতাসে ভাসছে

 

হ্যাঁ, আকাশ দেখার আগে কতোবার

মানুষকে উপরে তাকাতে হয়?

হ্যাঁ, মানুষের কান্না শোনার আগে

মানুষের কতোগুলো কান থাকতে হয়?

বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ কথা জানার আগে

কতো মানুষের মৃত্যু হতে হয়?

বন্ধু আমার জবাব তোমার বাতাসে ভাসছে

জবাব বাতাসে ভাসছে।

 

বব ডিলান ১৯৬২ সালে এই গানটি লিখেন। এ বছর ব্রডসাইড ম্যাগাজিনের মে সংখ্যায় তা ছাপা হয়। যুদ্ধ, স্বাধীনতা ও শান্তি নিয়ে কতগুলো মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে গীতিকার তার জবাব চান। সব প্রশ্নের একটাই জবাব। বন্ধু আমার জবাব তোমার বাতাসে ভাসছে।

১৯৬৩-র দ্য ফ্রিহুইলিন বব ডিলান অ্যালবামের সাইড ওয়ানের এটিই প্রথম গান। সাইড-টুর প্রথম গান ‘ডন্ট থিঙ্ক টোয়াইস, ইটস অল রাইট’। এই অ্যালবামের আরও কয়েকটি স্মরণীয় গান : গার্ল ফ্রম দ্য নর্থ কান্ট্রি, বব ডিলান’স ড্রিম, হানি জাস্ট অ্যালাও মি ওয়ান মোর চাঞ্ছ এবং আই শ্যাল বি ফ্রি। ‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’ প্রতিবাদের গান হিসেবে বিশ্বমানবের কণ্ঠের গান হয়ে ওঠে, মানবাধিকার কর্মীরা গানটিকে লুফে নেয়। গানটির থিম উডি গুথরির আত্মজীবনী ‘বাউন্ড ফর গ্লোরি’ থেকে নেওয়া হতে পারে।

১৯৬২-র জুনে গানটি যখন ‘সাইন আউট’ ম্যাগাজিনে পুনঃপ্রকাশিত হয়, সঙ্গে যোগ হয় বব ডিলারের মন্তব্য : এই গান নিয়ে আমার বেশি কিছু বলার নেই, কেবল ‘বন্ধু আমার জবাব তোমার বাতাসে ভাসছে’। এটা জবাব বইপত্র, সিনেমা, টিভি শো কিংবা ডিসকাশন গ্রুপে পাওয়া যাবে না— কারণ জবাব বাতাসে ভাসছে।... আমি এখনো বলি, তারাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অপরাধী যারা অন্যায়টাকে দেখে এবং জানে এটা অন্যায় তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। আমার বয়স মাত্র ২১ বছর, আমি জানি এমন অনেক নজির আছে... আপনারা যার একুশোর্ধ আপনারা বড় এবং স্মার্ট।

অ্যালবামটি ১৯৬৩-র মে-তে প্রকাশিত হলেও গানটি রেকর্ড করা হয় ৯ জুলাই ১৯৬২। ১৯৬০ দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সর্বজাতীয় সংগীতে পরিণত হয় বব ডিলানের ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড। বাজারে আসার প্রথম সপ্তাহে তিন লাখ কপি বিক্রি হয়।১৯৬৩-র জানুয়ারিতে বব ডিলান বিবিসি টেলিভিশনে গানটি গেয়ে শোনান। রেকর্ড বের হওয়ার পর তিনি যখন শুনলেন ৫ হাজার ডলার পাবেন, তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন। শুরুতে তিনি একবেলা গান গেয়ে পেয়েছেন একটি ডলার এবং একটি চিজ বার্গার। ১৯৭১-র ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কোয়ারে বাংলাদেশ কনসার্টে বব ডিলানের প্রথম গান এটিই-ব্লোইন ইন দ্য উইল্ড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর