শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

উন্নতি সত্ত্বেও আমাদের সমাজ আরও অসম

উন্নতি সত্ত্বেও আমাদের সমাজ আরও অসম

অধ্যাপক রেহমান সোবহান (জন্ম ১২ মার্চ ১৯৩৫) বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর প্রতিষ্ঠাতা, বিআইডিএসের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে সিপিডির সভাপতি। ৪২টি মনোগ্রাফসহ বিভিন্ন জার্নালে দুই শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৮ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক।

গুণী এই অর্থনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনার জন্ম কলকাতায়। আপনার শৈশব সম্পর্কে কিছু বলুন।

কলকাতায় শৈশব ছিল আনন্দময়। তবে ৭ থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত বছরের নয় মাস কাটিয়েছি দার্জিলিংয়ে বোর্ডিং স্কুল সেন্ট পলেস। আমি পড়তে, ছায়াছবি দেখতে আর খেলাধুলায় অংশ নিতে খুব পছন্দ করতাম। সেন্ট পলেস আমি দূরপাল্লার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ফুটবল, হকি ও মুষ্টিযুদ্ধেও নাম করেছি।

 

ক্যামব্রিজে পড়ালেখার সময় আপনার দিনগুলো কীভাবে কেটেছে। সেখানে তো আজকের স্বনামখ্যাতদের অনেকের সঙ্গেই আপনার বন্ধুত্ব হয়েছিল যেমন অমর্ত্য সেন, মনমোহন সিং...

আমার পরিচিতি গড়ে তোলা, পেশাজীবন বেছে নেওয়া আর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্যামব্রিজের দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এ বিষয়ে আমার স্মৃতিচারণামূলক বই ‘আনট্র্যাঙ্কুইল রিকালেকশন্স : দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট’-এ বিশদ লিখেছি। আমার সমসাময়িকদের মধ্যে ছিলেন অমর্ত্য সেন, মনমোহন সিং, জগদীশ ভগবতী ও মাহবুবুল হক। পরবর্তীকালে তারা সুখ্যাত হয়েছেন। অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার জয় করেছেন। ১০ বছর ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন মনমোহন সিং। ক্যামব্রিজে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল অমর্ত্য সেনের সঙ্গে। সেখানে ক্যামব্রিজ মজলিসে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলাম। ওই মজলিসের সভাপতি ছিলাম আমি, কোষাধ্যক্ষ অমর্ত্য সেন। ওই দিনগুলো থেকেই অমর্ত্য তার চমৎকার গুণাবলির পরিচয় দিচ্ছিলেন; অর্থনীতিবিদ হিসেবেই শুধু নয়, উদার ও অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যতিক্রমী বুদ্ধিজীবী হিসেবেও।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি যোগ দেন ১৯৫৭ সালে। আপনার শিক্ষকতা জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলির কিছু যদি বলেন...

আমার জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা তাত্পর্যময়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেলায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য যে বেড়েই চলছিল তা ১৯৬০-এর দশকে বাঙালিদের গণতন্ত্রের সংগ্রামের অন্যতম ইস্যু হয়েছিল। এসব বিষয় গভীরভাবে বুঝে যথাযথ উপলব্ধির পূর্ণতা অর্জনে সহায়ক হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলাম আমি। বাঙালিদের বঞ্চনাকে কেন্দ্র করে ১৯৬০-এর দশকে উদ্ভূত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিতর্ক প্রভাবিতকরণে এ বিভাগ ভূমিকা রাখে এবং মোনায়েম খানের সরকারের রোষানলে পড়ে।

 

আপনি একসময় পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকা টাইমস ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

প্রধানত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর আমি পাকিস্তান অবজারভার ও ঢাকা টাইমসে নিয়মিত লিখেছি। সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচারের ওপরও লিখেছি। জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলোয় লিখতাম বলেই আমার মতামত ব্যাপক জনগোষ্ঠীর নজর কেড়েছিল। একান্তভাবে পেশাদার পত্রপত্রিকায় লিখলে অমনটা হতো না।

 

১৯৬০ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার ওপর এক সেমিনারে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের যে প্যানেল অংশ নেয় তাতে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম আর আপনিও ছিলেন। কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল?

পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশন ১৯৬১ সালের গোড়ার দিকে অন্য অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নূরুল ইসলাম ও আমাকে সম্প্রতি প্রকাশিত দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার ওপর আলোচনার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে আমন্ত্রণ জানায়। আমাদের তখন একেবারে তরুণ বয়স। তবু অর্থমন্ত্রী, সরকারের সিনিয়র সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিতর্ক করার সুযোগ আমাদের দেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনার সমালোচনা আর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অন্যায় আচরণের বিষয়গুলো আমরা তুলে ধরেছিলাম। আমাদের যুক্তিতর্কের কারণে কিছুর যে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল তা কিন্তু নয়। তবে পাকিস্তানের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনার সময় আমাদের অসন্তুষ্টিগুলো প্রকাশ করার সুযোগ আমাদের দেওয়া হয়েছিল।

 

আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন এবং এ আন্দোলনের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা/জনসমর্থনকে অনুপ্রাণিত করেছে আপনার লেখা

অর্থনৈতিক বৈষম্য আর এর প্রতিকার নির্ধারণের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ড. এ সাদেক, ড. হাবিবুর রহমান, নূরুল ইসলাম, আখলাকুর রহমান, মোশাররফ হোসেন ও আনিসুর রহমানের মতো বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ লেখালেখি করেছেন। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমাদের ধারণাগুলো বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে সহায়ক হয়েছিল। আমাদের কেউই    অবশ্য ওই কর্মসূচির খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে     জড়িত ছিলাম না।

 

উইকলি ফোরাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন আপনি ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত। এতে বাংলাদেশের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ তুলে ধরে লেখা আপনার নিবন্ধগুলো পড়ে ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানি শাসকরা রুষ্ট হয়েছিলেন।

‘ফোরাম’ পত্রিকা ১৯৬৯ সালে চালু করি আমি, কামাল ও হামিদা হোসেন। সামরিক আইনের শাসনের সময় এ পত্রিকায় আমার লেখাগুলোয় দৃঢ়তাপূর্ণ বক্তব্য থাকত। সামরিক সরকার এটা ভালোভাবে নেয়নি। আরও সাবধানে লেখার জন্য বেশ কয়েকবার আমাকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। ওসবকে খুব একটা পাত্তা দিইনি। যা যা প্রয়োজন সবই লিখেছি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা অবধি। জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে ২৫ মার্চ গণহত্যার পর তার হুকুমেই ‘ফোরাম’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন আপনি। সেদিক থেকে নবজাত দেশের আর্থ-সামাজিক বিকাশ পরিকল্পনার রূপরেখা নির্মাণের পথিকৃেদর অন্যতম আপনি। গত চার দশকে ওই পরিকল্পনার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে?

বাংলাদেশের  প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার বেশ কিছু বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ পরিকল্পনা প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে। ওই একই সময়ে জ্বালানি তেলের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বজুড়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এর ফলে আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিক নীতিমালার পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। পরিকল্পনা কমিশনের তিন সদস্য আনিসুর রহমান, মোশাররফ হোসেন ও আমি ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে কমিশন ছেড়ে দিয়ে আবার শিক্ষকতা জীবনে ফিরে গেলাম। ’৭৫ সালের গোড়ার দিকে নূরুল ইসলাম চলে যান অক্সফোর্ডে।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজটা সব সময়ই প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হাতেই থাকে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমরা কমিশনে রইলাম না। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং নভেম্বরে তার ঘনিষ্ঠ চার সহচরকে জেলখানায় হত্যার পর নতুন সরকার কর্তৃক প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা কার্যত পরিত্যক্ত হয়। প্রথম পরিকল্পনায় অধিকতর সমতাভিত্তিক সমাজ গড়বার কৌশল অবলম্বনের প্রস্তাব ছিল। পরবর্তী চার দশকে উন্নয়নের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়ায় অর্থনৈতিক লক্ষ্যাবলি বাজার-চালিত নীতি এজেন্ডা বাস্তবায়নমুখী হয়ে গেছে।

 

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন। ওই স্বপ্নের সঙ্গে আপনিও নানাভাবে জড়িত...

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এগালিটেরিয়ান (সব মানুষের সমান অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত) সমাজ গড়া। বর্তমান দুনিয়ায় আধিপত্য করছে বিকাশমুখী সমাজ নির্মাণের দর্শন। এ দর্শনে প্রধানত বাজার অর্থনীতির দ্বারা চালিত বেসরকারি খাত জোরদার করাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটা তো বঙ্গবন্ধুর দর্শনের পরিপন্থী। স্বীকার্য যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিকশিত হয়েছে, দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু আমাদের সমাজ আরও অসম হয়েছে এবং অংশীদারিত্বও কমেছে। এখানে সুবিধাভোগী শাসক এলিটদের অভ্যুদয় ঘটেছে। এ অবস্থাটা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের দর্শনের উল্টো।

 

আমরা দেখছি, রাজনীতিতে ব্যবসায়ী লোকদের আগমন ও উপস্থিতি বেড়েই চলেছে।

এখন আমাদের সংসদে এবং আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যবসায়ীদের যে আধিপত্য তাতে এলিটপন্থি সমাজের রাজনৈতিক পরিণতিই মূর্ত হয়ে ওঠে।

 

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন যথেষ্ট বলে মনে করেন?

বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার গুরুত্ব থাকবেই। তবে সেই ধারণাগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক পদক্ষেপ আর ফলপ্রদ শাসনব্যবস্থা।

 

বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা তার কতটুকু বাস্তব রূপ নিয়েছে?

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ইতিবাচক অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে। অনেকে আমাদের উন্নতি যতটুকু হবে অনুমান করেছিল আমরা তার চেয়ে অনেক ভালো করেছি। অর্থনীতি আরও বহুমুখী হয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকে আমরা যথেষ্ট এগিয়েছি। আয়-দীনতাও কমেছে। তবে আমরা হয়ে গেছি আরও অসম ও কম ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, যেখানে জোরদার হওয়ার চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে আমাদের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। উন্নয়ন সাফল্যগুলো থেকে পূর্ণ কল্যাণ আহরণ করতে হলে এ অবস্থা পাল্টিয়ে ফেলা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর