বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

গণমাধ্যম ও পুলিশ

মোখলেসুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি

গণমাধ্যম ও পুলিশ

এটিই উপদেশমূলক হয় যে, পুলিশ এবং গণমাধ্যম পারস্পরিক স্বার্থে সম্পর্কযুক্ত অবস্থায় থাকবে। দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য অপরাধজনক তথ্য সরবরাহ করে সহযোগিতা করবে, এটাই পুলিশের কাছে সাংবাদিকদের প্রত্যাশা।  অন্যদিকে পুলিশের এক ধরনের কায়েমী স্বার্থ থাকে যা মিডিয়ার মাধ্যমে ইতিবাচকভাবে জনসম্মুখে তাদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

গণমাধ্যম ও পুলিশ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যা সামাজিক পরিবেশে সমন্বয় সাধন করতে পারে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো জনসমাজের মধ্যে খবর এবং তথ্য প্রচার করে এবং মতবিনিময় সৃষ্টি করে যাতে জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারে এবং নির্ধারিত সময়ে সঠিক তথ্য পেতে পারে। অন্যদিকে পুলিশ প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য কাজ করে যাতে অপরাধ প্রতিরোধ দন্ড বিধান সহজতর হয়।

পুলিশ ও সাংবাদিকদের পেশার ভিতর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনের প্রচ্ছন্ন আবহ রয়েছে। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো খবর প্রকাশ করতে আগ্রহী থাকে না, তারা প্রাপ্ত ঘটনা যাচাই-বাছাই শেষে জনসম্মুখে হাজির করতে চায়। অন্যদিকে সাংবাদিক চান তাৎক্ষণিক টাটকা খবর। একটু বিলম্ব হলেই অন্যের তুলনায় সে পিছিয়ে পড়ে। টাটকা সংবাদ পরিবেশনার মধ্যে রিপোর্টারের আত্মতৃপ্তির বিষয়টি জড়িত ফলে অনেক সময় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে খবরে অতিরঞ্জন ঘটে সত্য-মিথ্যের মিশেল হয়ে যায়। ভুল সংবাদের সাজা হলো পরদিন সংশোধনী প্রকাশ করা কিংবা দুঃখ প্রকাশ করা অথবা সর্বোচ্চ ক্ষমা চাওয়া। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে মিথ্যা সংবাদ সরবরাহ তার জন্য বুমেরাং হতে পারে। বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে পারে এমনকি ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকতে পারে।

পুলিশ ও মিডিয়া এমনই বৈরী সম্পর্কযুক্ত অবস্থা যেখানে দিকনির্দেশনা যথাযথভাবে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে তিক্ততা বাড়ে। পুলিশের প্রবিধান পিআরবিতে পুলিশ মিডিয়া সম্পর্ক নিয়ে কোনো ধরনের গাইড লাইন প্রদান করা হয়নি। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মিডিয়া উইংয়ের গাইড লাইন সময় সময় বিতরণ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে পুলিশ একাডেমি কিংবা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারসমূহে বিস্তারিত মডিউল আছে যেগুলো পাঠদানে অনুসরণ করা হয়। অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি অংশের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন। একাডেমিক আলোচনা যদি উভয়পক্ষ থেকে সূত্রপাত ঘটানো যায় তাহলে জনস্বার্থে সংবাদ পরিবেশন দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা পায়।

পৃথিবীজুড়েই পুলিশ এবং প্রেস সম্পর্কের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, মানসিক টানাপড়েন, গ্রেফতার, আঘাত, প্রতিবাদ হরহামেশাই শোনা যায়। গভীর অনুরাগের মধ্য দিয়ে এদের ভিতরকার সম্পর্ক প্রবহমান থাকবে তা ভেবে রাখা সমীচীন হবে না। আমরা যতই প্রেস-পুলিশ সম্পর্ককে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে চাই না কেন নেতিবাচক ঘটনা পরম্পরা ফলাফলকে সহজ সরল রেখায় প্রবাহিত হতে দেয় না।

গত নভেম্বরে বিবিসি জানিয়েছে, তাদের এক সহকর্মীকে কর্তব্যকালে গ্রেফতার করেছে চীনা পুলিশ। বিবিসির সংবাদদাতা চীনে কভিডবিরোধী বিক্ষোভ কভার করতে গিয়েছিল। বিবিসির তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের কর্তব্যরত সাংবাদিককে মারধর করেছে চীনা পুলিশ। তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে মালদ্বীপের পুলিশ দুজন সাংবাদিককে প্রহার করে প্রকাশ্যে সংবাদ কভার করার সময়। ইউকে পুলিশ গত নভেম্বর মাসে তিন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে যখন তারা জলবায়ুসংক্রান্ত প্রতিবাদের সংবাদ সংগ্রহ করতে যান। মিয়ানমার, ইরানসহ এভাবে উদাহরণ দিতে গেলে সংখ্যা ক্রমান্বয়ে প্রলম্বিত করা যাবে। কমিটি টু প্রটেস্ট (সিপিজে) জার্নালিস্টের বার্ষিক জেল শুমারি মতে, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সাংবাদিকদের বিশ্বব্যাপী কারান্তরালে যাওয়ার ঘটনা ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীব্যাপী সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনাসমূহে বাংলাদেশকেও সংযুক্ত করা যায়। এমন বাস্তবতায় প্রেস-পুলিশে নিরংকুশ সদ্ভাবের ইশারা দেয় না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে হলেও গ্রুপ দুটির মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্ব চোখে পড়ার মতো। এর কারণ তাদের পেশার সাদৃশ্যের জন্য। সংবাদ সংগ্রহ যার যার পেশার কৌশল অনুযায়ী কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যসম্ভার দুই পাশেই গুরুত্বপূর্ণভাবে সমাদৃত। পেশাগত মিল খুঁজতে গেলে অল্প কিছু সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, কমিটমেন্ট : সত্য তথ্য উদঘাটন ও তা প্রকাশ করা। দ্বিতীয়ত, তারা দুই পক্ষই সাধারণ ক্ষেত্রে ট্রাডিশনাল পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। যেমন- কে, কি, কখন, কোথায়, কেন এবং কীভাবে। এ ছাড়াও পুলিশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উদ্ভাবিত টেকনোলজির দ্বারস্থ হয় তদন্তের স্বার্থে। সাংবাদিকরাও স্বতন্ত্র পরিমন্ডলে প্রয়োজনমতো কলাকৌশল তথা টেকনোলজির আশ্রয় নিয়ে থাকেন।

উভয় ক্ষেত্রেই তাদের তথ্য সরবরাহকারী অর্থাৎ সোর্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উভয়েই সত্য জানতে চায়, রহস্য উদঘাটন করতে চায়। উভয়েই প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে ঊর্ধ্বতনের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। পুলিশকে এমনভাবে ফলাফল প্রকাশকারী চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে হয় যা আদালত কর্তৃক অনুমোদিত হয়। অপর পক্ষে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। পুলিশের হাতে এক ধরনের আইন অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পিত থাকে যার দ্বারা নিজেরা বলীয়ান হয়। প্রেস রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নয় বরং জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করে।

একটি সশস্ত্র পেশা ও নিরস্ত্র পেশার মানুষের মধ্যে আমরা যতই বন্ধুত্ব আশা করি না কেন এ দুটোর মধ্যে চরিত্রগত অমিল সতত প্রবাহিত হতে থাকবে। অস্ত্রের নির্মম বল প্রয়োগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার নিরস্ত্র কর্মে নিয়োজিত করা কম কথা নয়। যদিও কেতাবী কথায় পুলিশের অস্ত্র দুষ্টের দমনের জন্য। তদুপরি মানবিক ভুলত্রুটি এমন পর্যায়ে যাতে না চলে যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হতে পারে। এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা পৃথিবীর সর্বত্রই প্রহরীর কাজ করেন। সত্য উদঘাটন করেন এবং মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায় সংঘটনের প্রতিবাদ করেন।

আমাদের দেশের পুলিশের ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ প্রতিনিয়ত আলোচনার টেবিলে থাকে। সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, অনেক ঘটনা প্রবাহ মিডিয়ার কল্যাণে আলোর মুখ দেখে। সমালোচনার উত্তাল তরঙ্গে মনে হয় স্বাধীন দেশের পুলিশ যাদের বীরত্বগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রথম বুলেটের প্রতিরোধে জাতিকে সাহস জুগিয়েছিল সেসবও ম্লান হয়ে যায়। পুলিশ সামগ্রিকভাবে অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশনের বিষয়ে তটস্থ অবস্থায় থাকে। এ অবস্থা তৈরি হয় যখন কোনো বেআইনি সমাবেশ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পুলিশ তার কর্তব্য কর্মের সুবাদে বেআইনি জনতা ছত্রভঙ্গ করার জন্য আইনানুগ বল প্রয়োগের বিষয়টি সংবাদ কভার করার সময় দৃষ্টিভঙ্গিগত ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। সাংবাদিকরা বল প্রয়োগের সময়কার ছবি কিংবা ভিডিও এমনভাবে ধারণ করে যাতে মনে হয় পুলিশ আইন প্রয়োগ নয়, শুধু মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে। ধারণকৃত এসব ছবি, ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ামাত্রই জনমনে পুলিশের প্রতি বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। জনসাধারণ অহেতুক বল প্রয়োগকারী নির্মম ফোর্স হিসেবে পুলিশকে চিহ্নিত করে। যেখানে পুলিশের ওইটুকু বল প্রয়োগ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না কিংবা নিশ্চুপ বসে থাকলে জানমালের ক্ষতি হওয়ার সমূহ সম্ভবনা থাকত। এখানে এক ধরনের উভয় সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। পুলিশে দু-একজন সদস্য জনতার ওপর বল প্রয়োগকালীন হয়তো অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে থাকেন।

স্বাভাবিকভাবে পুলিশের পক্ষে পরিবেশিত হয় না। নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়ে তারা আহতবোধ করেন। সাংবাদিকরা নিজস্ব পেশার মাপকাঠিতে সংবাদ পরিবেশন করেন এটা পুলিশ মানতে পারেন না। পুলিশের অনেকেই মনে করেন সাংবাদিকরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নন। তারা পুলিশের উভয় সংকটজনক অবস্থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন। জনসাধারণকে বৈরী করে তোলেন। এমন ধরনের অভিযোগ যা সাংবাদিকরা বাছ-বিচার ছাড়াই পুলিশের বিরুদ্ধে প্রচারিত করতে থাকে। পুলিশের ধারণা এরকম সংবাদ পরিবেশনা অহরহই ঘটে চলছে যেটার প্রতিকারের কোনো উপায় নেই। পুলিশের পক্ষে প্রায় ক্ষেত্রেই এসবের প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না। ধারণা এমন যে, সাংবাদিকরা ইতিবাচক খবর দেন না। তাদের কাছে খারাপ খবরই হলো ভালো খবর। পরিবেশিত সংবাদের প্রতিবাদ দিলে তার প্রতিকার হয় না বলেই পুলিশের ধারণা। এমতাবস্থায় সাংবাদিকরা যদি পুলিশের সন্নিকটে আসতে চান, তাহলে পুলিশ ভেবে নেয়, তাদের খারাপ খববের অনুসন্ধান চলছে। তাই তারা মনে করেন সাংবাদিক হতে যত বেশি দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।

এরকমের ধারণা অভিপ্রেত নয়। পেশাগত চরিত্রের কারণেই সাংবাদিকরা এস্টাবলিস্টমেন্ট বিরোধী প্রথাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে থাকেন। শুধু পুলিশ-প্রেস সম্পর্কের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য নয়। এটা সর্বজনীন ও বৈশ্বিক।  সব বৈরিতা সত্ত্বেও প্রেস ও পুলিশকে কাছাকাছি থাকতে হবে। হতে হয় একে অপরের পরিপূরক। পুলিশের কাছ থেকে গোপনীয় নয় এমন সংবাদ সংগ্রহের জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ অত্যন্ত কার্যকরী। ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে খুব সহজেই পুলিশকে সংবাদ উৎস করে নেওয়া যায়। পুলিশও পারে বৈরিতার মধ্যেই সাংবাদিককে সফলভাবে বন্ধু করে নিতে।  ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক মিথস্ক্রিয়া অত্যন্ত কার্যকর যা সচরাচর নজরে পড়ে না। উভয়ের স্বার্থে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নিবিড়তর হোক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর