বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ

চপল বাশার, সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক

সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ

সংবাদপত্রবিহীন কোনো দেশ পৃথিবীতে আছে কি? মনে হয় নেই। সবচেয়ে ছোট দেশেও সংবাদপত্র আছে। তা ছোট বা বড়, যে আকারের হোক। সংবাদপত্র ছাড়া একটি রাষ্ট্র বা জাতির অস্তিত্ব বোঝা যায় না।  এ কারণেই সংবাদপত্র জাতির দর্পণ, যাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়।

বাংলাদেশে সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে। এর আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে কলকাতায় ছাপাখানা স্থাপিত হয়। সেখানে ইংরেজি পত্রিকা ছাপা হতো। ঢাকায় পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালে। এটি ছিল ‘ঢাকা নিউজ’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক। পরে ঢাকা ও রংপুর থেকে মোট চারটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। পূর্ববাংলায় প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’। ১৮৭৩ সালে ঢাকা, রংপুর, বরিশাল ও রাজশাহী থেকে মোট ১০টি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র অথবা মাসিক পত্রিকা নিয়মিত বের হতো। ছাপাখানার উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরে পত্রিকার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রথমে অর্ধ-সাপ্তাহিক, পরে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ প্রথম বের হয় ১৮৬৮ সালে যশোর থেকে। যশোরে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় অমৃতবাজারের মালিক ১৮৭১ সালে পত্রিকাটি কলকাতায় নিয়ে যান।

১৯০০ থেকে ১৯৪৭- এই সময়ে পূর্ববাংলায় সংবাদপত্রশিল্প ক্রমেই বিকশিত হয়। পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘জ্যোতি’ বের হয় ১৯২১ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে। আরও বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা ভারত বিভাগের আগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বের হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দৈনিক ‘আজাদ’। মাওলানা আকরম খাঁর উদ্যোগে দৈনিক আজাদ প্রথম ছাপা হয় কলকাতায় ১৯৩৬ সালে। ১৯৪৮ সালে এটি ঢাকায় আনা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আজাদ কয়েক বছর টিকে ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘পয়গাম’ প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। ঢাকা থেকে প্রথম ইংরেজি দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভার’ (পরে বাংলাদেশ অবজারভার) প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। আরও দুটি প্রখ্যাত বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ প্রকাশনা শুরু করে যথাক্রমে ১৯৪৯ ও ১৯৫১ সালে। এ দুটি পত্রিকা এখনো টিকে আছে। পরে ‘মর্নিং নিউজ’, ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (পরে দৈনিক বাংলা) ও ‘পূর্বদেশ’ প্রকাশিত হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বাংলা ও আজাদ। দুটি ইংরেজি দৈনিক ছিল বাংলাদেশ অবজারভার ও মর্নিং নিউজ। চট্টগ্রাম থেকে বের হতো দৈনিক ‘আজাদী’। দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা পরে বাড়তে থাকে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহর থেকেই স্থানীয় দৈনিক প্রকাশিত হচ্ছে।

সরকার দেশে কয়েক শ দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমোদন দিয়েছে। অনুমোদিত দৈনিক পত্রিকার অধিকাংশই নিয়মিত প্রকাশ হয়। তবে সব পত্রিকাই উপযুক্ত মানসম্পন্ন এ কথা বলা যায় না। ঢাকা থেকে বেশ কিছু মানসম্পন্ন দৈনিক প্রকাশিত হয় যেগুলো জাতীয় দৈনিক হিসেবে স্বীকৃত। উন্নতমানের দৈনিক পত্রিকা অবশ্যই জনপ্রিয়তা তথা পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং সে কারণেই টিকে থাকতে পারে। সংবাদপত্রকে পাঠকপ্রিয়তা পেতে হলে জনগণের যত কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব যেতে হবে, তাহলে পাঠকই পত্রিকা বাঁচিয়ে রাখবেন।

প্রিন্ট মিডিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জ

মুদ্রিত সংবাদপত্র তথা প্রিন্ট মিডিয়ার উদ্ভাবন হয় প্রায় ৪০০ বছর আগে ইউরোপে। মুদ্রণযন্ত্রের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বিস্তৃত হয় বিভিন্ন দেশে। মুদ্রণশিল্পের আধুনিকায়ন সংবাদপত্র প্রকাশনার বিস্তারে প্রধান ভূমিকা রাখে। সত্তরের দশকেও বাংলাদেশের সংবাদপত্র লেটার প্রেসে ছাপা হতো। সিসার অক্ষর দিয়ে হাতে কম্পোজ করা হতো পত্রিকার পৃষ্ঠা। সিসার ব্লক তৈরি করে ছবি ছাপানো হতো। পরে অফসেট পদ্ধতির মুদ্রণ সংবাদপত্রের চেহারা পাল্টে দেয়। এরপর আসে কম্পিউটার কম্পোজের যুগ। এতে প্রকাশনার কাজ অনেক সহজ ও সুন্দর হয়। সিসার অক্ষর ও ব্লক এখন ইতিহাস। মুদ্রণশিল্প এখন কম্পিউটার ও অফসেট পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।

মুদ্রণশিল্পের আধুনিকায়ন সংবাদপত্রের গুণগত মান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের সব সংবাদপত্রেই এখন রঙিন ছবি ছাপা হয়। পাঠকের চাহিদা পূরণ ও বিজ্ঞাপন ছাপানোর প্রয়োজনে পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যাও বেড়েছে। পত্রিকা আকর্ষণীয় করার জন্য সংবাদপত্রের প্রকাশক ও সাংবাদিকরা প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করছেন। এতে জাতীয় দৈনিকগুলোর মান উন্নত হলেও অন্য অধিকাংশ সংবাদপত্রের মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। পত্রিকার সংখ্যা বেশি থাকলেই সংবাদপত্রশিল্প উন্নত হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। পত্রিকার সংখ্যা বিবেচ্য নয়, পত্রিকা মানসম্মত কি না তা-ই বিবেচনা করতে হবে।

তিন দশকের বেশি হয়ে গেল ইলেকট্রনিক মিডিয়া বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তানি শাসনামলে বাংলাদেশে একটিমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। সেটি সরকারি টিভি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) নামে সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। নব্বইয়ের দশক থেকে বেসরকারি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের অনুমোদন পেতে থাকে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ৩৫টি টিভি চ্যানেল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সংবাদ সম্প্রচার চালাচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক শুধু খবর ও খবরসংক্রান্ত টকশো প্রচার করে। এ ছাড়া অনলাইন নিউজ, অনলাইন সংবাদপত্র অথবা সংবাদপত্রের অনলাইন এডিশন রয়েছে। টিভির সংবাদ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদপত্রের জন্য অবশ্যই চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সংবাদপত্র টিকে আছে ভালোভাবে।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথা টিভি ও অনলাইন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিলেন প্রিন্ট মিডিয়া দুর্বল হয়ে যাবে। ক্রমেই বিলুপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জনগণ ও পাঠকের কাছে মুদ্রিত সংবাদপত্রের চাহিদা আগের মতোই রয়েছে। করোনা মহামারির সময় অন্য সব কিছুর মতো প্রিন্ট মিডিয়াও একটি ধাক্কা খেয়েছিল। খবরের কাগজের প্রচার সংখ্যা কমে গিয়েছিল। কারণ বহু পাঠক মনে করতেন মুদ্রিত পত্রিকার মাধ্যমে করোনা সংক্রমিত হতে পারে। সে ভয় এখন কেটে গেছে।   পত্রিকার প্রচার সংখ্যা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। করোনাকালে সংবাদপত্র কম থাকায় টিভির খবর এবং অনলাইন নিউজ ঘরবন্দি মানুষ বেশি দেখেছে। কিন্তু এ পরিস্থিতি স্থায়ী হয়নি। মহামারির প্রকোপ প্রায় শূন্যের কোঠায় আসায় পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক, গণমাধ্যমেও তার স্বাভাবিক প্রভাব পড়েছে।

প্রিন্ট মিডিয়াকে টিকে থাকতে হলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই টিকতে হবে। একটি কথা মনে রাখা দরকার, সংবাদপত্রের স্থায়িত্ব আছে। একজন পাঠক একটি পত্রিকা কিনে বারবার পড়তে পারেন যথেষ্ট সময় নিয়ে। পাঠক পত্রিকা সংরক্ষণও করতে পারেন। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সে সুযোগ নেই। টিভির খবর বা অনলাইনে প্রচারিত খবর দর্শক ইচ্ছা করলেই বারবার দেখতে পারেন না। টিভি বা অনলাইন কর্তৃপক্ষ পুনঃপ্রচার করলেই খবরটি আবার দেখা বা শোনা সম্ভব হয়। তা ছাড়া অনলাইন সংবাদ দেখতে হলে মূল্যবান ডিভাইস, মোবাইল ও কম্পিউটার থাকতে হয়। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে এসব থাকে না।  এ কারণেই পাঠকের কাছে সংবাদপত্রের গুরুত্ব থেকেই যাবে।

ভালোভাবে টিকে থাকার প্রয়োজনেই সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মীদের আরও নিষ্ঠার সঙ্গে পত্রিকার মান আরও উন্নত করতে হবে এবং তা বজায় রেখে পাঠকের কাছে পত্রিকাকে আকর্ষণীয় করতে হবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পত্রিকাকে মানসম্মত রাখার বিকল্প নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর