বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিশ্ব ও বাংলাদেশ বাস্তবতা

সশস্ত্র বাহিনী ও নিরাপত্তা সাংবাদিকতা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি, নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

সশস্ত্র বাহিনী ও নিরাপত্তা সাংবাদিকতা

পশ্চিমা সংবাদ জগতের দিকপাল ও আমেরিকান প্রেস ইনস্টিটিউটের নয় বছরের নির্বাহী পরিচালক এবং ‘প্রজেক্ট ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজম’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ১৬ বছরের পরিচালক টম রসেনস্টিয়েল তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবন এবং ব্যাপক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ব্যুরোপ্রধান বিল কভাচকে সঙ্গে নিয়ে ‘দি এলিমেন্টস অব জার্নালিজম : হোয়াইট নিউজ পিপল শুড নো অ্যান্ড দ্য পাবলিক শুড এক্সপেক্ট’ নামে একটি বই লেখেন।  এ বইয়ের একটি অংশে সাংবাদিকতার বর্তমান ধারার প্রতি ইঙ্গিত করে তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য আজ কেবল সংবাদকর্মী, সংবাদ পরিবেশনের কৌশল বা প্রযুক্তি দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না। বরং সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে এমন কিছু মৌলিক বিষয়ই আজ সাংবাদিকতার নীতি ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে। বিশ্বময় অস্থিরতা, উত্তেজনা, সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, গৃহযুদ্ধ, আন্তরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ, দেশের প্রতিরক্ষা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, যুদ্ধবিরতি ও বিশ্বশান্তির মতো বিষয়গুলো আজ মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ৯/১১-এ টুইন টাওয়ার ধ্বংস, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা কিংবা সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে স্পর্শ করে পৃথিবীর প্রায় সব জনপদের মানুষের জীবন ও জীবিকা। এ বিষয়ে নাগরিক সমাজ আরও জানতে চায়। আর এ বিষয়গুলো নিয়েই আবর্তিত সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ এক ধারা, যা যুদ্ধ সাংবাদিকতা, প্রতিরক্ষা সাংবাদিকতা বা নিরাপত্তা সাংবাদিকতা নামে পরিচিতি পেয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে বর্তমান পৃথিবী। এ পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে তাৎক্ষণিক বা প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগের কোনো বিকল্প নেই। যুদ্ধ, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, যুদ্ধবিরতি বা শান্তির বিষয়েও আজ মানুষ তাৎক্ষণিক সবকিছু জানতে ও দেখতে চায়। কিন্তু সামরিক তথ্যের, বিশেষত আগাম পরিকল্পনার গোপনীয়তা রক্ষা ও আকস্মিকতা অর্জনের মতো স্পর্শকাতর বিষয় বিবেচনায় একটি রাষ্ট্র, জোট বা মিত্রশক্তি যুদ্ধ বা নিরাপত্তাজনিত সংবাদের অবাধ ও তাৎক্ষণিক প্রচার ও প্রসার অনুমোদন দেয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৯/১১-এ যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার আক্রমণের কথা। এ আক্রমণের পরপরই বিশ্ববাজারে দ্রুত কমতে থাকে মার্কিন ডলারের মান, আর বাড়তে থাকে ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন প্রভৃতির দাম। স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ২১৫.৫ ডলার থেকে বেড়ে ২৮৭ ডলারে পৌঁছে। বাড়ে সব ধরনের জ্বালানির দাম। ধস নামে সারা বিশ্বের পুঁজিবাজারে। জার্মানিতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সার্বিক সূচক ৮.৫ শতাংশ কমে যায়। তখন সারা বিশ্বের আগ্রহ ছিল টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বিপরীতে আমেরিকা কোন ধরনের সামরিক পরিকল্পনা করছে তা জানার প্রতি। সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিটি বাঁক ইউরোপের বাজার ও জীবনাচারে প্রতিনিয়ত প্রভাব ফেলছে। তাই গোপনীয়তা বা স্পর্শকাতরতার তথাকথিত জুজুবুড়ির ভয় দেখিয়ে যুদ্ধের বা যুদ্ধবিরতির কিংবা শান্তি প্রচেষ্টার খবর এখন আর গোপন রাখা বা বিলম্বিত করার সুযোগ নেই। তাই যুদ্ধ তথা নিরাপত্তা সাংবাদিকতার গুরুত্ব ও বহুমাত্রিকতা আজ নতুন উচ্চতায় অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে সমরবিদ তথা বাঘা বাঘা জেনারেলও শত্রু-মিত্র ও গোলাবারুদের হিসাবের পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করছেন অকুতোভয় তরুণ নিরাপত্তা সাংবাদিকদের মোকাবিলার বিষয়টি। ইতিহাসের আলোকে এবং তাদের পূর্বসূরির সফলতা বা ব্যর্থতার মূল্যায়নের মাধ্যমে তারা উপলব্ধি করেন যে, মিডিয়ার অজ্ঞতা বা মিডিয়ায় প্রচারিত ভুল তথ্য একটি সামরিক অভিযান নিমেষেই ভ-ুল (?) করে দিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করে শত্রুর মনোবল ও শত্রুসহ সব পক্ষের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়াও সম্ভব। তাই দিন দিন বিকশিত হচ্ছে প্রতিরক্ষা সাংবাদিকতার অবারিত দিগন্ত। দেশে দেশে চলছে নিরাপত্তা সাংবাদিকতার ওপর নিত্যনতুন প্রশিক্ষণ।

দিন দিন বেড়েই চলেছে যুদ্ধ, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও শান্তির অন্বেষাজনিত খবরের চাহিদা। অন্যদিকে এ যুগের ছোটরাও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কম্পিউটার গেমের নামে যুদ্ধ শিখছে। রিলোড, রকেট লঞ্চার, প্যারাড্রপ কিংবা রিফুয়েলিংয়ের মতো শাস্ত্রীয় সামরিক শব্দ আজ অনায়াসে উচ্চারিত হয় সদ্য কথা বলতে শেখা শিশুদের মুখে। হেফাজতে ইসলামকে মতিঝিল ছাড়া করতে ব্যবহৃত ‘সাউন্ড গ্রেনেড’ আসলে কী, তা জানতে চায় সবাই। ২১ আগস্টের আরজেস গ্রেনেডের নির্মাতার সন্ধানে এখনো ব্যস্ত অনেক চোখ। কোন শক্তিতে মিয়ানমার আজ বলীয়ান, তা জানার আগ্রহে কমতি নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে কি না, এ নিয়ে ঝড় ওঠে চায়ের কাপে। কেবল যুদ্ধ পরিস্থিতিই নয়, চৌকশ যোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার ও নিরাপত্তা ভাবনা, রাজনীতিবিদদের সমর দর্শন, প্রতিরক্ষা মেলা, সমরাস্ত্র প্রদর্শনী, বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ও জঙ্গিবিমানের শুভেচ্ছা সফর, শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত সেনাদের প্রচেষ্টার মতো বহুমাত্রিক বিষয় জীবন্ত হয়ে ওঠে নিরাপত্তা সংবাদকর্মীদের ক্যামেরার লেন্স, মাইক্রোফোন, কম্পিউটারের কি-বোর্ড কিংবা অতি পরিচিত নোটবুক আর কলমের কল্যাণে। অন্যদিকে হেলমেট আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে চলন্ত ট্যাংক কিংবা আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ারে (এপিসি) বসে রণাঙ্গনের সরাসরি ধারা বর্ণনা বা পিস টু ক্যামেরা (প্রতিবেদন শেষে স্থানের নাম ও নিজের পরিচিতি) দিতে দেখা যায় সাহসী মিডিয়াকর্মীদের। তাই বলা যায়, প্রতিরক্ষা বাহিনী আর মিডিয়া বাহিনী আজ প্রায় একই গতিতে ছুটছে।

নিরাপত্তা সংবাদের স্পর্শকাতরতার বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। সাংবাদিকতার আড়ালে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনা এবং গোয়েন্দা তৎপরতার কল্যাণে যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের বহু ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীতে। এর বিপরীতে উচ্চারিত হয় তথ্য জানার ও জানানোর মৌলিক অধিকারের বিষয়টি। মানুষমাত্রই স্বাধীনতার যে স্তরগুলোকে মন থেকে ভালোবাসে, তার অন্যতম হলো নিজের আগ্রহ আছে এমন বিষয়ে জানা এবং নিজে যা জানে তা অন্যকে জানানোর আকুতি। অথচ অতীতে অনেক দেশেই সেই সুযোগ ছিল না বা আজও নেই। এ ক্ষেত্রে সামন্তবাদ, একনায়কতন্ত্র, সামরিক শাসন বা ফ্যাসিবাদের সময় জাতীয় নিরাপত্তা, দেশরক্ষা, রাষ্ট্র মেরামত, শুদ্ধি অভিযান, জনগণের জানমালের সুরক্ষার বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো এবং মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো বা হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা সাংবাদিকতা। তবে ধীরে হলেও পাল্টেছে দৃশ্যপট। আজ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সমঝোতা ও দেশি সংবিধান।

দালিলিকভাবে যুদ্ধ বনাম মত প্রকাশ বা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি নজর দিলে প্রথমেই চোখে পড়বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রসঙ্গ। নিরাপত্তা সাংবাদিকতা এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। বিভীষিকাময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে এ যুদ্ধ শেষের তিন বছর তিন মাসের মাথায় অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব সম্প্রদায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২১৭ এ-নম্বর সনদ অনুমোদন করে। এ সনদে মানুষের যাবতীয় মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সর্বজনীন ঘোষণা দেওয়া হয়, যা বিশ্বের ৫০০ ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছ। এ সনদের ৩০টি ধারার মধ্যে ১৯ নম্বর ধারায় অবাধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়- মানুষমাত্রই যে কোনো মত অন্য কারও প্রভাব ছাড়া নিজের মধ্যে লালন এবং যে কোনো তথ্য অনুসন্ধান, বিশ্বাস, গ্রহণ বা বর্জন সর্বোপরি তা অন্যকে জানানোর জন্য যে কোনো যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করার অধিকার রাখে।

নাগরিকদের মত প্রকাশের এ স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে সাধারণ তথ্য জানার অধিকারের মতো প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত তথ্যও কিছু শর্ত বা নিরীক্ষার ভিত্তিতে জানা ও জানানোর নির্দেশনা বা সমঝোতা স্মারক তুলে ধরেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। এসব নির্দেশনা ও সমঝোতার বিষয়কে এক মলাটে এনেছে ‘ডিফেন্স হ্যান্ডবুক ফর জার্নালিস্ট অ্যান্ড ব্লগারস’ নামক প্রকাশনা। আর সম্মিলিতভাবে এ প্রকাশনাকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, অল পেস্টিংস এবং থমসন রাইটার্স ফাউন্ডেশন নামক তিনটি সংস্থা। এ প্রকাশনার শুরুতেই বলা হয়েছে- কোনো পেশা বা কর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে কোনো মানুষের মৌলিক অধিকার। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিক এবং পেশাদার বা অপেশাদার সাংবাদিকদের পৃথক করার সুযোগ নেই। ১৯৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২২০০ এ-২১ নম্বর সিদ্ধান্তের আলোকে ‘দি ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’ (সংক্ষেপে আইসিসিপিআর) শীর্ষক সমঝোতা বা ঐকমত্যের অবতারণা হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিও এ সমঝোতার আলোকে মানুষের মতামত গ্রহণ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- সকল প্রকার প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের একটি মত বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকবে এবং সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। এ স্বাধীনতা বলতে যে কোনো তথ্য বা মতবাদ নিজের মধ্যে ধারণ করা, জানতে চাওয়া, জানতে পারা এবং নিজের জানা সেই তথ্য ও মতবাদ যে কোনো সীমারেখা বা গন্ডির বৃত্ত ভেঙে মৌখিক, লিখিত, ছাপানো চিত্র আকারে, ফটো বা আঁকা ছবি আকারে অথবা অন্য যে কোনো যোগাযোগমাধ্যম বা মিডিয়া ব্যবহার করে প্রকাশ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় মেনে চলতে হবে। এক. এ মত বা তথ্য প্রকাশ অন্যের অধিকার খর্ব করবে না বা সম্মানহানির কারণ হবে না এবং দুই. এ মত বা তথ্য জাতীয় নিরাপত্তা বা নৈতিকতা বিঘিœত করবে না। অন্যদিকে ২০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- যুদ্ধসংক্রান্ত গুজব বা প্রোপাগান্ডা কেবল আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির ১০২ নম্বর সভায় (১১-২৯ জুলাই ২০১১) গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে আইসিসিপিআর ১২ সেপ্টেম্বর ২০১১-এ প্রকাশিত সনদের ৩৪ নম্বর সাধারণ মন্তব্যের ৩০ নম্বর ধারায় নিপীড়নমূলক বা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিষয়ে সতর্কতা বা সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে রাষ্ট্রীয় বা দাফতরিক নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মত প্রকাশের মৌলিক স্বাধীনতা খর্ব না করার আহ্বান জানানো হয় এবং খোঁড়া যুক্তি দিয়ে সাংবাদিক, গবেষক, পরিবেশবাদী, মানবাধিকারকর্মী বা অনুরূপ অন্যদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। যদি নিরাপত্তার কারণে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়, তবে অবশ্যই একটি আইনের দ্বারা সেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে, কারও ইচ্ছা বা দাফতরিক আদেশে নয়। এমন নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই নাগরিকের অধিকার ও সম্মান রক্ষার্থে একান্ত প্রয়োজন এবং তুলনামূলক বিচারে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য বা অত্যাবশক বলে মূল্যায়িত হতে হবে। জাতিসংঘ এ-সংক্রান্ত বিষয়টিকে ‘থ্রি পার্ট টেস্ট’ বা তিন পর্বের নিরীক্ষা মর্মে অভিহিত করে। এ তিনটি পর্ব হলো- ১. কেবল আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, ২. অন্যের অধিকার ও সম্মানের সুরক্ষা, ৩. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০০৮ সালের বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবসে (ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে) একটি প্রকাশনা জনসম্মুখে অবমুক্ত করে। ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন, অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্ট অব পিপল’ শিরোনামের এ বইটিতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে তথ্যের স্বাধীনতা খর্বের বিষয়টি আলোচিত হয়। এতে বলা হয়- গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা হলে তথ্য জানার অধিকার নাকচ হয়ে যায়।  আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সূত্র উল্লেখপূর্বক ইউনেস্কোর দাবি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার যে কথিত প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়, বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেই প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া কঠিন। নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ শেষবিচারে অকল্যাণই বয়ে আনে।

২০১৩ সালের জুনে ২২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও ৫০০ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে প্রতিটি দেশের জন্য অনুকরণীয় ‘দ্য প্লোবাল প্রিন্সিপালস অন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড রাইট টু ইনফরমেশন’ শীর্ষক একটি নীতিমালা প্রকাশ করে। এ নীতিমালায় জাতীয় নিরাপত্তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।  তার বদলে ২ নম্বর নীতিমালায় বলা হয়েছে- প্রতিটি দেশকে জাতীয় নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলতে সেই দেশে কী বোঝানো হবে তা দেশটির আইনে স্পষ্টত উল্লেখ থাকতে হবে এবং অবশ্যই তা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান হিউম্যান রাইটস, আসিয়ান, এশিয়ান জোটের ঘোষণাপত্র, অ্যারাব (আরব) চার্টার অন হিউম্যান রাইটসসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরাম গণমাধ্যম বা সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। একইভাবে সব আন্তর্জাতিক আদালত ও মানবাধিকার আদালত মত প্রকাশ ও তথ্যের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। এ ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে আজ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সাংবিধানিকভাবে সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়।

এসব অধিকার, আন্দোলন, আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যক্রম এবং দেশের সাংবিধানিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তা সাংবাদিকরা নতুন উদ্যোগে লড়াইয়ে নেমেছে। আজ কোনো কারণে যুদ্ধবন্দি প্রতিটি সাংবাদিককে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে জাতিসংঘ। সাধারণ দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং জেনেভা চুক্তির শর্ত মোতাবেক রণক্ষেত্রে কর্মরত সব সংবাদকর্মী বেসরকারি ব্যক্তি বলে বিবেচিত হবেন। তবে সরকারি অনুমোদন বিশেষত নিরাপত্তা বাহিনীর আনুকূল্য পেয়ে যেসব সংবাদকর্মী রণক্ষেত্রে কর্মরত থাকেন, তাদের যুদ্ধ সাংবাদিক (ওয়ার করেসপনডেন্ট) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় এবং সাধারণ সংবাদকর্মীদের কাতার থেকে তাদের পৃথক করা হয়। যুদ্ধ সাংবাদিকরা যথাযথ সেনা কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুসারে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন, অবস্থান এমনকি সেনাদল বা যুদ্ধবহরের সঙ্গে চলাচলেরও অনুমোদন পেয়ে থাকেন, যা সাধারণ সংবাদকর্মীরা পান না। অনেক দেশেই যুদ্ধ সাংবাদিকরা সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে বেতন-ভাতা, চিকিৎসাসেবা ও রসদ পেয়ে থাকেন। তারা সর্বদা সেনা কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তাবলয়ে থেকেই কাজ করেন। অন্যদিকে যুদ্ধ সাংবাদিকদের মতোই কাজ করেন এমবেডেড জার্নালিস্ট বা সংযুক্ত সাংবাদিক নামে পরিচিতি পাওয়া সংবাদকর্মীরা। তারা সেনাদলের সঙ্গে থাকলেও সেনাবাহিনী থেকে নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ না হলে এ দুই ধরনের সাংবাদিকদের এক কাতারে বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (সংক্ষেপে আইএইচএল)। সমস্যার সূত্রপাত ঘটে যখন ওয়ার করেসপনডেন্ট বা যুদ্ধ সাংবাদিকরা শত্রুপক্ষের হাতে বন্দি হন। তখন তাদের প্রতিও যুদ্ধবন্দি সেনাদের মতোই আচরণ এমনকি নির্যাতনও করা হয়। যদিও জেনেভা সনদ মোতাবেক তা নিষিদ্ধ। তবু যুদ্ধ সাংবাদিকতা তথা প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তা সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহের কমতি নেই। যদিও যুদ্ধের মাঠে নানান কারণে সাংবাদিকদের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু অপ্রিয় অথচ বাস্তব বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

সাংবাদিকতা বরাবরই একটি চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ছিল, আছে এবং থাকবে। ১৯৯০ থেকে ২০২০- এই ৩০ বছরে বিশ্বের বুকে অকালে নিহত বা খুন হয়েছেন ২ হাজার ৬৫৮ জন সাংবাদিক (সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট)। তাদের একটা বড় অংশ সিরিয়া, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের সময় প্রাণ হারান। ২০২০ সালে বিশ্বের ২৩৫ জন সাংবাদিক বিভিন্ন দেশের ৩৪টি কারাগারে বন্দি ছিলেন বলে একই সূত্রে প্রকাশ। এ তালিকায় সর্বাধিক ৬৭ জন সাংবাদিক ছিলেন তুরস্কের জেলে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এক তথ্যে জানায়, বিগত ৩০ বছরে (১৯৯২ থেকে ২০২২) প্রায় ১ হাজার ৭০০ সাংবাদিক প্রাণ হারান। তাই বলা যায়, মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করেই যুদ্ধ সাংবাদিকরা রণাঙ্গনে যান। সেনারা যখন গুলি চালায় তখন ক্যামেরা চালান যুদ্ধ সাংবাদিকরা। কোনো কামান বা যুদ্ধজাহাজ থেকে মিসাইল নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবি ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বময় নিক্ষেপ বা আপলোড করেন একজন যুদ্ধ সাংবাদিক। সুতরাং কোনো বাধা সৃষ্টি করে যুদ্ধ সাংবাদিকদের মনের জোয়ারে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে কাজে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে পাঠক-দর্শক-শ্রোতার আগ্রহের কারণেই। তাই সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ সাংবাদিকদের কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া আজ যুগের দাবি। আর সমরনায়করা যদি এ যুদ্ধ সাংবাদিকদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেন, তবে নিজস্ব বাহিনীর মনোবল অটুট বা চাঙা রাখা এবং শত্রুদের মধ্যে হতাশা, বিশৃঙ্খলা এমনকি বিদ্রোহ উসকে দেওয়াও সম্ভব। এর বিপরীতটি ঘটতে পারে যদি শত্রুপক্ষের প্রচারমাধ্যমকে যথাযথভাবে দমন বা যোগ্য উত্তর দেওয়া না যায়।

জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও তার সব অঙ্গসংগঠন প্রণীত ও গৃহীত নির্দেশনা, বাধানিষেধ ও উপদেশ মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কমনওয়েলথ, সার্কসহ অন্যান্য জোট ও আঞ্চলিক জোটের সদস্য হিসেবে জোটবদ্ধভাবে বাংলাদেশ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের ৩৯ নম্বর ধারা সব মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। এ-সংক্রান্ত ৩৯ (২) ধারা মোতাবেক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক (?) ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আরও নিশ্চিত হয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২(ছ) নম্বর ধারা এবং ১৭ নম্বর ধারা মোতাবেক জননিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা বা সার্বভৌমত্বের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে এমন কোনো বাহ্যিক বা ভার্চুয়াল তথ্য পরিকাঠামো, যা কোনো তথ্য-উপাত্ত বা কোনো ইলেকট্রনিক তথ্য নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চালন বা সংরক্ষণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুশাসন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনা ও স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন।

বাংলাদেশে বর্তমানে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), পুলিশ সদর দফতর, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজেপি) প্রভৃতির নিজস্ব মিডিয়া সেল বা মিডিয়া উইং রয়েছে। কিন্তু সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীর নিজস্ব মিডিয়া উইং নেই।  বাহিনীগুলোর সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা মিডিয়া বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও দাফতরিকভাবে মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন আন্তবাহিনীর জনসংযোগ পরিদফতর (সংক্ষেপে আইএসপিআর)। তিন বাহিনীর সঙ্গে আইএসপিআরের সখ্য থাকলেও বাস্তবতা হলো বাহিনী তিনটির সরাসরি মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার দাফতরিক এখতিয়ার নেই। তেমনিভাবে গণমাধ্যমকর্মীদেরও যে কোনো তথ্য জানতে দাফতরিকভাবে যোগাযোগ করতে হয় আইএসপিআররে সঙ্গে।  একদিকে চতুর্থ বা পঞ্চম জেনারেশনের যুদ্ধসরঞ্জাম দিয়ে ত্রিমাত্রিক ও চৌকশ প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়া আর অন্যদিকে এমন তিনটি বাহিনীকে মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন আমলার ওপর নির্ভরশীল রাখা এ যুগের সঙ্গে মানানসই নয়।  ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এমনকি যুগের সঙ্গে তাল মেলাতেও বাহিনীগুলোর নিজস্ব মিডিয়া উইং, নিজস্ব সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিও সেন্টার চালুর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

সর্বশেষ খবর