রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

অবাস্তবতার নিরিখে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা

ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং চেয়ারম্যান ইআরআই (এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ)

অবাস্তবতার নিরিখে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা

‘প্রত্যেকেই তাদের পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে এবং  সাফল্য অর্জন করতে পারে যদি তারা যা করতে চায় আর তার প্রতি নিবেদিত এবং উৎসাহী হয়।’

 

“Everyone can rise above their circumstances and achieve success if they are dedicated to and passionate about what they do.” Nelson Mendala.” সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্রিকেটার মাখায়া এনটিনিকে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলার প্রাক্কালে অভিনন্দন জানিয়ে এক বার্তায় লিখেছিলেন, ‘প্রত্যেকেই তাদের পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে এবং সাফল্য অর্জন করতে পারে যদি তারা যা করতে চায় আর তার প্রতি নিবেদিত এবং উৎসাহী হয়।’

যে কোনো সাফল্য অর্জনের পেছনে অনেক গল্প থাকে। সাফল্যের গল্পের মধ্যে ব্যক্তিগত উন্নয়ন বা ব্যক্তি সাফল্যকে বুঝে থাকি। আজকের প্রেক্ষাপটে পেশাদার সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিক নঈম নিজাম তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও সফল।  স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন, জাতির বিবেকের ক্ষুরধার মসি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। পুত্র সন্তান সুনাগরিক তৈরি করার কারখানার কারিগর। কন্যা বিশ্বের সেরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।  বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে পেশাদারি জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সাফল্যের স্বর্ণশিখরে তাঁর অবস্থান। তিনি এখন শুধু ব্যক্তিই নন, মেধা ও মননের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন, সাংবাদিকতার আইকন হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়ও বটে।

তবে সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিতে পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থা কিংবা রাষ্ট্রকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে সংবাদপত্র বা সংবাদকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সেই বাস্তবতায় নঈম নিজাম ১/১১-এর পর বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপটে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু করলেন মাত্র ২ টাকার দৈনিক পত্রিকা। সাধারণ পাঠক সমাজকে শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটের খবর একনজরে পরিবেশন করেছেন। একশ্রেণির পাঠক সমাজ সকালে চায়ের পেয়ালায় মুখ নিতেই টাটকা খবরের কাগজ ও চা পানের আসক্ততায় অভ্যস্ত। অপরদিকে, কর্মব্যস্ত খেটে খাওয়া মানুষগুলো সামান্য ফুসরত পেলেই সামর্থ্যরে মধ্যে থাকা স্বল্প পরিসরে ব্যাপক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় পত্রিকাটিতে নজর দেয়। বাস কিংবা সিএনজি চালক, ব্যস্ত নগরীর যানজটের অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে নজর দেয় এই পত্রিকার দিকে। মুদি দোকানদার কিংবা ঝাল মুড়িওয়ালার ক্রেতাবিহীন সময়ে নজর কেড়ে নেয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। মূলত, পত্রিকাটির জন্ম হয়, তথাকথিত সুশাসন ও গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা ১/১১-এর কুশীলব খলনায়কদের প্রস্থানের পর।

২০০১ সালের ১০ অক্টোবর প্রতিমন্ত্রী (শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। কিন্তু জুলাই অবধি বিনামূল্যে প্রাথমিক স্তরের বই বিতরণে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৯৬-২০০১)। ওই সময় ‘পুস্তিকা’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে সব বই ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি বই তো দেয়নি, উপরন্তু তারা বিল উঠিয়ে নিয়ে যায়, সেই কারণেই সময়মতো বই বিতরণ হয়নি। তড়িঘড়ি করে টেন্ডার দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। এদিকে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী ছয়টি প্যাকেজে বই ছাপাতে হবে। ছাপানো ও বাঁধানোর কাজ একই প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার বই ছাপানোর জন্য প্রতি ফর্মায় বরাদ্দ দিয়েছিল ৭৪ টাকা। বুঝতে পারলাম, ছয়টি প্যাকেজে যদি বই দেওয়া হয় তাহলে কাজটি সঠিক সময়ে শেষ করা যাবে না। তাই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে ছোট ছোট প্যাকেজ বানিয়ে প্রায় সাড়ে চারশ প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপানোর কাজ দিলাম। দেশের মুদ্রণ শিল্পে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো টেক্সটবুক বোর্ডের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন বিশেষ গৌরবের বিষয় মনে করে। সেই সুবাদে প্রতি ফর্মা ছাপানোর মূল্য গতবারের ৭৪ টাকা থেকে নেমে এলো ৩৭ টাকায়। নতুন উদ্যমে শুরু হলো কাজ। বিনামূল্যে বই বিতরণের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১ জানুয়ারি ২০০২ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই বিতরণ করলাম।

স্বল্প সময়ে ছাপানোর কাজ শেষ হওয়ার জন্য বহু প্যাকেজ করায় দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা আমাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলল। সেই সময়ে নিজ থেকে এগিয়ে এলেন দেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক নঈম নিজাম। শুরু করলাম এদেশের ১৯৭২ সালের জন্ম নেওয়া শিক্ষার ক্যান্সার নামক ঘাতক ‘নকল’ প্রতিরোধের সংগ্রাম। মন্ত্রণালয় থেকে গতানুগতিক বাধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই সময়ে গুটিকয়েক বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন ছিল। যা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতো না। এদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের পক্ষে মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে নিউজ কাভারেজ দেওয়ার মতো ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যানের স্বল্পতা ছিল। কোনো অবস্থাতেই প্রচারণায় সফলতা অর্জন করতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে মন্ত্রদূত হয়ে আমার সংগ্রামকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে এগিয়ে এলেন নঈম নিজাম। তাঁরই আগ্রহ এবং পরামর্শে কিনে নিলাম ভিডিও ক্যামেরা। প্রতিদিনই মন্ত্রণালয়ের পিআরওকে দিয়ে ভিডিও ধারণ করে এবং ছবি তুলে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার পাতায়, টিভির পর্দায় সংবাদ প্রচার হতো। নকল প্রতিরোধ, জাটকা নিধন প্রতিরোধ আন্দোলন কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন সব মিলিয়ে দেশব্যাপী ইতিবাচক প্রচারণার জোয়ার উঠতে থাকল। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে নকলবিরোধী আন্দোলন ঘরে ঘরে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল। আন্দোলনে সহযোগিতা করেছিলেন সাংবাদিক বন্ধুরা, প্রশাসন, শিক্ষক ও অভিভাবক, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের আপামর জনগণ। দুর্গম অঞ্চলে পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে হেলিকপ্টার সংযোজিত করেছিলাম নিজ দায়িত্বে। সারা দেশের পরীক্ষা কেন্দ্রের নকলকারীরা উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কে থাকত।

সহযোগিতার চেয়ে বিরোধিতার পাল্লা ভারী হতে থাকল, থেমে থাকিনি। যথাসময়ে পুস্তক বিতরণ হয়েছে, অর্থ সাশ্রয় ও একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে, নতুন বছরের প্রথম দিনই বিনামূল্যে বই বিতরণ হয়েছে, সারা দেশে পাবলিক পরীক্ষায় নকল বন্ধ হয়েছে কিন্তু তার পরও বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার এক সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের পরিবর্তে মিথ্যা খবর, যা খুবই সস্তা করে উপস্থাপন করে, কারণ, এগুলো তৈরি খুব সহজ।

২০০৪ সালের ২৩ মে, ওই দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল-‘শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর বিমান ও কপ্টার ভাড়া আদায়ে গুরুতর অনিয়ম বহন করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা বোর্ড।’ ইনসেটে দেওয়া হয়, ‘পাঠ্যপুস্তক প্রকাশক ও মুদ্রণ কাজে জড়িত চার শতাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করা হয়েছে। আট দিনে হেলিকপ্টার উড্ডয়নের ভাড়া ও জ্বালানি খরচ বাবদ প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’ সকালে পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে সোজা প্রেস ক্লাবে চলে গেলাম এবং সংবাদ সম্মেলন করে বললাম, ‘চাঁদা নিয়েছি কেউ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব, পদত্যাগ করব।’ আসলে কোনো কোনো সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে খবরকে প্রতিষ্ঠিত করে, যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহতি সৃষ্টি করে। আবার কেউ কেউ সব খবরের মধ্যেই নেতিবাচকতা খুঁজে বের করেন। সেই সময়ে আবারও এগিয়ে এলেন সেই বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা সম্পাদক, আজকের ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজাম। ইতিবাচক সাংবাদিকতার মাধ্যমে নকলবিরোধী আন্দোলনের প্রচারণাকে আরও বেগবান করলেন। 

১/১১-এর সময়ও ওই শীর্ষস্থানীয় দৈনিকটি আবারও আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের মিথ্যা, বানোয়াট তথ্য দিয়ে, রং মিশিয়ে হরেক রকম সংবাদ উপস্থাপন করেছিল। যা শাপেবর হয়েছিল, কেননা দুর্নীতি দমন কমিশন আমার বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করতে পারেনি। যার সুফল পাচ্ছি, কেননা এখনো সরকারি দল বা বিরোধী দল, শত্রু-মিত্র, দেশের আপামর জনগণ শিক্ষাক্ষেত্রে নকল প্রতিরোধে আমার সংগ্রামের কথা অবলীলায় স্বীকার করে। ১/১১-এর সময়ে সাংবাদিক নঈম নিজামের কথা আমার বারবার মনে পড়ছিল, সেই সময়েও দেশের বহুল প্রচারিত ওই পত্রিকাটিসহ অন্যান্য বেশ কিছু গণমাধ্যমে আমার নকল প্রতিরোধ আন্দোলনের সময়কার হেলিকপ্টার ভাড়ার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন আষাঢ়ে গল্প ছাপায়। 

ওই বিশেষ পত্রিকাটি নকলের বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম, জাটকা নিধন আন্দোলন ও মনগড়া কেচ্ছাকাহিনী দিয়ে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে আমাকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে জাহির করতে শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল।  মনে পড়ে গেল, এস্তোনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট থমাস হেনড্রিক লিভস বলেছিলেন, ‘মিথ্যা খবর খুবই সস্তা হয়ে থাকে, এগুলো তৈরি করা খুব সহজ। কিন্তু সত্যিকারের খবর খুঁজে বের করা খুব কঠিন একটা কাজ।’

আজকের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার অঙ্গীকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের কোনো বিকল্প নেই। যখন রাজনৈতিক দলের নেতারা অসত্য সংবাদ পরিবেশনকে উৎসাহিত করে অবাস্তব পরিবেশ সৃষ্টি করে, তখন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা থমকে দাঁড়ায়। তাই গ্রিক রাজনীতিবিদ মার্কোস লেমন বলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্র মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতা ও খবর প্রচারের বস্তুনিষ্ঠতার ওপর অনেকটা নির্ভর করে থাকে। যে রাজনৈতিক নেতারা মিথ্যা খবর প্রচারে নিরুৎসাহিত করেন, জানবেন সেই আপনাদের আসল নেতা।’  অপরদিকে শান্তিতে নোবেল জয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, “Real leaders must be ready to sacrifice all for the freedom of their people.”

বর্তমানে কৃত্রিমভাবে তৈরি অবাস্তবতায় ছাপানো হয় মিথ্যা খবর, সস্তা খবর প্রচারে রাজনৈতিক নেতারা উৎসাহিত করেন কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, জনগণের স্বার্থে নেতারা জীবন উৎসর্গ করতে রাজি নন। দেশের এমনই অস্বস্তিকর পরিবেশে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ সফলতার সঙ্গে সম্পাদক নঈম নিজামের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৩ বছর অতিক্রম করেছে।  বহুল প্রচারিত দৈনিকটি সর্বসাধারণের সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম হিসেবে, জনআকাক্সক্ষার ভিত্তিতে, বাস্তবতার নিরিখে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করবে। আর এভাবেই এগিয়ে চলুক বাংলাদেশ প্রতিদিন ও সম্পাদক নঈম নিজামের আগামী দিনের পথচলা।

সর্বশেষ খবর