‘আমরা খাইট্টা খাওয়া মানুষ। ঘরের সবাই নৌকায় মাছ ধরলে সংসারের আয় বাড়ে। বাড়ি থেকে সরকারি স্কুল দূরে। রাস্তাঘাট ভালো না হওয়ায় ছোট ছোট পোলাপান স্কুলে যেতে চায় না। এহন ঘরের পাশেই স্কুল। সবাই স্কুলে যায়।’ কথাগুলো বলছিলেন দশমিনা উপজেলার চরবোরহান বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মনির সিকদার। পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার দক্ষিণ দিকে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরবোরহান ইউনিয়ন।
এই ইউনিয়নের এক পাশে আবাসন প্রকল্পে ৭০টি পরিবার বসবাস করে। পাশেই আরো প্রায় ১৫০ পরিবারের বসবাস। ইউনিয়নটি এমনিতেই দ্বীপচর। এর মধ্যে দক্ষিণ চরবোরহান গ্রামটি আরো দুর্গম।
এখানকার বেশির ভাগ মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে জেলে পেশার ওপর। ছেলেশিশুদের বয়স ৮-৯ হলেই বাবার সঙ্গে নৌকায় মাছ শিকারে যায়। মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রেও এক অবস্থা। ইচ্ছা থাকলেও এখানকার শিশুদের পড়াশোনা করাতে পারে না দরিদ্র পরিবারগুলো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ খুবই বেহাল।
বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে শিশুদের চলাচলের প্রায় অনুপযোগী থাকে। আবার সরকারি একটি স্কুল থাকলেও দূরে হওয়ায় বছরের দীর্ঘ সময় স্কুলে না যাওয়ায় তারা স্কুলবিমুখ হয়ে যায়। এসব বিষয় আমলে নিয়ে গত বছর বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগিতায় চরবোরহানে ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্কুলটিতে বর্তমানে ৭৬ জন শিশু পড়াশোনা করছে। গ্রামে এমন স্কুল পেয়ে অভিভাবকরা অনেক খুশি। তাঁরা প্রতিনিয়ত স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। এমনকি কোনো শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস না করলে অভিভাবকরাই ওই শিক্ষার্থীর খবর নিয়ে স্কুল শিক্ষককে জানিয়ে দেন।
শিক্ষার্থী সুমাইয়ার বাবা পাবেল ফকির বলেন, ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলটি গ্রামের মধ্যে আবার নতুন করে একটি বন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। প্রতিদিন শিশুরা যখন স্কুলে আসে, বেশির ভাগ মা বাচ্চাদের দিয়ে যান। এ সময় সবার মধ্যে কুশলাদি বিনিময় হয়। আবার কারো কোনো সমস্যার কথা দ্রুত জেনে সমাধান করা হয়। এককথায় স্কুলটি আমাদের গ্রামের মানুষের মধ্যে একটি ভালো বন্ধন তৈরি করেছে।’ প্রথম শ্রেণির তামিম ইসলাম বলে, ‘আমরা দুই ভাই। বড় ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করে। আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করতে চাই না। আমি পড়ালেহা কইরা চাকরি করমু। প্রতিদিন আমি স্কুলে আসি।’ এলাকাবাসী জানায়, এই গ্রামের শিশুদের চোখে এখন নতুন স্বপ্ন। তারা চায় সুন্দর আগামী। তাই তারা বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল পেয়ে অনেক খুশি।
স্কুলটি নিয়ে অনেক স্বপ্ন প্রথম শ্রেণিতে পড়া সোহানার। সে বলে, ‘স্কুল বন্ধ থাকলে ভালো লাগে না। বন্ধ না দিলেই ভালো হয়। প্রতিদিন স্কুলে বন্ধুরা মিলে পড়াশোনার পর খেলা করতে পারি। গল্প করতে পারি। বাড়ি গেলে একা একা থাকা লাগে। আবার মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গেও বিভিন্ন কাজ করা লাগে। আমার কাজ করতে ভালো লাগে না। স্কুলে পড়তে আর খেলা করতে ভালো লাগে।’
গ্রামের কৃষক আশ্রাফ খান বলেন, ‘আমার চার সন্তান। দুই ছেলে নদীতে মাছ ধরে। ময়না আর সায়েম বসুন্ধরা স্কুলে পড়ে। আগের দুই ছেলে পড়ালেহা করে নাই। আমি এহন বাড়ির ধারে স্কুল পাইছি, তাই এই দুই ছেলে-মেয়েকে পড়ামু। আসলে পড়ালেহা না জানলে নানান সমস্যা হয়।’
অভিভাবক রফিক বেপারী বলেন, ‘বসুন্ধরা স্কুল থাকায় আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। আমাগো বাচ্চাগো এহন আর দূরে যাওয়া লাগে না। আর পোলাপান দূরে যাইতেও চায় না। এ ছাড়া এই স্কুলে কয়েক দিন পর পর খাতা, কলম, জামা-জুতা সব কিছুই ফ্রি দেয়। শীতে কম্বলও দেয়। আমরাও পোলা-মাইয়ারে লেহাপড়া করাইতে পারি আবার বিভিন্ন উপহারও পাই। আমরা আশা করমু এই স্কুলটি যেন স্থায়ীভাবে করা হয়।’
শিক্ষক জান্নাতুল বলেন, ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে এ এলাকার বেশির ভাগ শিশুই পড়াশোনা থেকে দূরে থাকত। তাদের পরিবারেরও তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। কিন্তু এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর প্রতিটি শিশুই এখন স্কুলে আসে। অভিভাবকরা কোনো কারণে বিভিন্ন কাজে বা বেড়াতে যেতে চাইলেও শিশুরা স্কুলের জন্য মুখিয়ে থাকে। শিশুরা পরিবারের চেয়েও আপন করে নিয়েছে স্কুলটিকে। আমিও শিশুদের নিজের সন্তানের মতো করে যত্ন করার চেষ্টা করি।’