শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্বপ্ন দেখি সুখী-সমৃদ্ধ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ

আতিউর রহমান

স্বপ্ন দেখি সুখী-সমৃদ্ধ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান প্রান্তজনের অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণেও তিনি নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে এবং দেশের মানুষের দ্বারে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে গভর্নর থাকাকালে তিনি  বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- মানিক মুনতাসির আলী রিয়াজ

 

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এসব বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে রূপান্তর ঘটেছে তা এক কথায় বিস্ময়কর। বিশ্বের এমন আরেকটি দেশ নেই যার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আগের বছরও ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। প্রায় তিন বছর যাবৎ আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি অর্জিত হচ্ছে। আমাদের স্বপ্ন আছে আমরা ডাবল ডিজিটে চলে যাব। এ প্রবৃদ্ধির জন্য সব সেক্টর সমানভাবে ভূমিকা রাখছে। এ মুহূর্তে আমাদের কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং ও সার্ভিস সেক্টর খুব ভালো করছে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধি হলে কর্মসংস্থান বাড়ে। গত বছর ১৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে এ খাতে। আগের বছর যা ছিল ১১ শতাংশ। সার্ভিস সেক্টরের প্রবৃদ্ধি অবশ্য আগের বছরের তুলনায় সামান্য কমেছে। সেই সঙ্গে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক। তবে নতুন করে বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের চাকা ঘুরছে ধীরগতিতে। এখন নির্বাচন শেষ হয়েছে। উদ্যোক্তারা হয়তো এটার অপেক্ষায় ছিলেন। এখন বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করাই যায়। সমাপ্ত অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৩১ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। আগের বছর যা ছিল ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে শঙ্কার বিষয় হলো, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সে হারে বাড়ছে না। গত অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ; যা আগের বছর ছিল ২৩ দশমিক ১ শতাংশ। আমরা কিন্তু একে আরও বেশি হারে বাড়ুক তা-ই চাই। মূলত সরকারি খাতের বিনিয়োগগুলো বাড়ার কারণে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট বাড়ছে। ফলে প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে একটা ধাক্কা দরকার।

 

২০২৪ সালের আগে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে উন্নীত হবে- বিষয়ে আপনার মতামত কী?

বাংলাদেশে টানা তিন বছর ধরে ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। আশা করি এ বছর তা আরও বাড়বে। গত কয়েক বছরের মতো সামনের বছরগুলোতেও উচ্চতর প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে প্রতি ১০ বছর পরপর বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্বিগুণ হারে উন্নতি করবে। ২০২৪ সালের আগেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে পৌঁছে যাবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২০টি শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর একটি।

 

সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছে। বৃহৎ কতগুলো প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কোনোরকম বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই। এসব বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সরকারের অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এই যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখানে বলতে হয় আমাদের ভিশন সেট করা হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীও ওপর থেকে সহায়তা দিচ্ছেন। পলিসি নেওয়া হয়ে গেছে। এখানে সবাই জানত নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগই বিজয় অর্জন করবে এবং সেটাই হয়েছে। ফলে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করা। আর বর্তমানে অর্থনীতিতে যে গতি রয়েছে এ গতি অপরিবর্তিত থাকলে সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতি শুধু এগিয়েই যাবে। পেছনে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে এখন সময় বেঁধে দিয়ে ট্র্র্যাকিং করতে হবে। ডিএইচএলের মতো ট্র্যাকার দিয়ে বিনিয়োগটাকে ধরতে হবে। কোথায়, কেন, বিনিয়োগটা আটকে আছে তা দ্রুত সমাধান করতে হবে।

 

বর্তমান সরকারের ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি কি সঠিক পথে রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

এ বিষয়ে সরকারের নতুন করে কিছু জায়গায় কাজ করতে হবে। এই অর্থনৈতিক কূটনীতিকে জোরদার করতে হবে। আমাদের প্রায় ১ কোটির মতো মানুষ বিদেশে কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কিছু কাজ করতে হবে। এসব জায়গায় মোবাইল ব্যাংকিংকে ফরমালি চালু করা যায় কিনা তা নিয়ে কাজ করতে হবে। এতে অর্থ পাচারও কমে আসবে। অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও এক্সপ্লোর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোর এক্সটারনাল উইংগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে পারছি। এটা হতাশার। অথচ ভিয়েতনামের মতো দেশ ৩৫ বিলিয়ন ডলার এফডিআই আনছে। মিয়ানমারের মতো ছোট একটি দেশ ৫ বিলিয়ন ডলার এফডিআই আনছে। এগুলো আমরা কেন পারছি না! সেখানে কাজ করতে হবে। এই জায়গায় আরও বেশি কাজ করতে হবে। এসব জায়গায় ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসিটাকে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইকোনমিক কাউন্সিলরদের কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। তারা কী করছে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজনে ইকোনমিক কাউন্সিলরদের বছরের কোনো কোনো সময় ডেকে এনে সম্মিলন করা যেতে পারে; যেখানে রপ্তানিকারকদেরও যুক্ত করতে হবে।

 

দেশের বর্তমান বিনিয়োগ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো। তবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগটা একটা জায়গায় থমকে আছে। সরকার ম্যানুফেস্টোতে যেসব অঙ্গীকার করেছে তা এখন বাস্তবায়নের পালা। এখন শুধু এটাই করতে হবে- সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কীভাবে, কখন, কাকে দিয়ে করানো হবে। একই তিনটি কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এসব সিদ্ধান্ত কোথায় বাস্তবায়ন হবে এবং কারা বাস্তবায়ন করবে। এসব বিষয়ে সময় নষ্ট না করে এখনই শুরু করে দিতে হবে। আর একটা বিষয় পরিষ্কার করতে হবে, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য ট্রেড লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। এর জন্য ৩০ দিন সময় ঠিক করে দিতে হবে। কিংবা এর জন্য একটা সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। আবেদন করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স হাতে না পেলে উদ্যোক্তা বা আবেদনকারী ধরে নেবেন তাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ লাইসেন্স হাতে পেতে দেরি হলেও ব্যবসা শুরু করতে আর দেরি করতে হবে না। এমন সার্ভিস চালু করতে হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ট্রিপ অ্যাডভাইজার নিয়োগ দেওয়া উচিত। ক্রিকেটের উন্নতির জন্য বিদেশি কোচ আনতে পারলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ট্রিপ অ্যাডভাইজার কেন আনা যাবে না! যেমন এয়ারলাইনস ব্যবসার জন্য ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সিগুলো তাদের ট্রাভেলারদের জন্য ট্রিপ অ্যাডভাইজার নিয়োগ করে। সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি সেবার ক্ষেত্রে ফিডব্যাক প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। সেবা গ্রহণকারী কেমন সেবা পেলেন তা যেন তৎক্ষণাৎ জানাতে পারেন।

 

বিনিয়োগ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রধান বাধা কী বলে আপনি মনে করেন?

সবার আগে বলতে হয় আমাদের এখন অর্থের অভাব নেই। আমাদের হচ্ছে জ্ঞানের অভাব। ফলে জ্ঞানটাকে কীভাবে আহরণ করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। আর ব্যবসা-বাণিজ্য শুরুর ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে ট্রেড লাইসেন্স জটিলতা এবং খরচ। ইজি অব ডুয়িং বিজনেস (ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ) এই সূচকে বাংলাদেশ আফগানিস্তানেরও নিচে রয়েছে। এটা তো হতে পারে না। ভারত এক ধাক্কায় ছয় গুণ বাড়িয়েছে তাদের পারফরম্যান্স। জর্জিয়া, ইন্দোনেশিয়া পারছে আমরা কেন পারব না? এসব বিষয় সহজীকরণ করতে প্রয়োজনে বিদেশি উপদেষ্টা আনতে হবে। আমি গভর্নর থাকাকালে সেখানে চিফ ইকোনমিস্ট এনেছিলাম বিদেশ থেকে। তারা কিন্তু অনেক ভালো কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ছেলেরা অনেক দেশে বড় বড় জায়গায় কাজ করছে। এমনকি জাপানের পাতাল রেলে বাংলাদেশি এক্সপার্টরা কাজ করছেন। তাহলে আমাদের পাতাল রেল করার জন্যও তো আমরা তাদের নিয়ে আসতে পারি। ব্যবসা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণের বেলায় অযথা যেসব ধাপ রয়েছে সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে যুবক শ্রেণির আমলারা খুব পরিশ্রমী। তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যাপকভাবে কাজ করছে।

 

বৈশ্বিক শ্রমবাজারের উন্নয়নে মুহূর্তে সরকারের কী করা উচিত?

এ ক্ষেত্রে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা প্রবাসীরা আমাদের রেমিট্যান্স পাঠান বলেই আমরা আজ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে গর্ব করি। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এজন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যেসব অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছেন তাদের বৈধতার জন্য সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা জোরদার করতে হবে। এমন ঘটনাও রয়েছে, যারা শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার পর এখন সেখানে ছোট ছোট ব্যবসা করছেন; এ ক্ষেত্রে তাদের ওয়ার্ক পারমিটগুলো পরিবর্তন করে তাদের বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, আবুধাবি কিংবা সৌদি আরবের সঙ্গে লেনদেন সহজীকরণের ব্যাপারেও আলোচনা কর প্রয়োজন। এতে হুন্ডির পরিমাণও কমে যাবে। রেমিট্যান্সের পরিমাণ অন্তত ১০ বিলিয়ন বাড়বে।

 

দেশের ব্যাংকিং খাতের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করেছে; যা আপনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে শুরু করেছিলেন। ব্যাপারে এখন আপনার মতামত কী?

দেখুন ব্যাংকের কাজ হলো সেবা প্রদান। এখানে ধনী-গরিব কোনো বিষয় নয়। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকটাকে দিয়ে কীভাবে ব্যাংকগুলোকে গরিবের দরজার নিয়ে যাওয়া যায় শুধু সে চেষ্টাটাই করেছিলাম। এখন কৃষক ব্যাংকে যায়। স্কুলের বাচ্চারা ব্যাংকিং করছে। রিকশাচালক এমনকি ভিক্ষুকরাও ব্যাংকিং করছে মোবাইলের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাটা একটা বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে ব্যাংক খাতে। এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের মাঝেও ব্যাংকিং সেবার আওতা বাড়ানো হয়েছিল; যার মাধ্যমে নতুন নতুন এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা যেতে পারে।

 

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের জন্য সবচেয়ে মাথাব্যথার কারণ। ২০১৫ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু তিন বছরে কেন তা ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশে গেল? এতটা বাড়ল কেন তা নিয়ে আমিও চিন্তিত। খেলাপি ঋণ নিয়ে প্রতিদিন রিপোর্ট বের হলে ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা কমে যাবে। এজন্য গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্ববান হতে হবে। এ ছাড়া ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংকগুলোর আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণখেলাপিরা কথায় কথায় গিয়ে মামলা করবেন তাও হতে পারে না। এ ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে।

 

আপনি তো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি কি সঠিকভাবে কাজ করছে বলে মনে করেন?

তা আমি বলতে পারব না। তবে আমি চাই সেন্ট্রাল ব্যাংক তার আইনি সত্তা বজায় রেখে শক্ত অবস্থানে থাকুক। সবসময় শক্তিশালী ভূমিকা পালন করুক। স্বাধীনভাবে কাজ করুক। আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংক শক্ত অবস্থানে থাকলে দেশের অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে। এতে খেলাপি ঋণও কমে আসবে পাশাপাশি সেন্ট্রাল ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে থাকতে আইনি যে সহায়তার প্রয়োজন তা বিচার বিভাগ দেবে বলে আশা করি।

 

ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়ছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো কমিশন গঠন করা প্রয়োজন কিনা?

আমার মনে হয় এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতের জন্য কোনো কমিশন করার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক নিউইয়র্কের কোর্টে মামলা করেছে। বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির জন্য দায়ী ফিলিপাইনের বেসরকারি ব্যাংক আরসিবিসি। সেটা একটা নষ্ট ব্যাংক। রিজার্ভ চুরির জন্য প্রধান অপরাধী এই ব্যাংকটিই। তিন বছর পর হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক মামলাটাই করেছে।

আরসিবিসিকে পেমেন্ট অর্ডার কনফার্ম না করতে বার্তা দিয়েছিল ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম (ফেড) এর পরও ব্যাংকটি পেমেন্ট অর্ডার কনফার্ম করে দিয়েছে। এটা অনেক বড় অপরাধ। ওই ব্যাংকটি প্রধান দায়ী সংস্থা। আর মামলা করার ক্ষেত্রে ফেড বাংলাদেশের সঙ্গেই রয়েছে। আমরা যে ডকুমেন্ট দিয়েছি তার অর্ধেকই আরসিবিসির ব্যাপারে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য সুবিধা হবে।

 

দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দ্রুতগতিতে কমছে। অন্যদিকে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি আয়বৈষম্যও বাড়ছে।

এটা ঠিক, আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যটা খুবই তীব্র। এর জন্য প্রয়োজন করকাঠামোর পুনর্বিন্যাস। এমন করকাঠামো চালু করতে হবে। যারা বেশি আয় করেন তারা বেশি কর দেবেন। আর যারা কম আয় করেন তারা কম কর দেবেন। ধনিক শ্রেণির ওপর কর বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা আরও বাড়াতে হবে। বয়স্কভাতা কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে।

বিভিন্ন ধরনের ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। যারা চাকরি-বাকরি পাচ্ছেন না তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উদ্যোক্তা তৈরিসংক্রান্ত বিভাগ খুলতে হবে।

 

সকল শ্রেণির মানুষকে কীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয় অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোয় সেবার আওতা বাড়াতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো, একটি সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করতে হবে। এখন যারা কাজ করছেন তারা পরিবারের কাছে মূল্যায়ন পাচ্ছেন। কিন্তু চাকরি থেকে অবসরে গেলে পরিবার তাকে মূল্যায়ন করে না। এজন্য সব জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থাৎ সব চাকরিজীবীর জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করতে হবে। এজন্য আলাদা একটি অথরিটিও করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উদ্যোক্তা তৈরির কার্যক্রম চালু করতে হবে। সরকারের মাধ্যমে তহবিলের জোগান দিতে হবে; যার মাধ্যমে সব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা সম্ভব হবে।

 

প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে; যার কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

পাচার হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে পাচারের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। চেষ্টা করলে হয়তো এটা আরও কমানো সম্ভব। আমরা জানি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে। ফলে এখানে এনবিআর, কাস্টমস, বাংলাদেশ ইনটেলিজেন্স ফিন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউটকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এলসি কখন খোলা হচ্ছে, কখন নিষ্পত্তি হচ্ছে এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ড্যাসবোর্ডে দ্রুত চলে যেতে হবে। কী পরিমাণ আমদানি কিংবা রপ্তানি হচ্ছে, এলসির আদেশের বাইরে বেশি কম/বেশি অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে কিনা- এসব বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে বড় সফলতা এবং ব্যর্থতা কী বলে আপনি মনে করেন?

আমি খুবই তৃপ্ত একজন মানুষ। আমি তো কোনো এলিট নই। আমি খুবই কৃতজ্ঞ যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমার মতো সাধারণ ঘরের সন্তান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হবেন, এটা অকল্পনীয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ক্যান্ডি শপের (চকলেটের দোকান) মতো। অর্থাৎ সেখানে বসে অসংখ্য পলিসি নেওয়া যায়; যা সাধারণ মানুষের কাজে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নলেজ ইনস্টিটিউশনও। এখানে চেষ্টা করেছি সবরকম চকলেটের স্বাদ নিতে। নতুন নতুন বিভাগ চালু করার চেষ্টা করেছি। নতুন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ব্যাংকগুলো যেন তাদের সেবা নিয়ে মানুষের দ্বারে যায় সে কাজটাই করেছি। আমার জীবনে কোনো অতৃপ্তি নেই। সেটা ব্যক্তিগত, পেশাগত কোনো ক্ষেত্রেই কোনো অতৃপ্তি নেই আমার। তবে কিছু আফসোস রয়েছে, ভালো কাজগুলো কেন আরও বেশি করে যেতে পারলাম না।

 

সরকার ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। এসব বাস্তবায়ন হলে দেশের সম্ভাব্য অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

ইকোনমিক জোনগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে। বেসরকারি খাতের কয়েকটি কোম্পানি ইতিমধ্যে বিনিয়োগ শুরুও করেছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ, আবদুল মোনেম ও নিটল গ্রুপ ইকোনমিক জোন নিয়ে কাজ করছে। এসব জায়গায় বিনিয়োগ শুরু হয়ে গেছে। এজন্য আট/দশটিকে বাছাই করে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। শুধু তাই নয়, বিদেশি কোম্পানি বা উদ্যোক্তারাও ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন। এর ফলে বিনিয়োগের ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের জমিপ্রাপ্তিতে আর কোনো সংশয় থাকবে না। এ ছাড়া অন্যান্য ইউটিলিটি সুবিধার বিষয়েও উদ্যোক্তাদের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এতে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে উৎপাদনের পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়বে কয়েক গুণ। তবে ইকোনমিক জোনগুলোকে ঘিরে ফরোয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ সিস্টেমগুলো চালু করতে হবে।

 

রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের অর্থনীতিতে কোন ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে?

এটা একটা জটিল ইস্যু। এটা তো অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। এটা আমাদের জন্য একটা অতিরিক্ত বোঝা। মিয়ানমার আমাদের সেন্ট মার্টিন নিয়েও বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কাজ করছে। এজন্য দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা উচিত। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনা আরও জোরদার করা দরকার। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের উচিত আরও জোর লবিং করা।

 

ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?

বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় দেখতে চাই যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন। ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশ। আগামী ১০ বছর পর দেশের অর্থনীতি দ্বিগুণ হবে সে স্বপ্ন দেখি এবং বাংলাদেশ এখন সে পথেই হাঁটছে। আমি কবি রবীন্দ্রনাথের মতো বলি- সব দেশেই গরিব মানুষ থাকে। কিন্তু সব দেশকে গরিব দেশ বলা হয় না কেন? কারণ সেসব দেশকেই গরিব দেশ বলা হয়, যেসব দেশের মানুষ আয়-রোজগার করে ধনী হওয়ার ভরসা রাখে না। আমি সে স্বপ্নই দেখি, এ দেশের গরিব মানুষ নিজেরা আয়-রোজগার করে ধনী হবে। এখন কিন্তু দেশে একটা বড় ধরনের ভরসার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর