চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রনয়ণে অনিয়মের ঘটনায় জড়িত শিক্ষকদের সনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা সংক্রান্ত ছোটখাটো সমস্যা হলেই সম্প্রতি বিনা নোটিশেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি কিংবা পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ থেকে বিরত রাখার নজির রয়েছে। এ যেন লঘুপাপে গুরুদণ্ড, গুরুপাপে মিলছে রেহাই অবস্থা। উল্টো দায়ী শিক্ষককে 'বাঁচাতে' তৎপরতা শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ডি ইউনিটে প্রশ্নপত্র প্রনয়ণে অনিয়মের ফলে এ ইউনিটে পরীক্ষা দেওয়া প্রায় ৫৪ হাজার শিক্ষার্থীর ফলাফল আটকে গেছে। এ ঘটনায় দায়ী শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তির আস্থাভাজন হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর দুই শিফটে ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষায় বাংলা মাধ্যম শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ন্যাশনাল কারিকুলাম ও ব্রিটিশ কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজিতে প্রশ্ন প্রনয়ণ করা হয়। ইংরেজি মাধ্যমের এ দুই ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহন করা হয় সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নিচতলার ১০১, ১০২ ও ১০৩ নম্বর কক্ষে। নিয়ম অনুযায়ী, বৃটিশ কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০ নাম্বারের ঐচ্ছিক ইংরেজি প্রশ্ন থাকবে মূল প্রশ্নের সঙ্গে। কারণ বৃটিশ কারিকুলামের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনের কোনও স্তরে মাতৃভাষা বাংলা বিষয়ে পাঠ না নেওয়ায় তাদের ৩০ নম্বরের ঐচ্ছিক ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে।
অন্যদিকে, ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরেই বাংলা বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করতে হয় বিধায় তাদের এ পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে ৩০ নম্বরের পরীক্ষা আবশ্যিক ভাবে দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের ৩০ নাম্বারের বাংলা প্রশ্ন দেওয়া হয়নি। এতে বিপাকে পড়ে যায় ন্যাশনাল কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যমের ৪১৬ জন শিক্ষার্থী।
পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা হলে বাংলার প্রশ্ন না দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের অবহিত করে। এ সময় ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. খসরুল আলম কুদ্দুসী ওই তিন কক্ষের পরীক্ষার্থীদের বৃটিশ কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রনীত ৩০ নাম্বার ঐচ্ছিক ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে বলেন। অথচ তিনি ওই কেন্দ্রে অধ্যাপক ড. খসরুল আলম কুদ্দুসীর পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো দায়িত্বই ছিল না।
অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ শিক্ষক বিধায় তিনি দায়িত্বে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিষয়ে তিনি নাক গলিয়ে থাকেন। অতিউৎসাহী হিসেবে শিক্ষক হিসেবে নৃবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপকও বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো ফাইল স্বাক্ষর হওয়ার আগে এই দুই শিক্ষকের সম্মতি নিতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের। যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব নেই।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে অধ্যাপক ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী সাংবাদিকদের বলেন, ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নপত্র নিয়ে আমি সমাজবিজ্ঞানের ওই হলটিতে যাই। এসময় দেখতে পাই তাদের প্রশ্নপত্রে বাংলা অংশটি নেই। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে প্রশ্ন তৈরির কোনো সম্ভাবনা না থাকায় আমি শিক্ষার্থীদের স্পেশাল ইংরেজিতেই পরীক্ষা চালিয়ে নিতে দায়িত্বরত শিক্ষকদের নির্দেশ দিই।
এদিকে, ড. খসরুল আলম কুদ্দুসীর হাতেই বা কেন ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যাবে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে। কারণ তিনি পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো কমিটিতেই নেই। এ ক্ষেত্রে ডি ইউনিট কো-অর্ডিনেটর ও শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুকে দায় থেকে যায় বলেও জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বলেন, এ বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। জানতে পারলে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে সমাধান করা যেত। আর কুদ্দসী স্যার কোন দায়িত্ব নিয়ে পরীক্ষা হলে এসেছেন তাও আমাকে জানানো হয়নি। তাছাড়া দায়িত্ব বণ্টনের কোনো ফাইলে তার নাম আমার চোখে পড়েনি।
এদিকে, ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার তিন দিন পর এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্য দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে উল্লেখ করা হয়, লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী ঐদিনের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি ডি ইউনিটের কো-অর্ডিনেটরের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের নীচ তলায় ১০১, ১০২ ও ১০৩ নং কক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও এমন কোন দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টি জানেনা ডি ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা কমিটির কোনো সদস্যই।
তাদের অভিযোগ, অনিয়মের তিন দিন পর তাকে 'বাঁচাতে' এই বিশেষ দায়িত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এরকম বিশেষ দায়িত্ব দেয়ার ঘটনা যদি ঘটেও থাকে তাহলে খসরুল আলম কুদ্দুসীর আর দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে, এই প্রশ্ন সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে ৫৪ হাজার শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল আটকে গেছে। ৬ নভেম্বর ৪১৬ জন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা পুনরায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত একটি বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন, প্রশ্ন সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে ডি ইউনিটের ভর্তি কমিটির কো-অর্ডিনেটর ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুক আমাদের জানিয়েছিলেন, প্রশ্ন সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেনি। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ৬ নভেম্বর শুধুমাত্র ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পুনরায় নেয়া হবে। কিন্তু বিষয়টি যে মিথ্যা তা খসরুল আলম কুদ্দুসীর বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি স্বীকার করেছেন, পরীক্ষা চলাকালে কোনো দায়িত্বে না থাকলেও তিনি হলে প্রশ্ন নিয়ে গেছেন। এবং ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের তিনি বাংলার স্থলে বৃটিশ কারিকুলামের জন্য নির্ধারিত ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। তার মানে কুদ্দুসী অভিযোগ পেয়েই বিভ্রান্তিকর একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন। অতএব এখানে খসরুল আলম কুদ্দুসীর দায়িত্ব পালন কতটা আইনানুগ ও যুক্তিসঙ্গত সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
এদিকে ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের সভাপতি পদ থেকে অধ্যাপক ড. গোলাম কবিরকে বিনা নোটিশে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সম্প্রতি। ৫০ নম্বরের পরীক্ষা ৭৫ নম্বরে নেওয়া এবং এ জন্য শিক্ষার্থীদের চার ঘন্টা সময় দেয়ার অজুহাতে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় চবির রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার। অথচ ৫০ নম্বরের পরীক্ষা ৭৫ নম্বরে নেয়া হলেও চার ঘন্টা সময় দেয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এ ঘটনায় পরীক্ষার্থীরা কোনো অভিযোগ না দিলে উপাচার্য নজিরবিহীনভাবে বিভাগীয় সভাপতির পদ থেকে আওয়ামীপন্থী এই শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন৷
এর আগে ২০১৭ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন মাস্টার্স পরীক্ষার্থীদের ২৫ নম্বরের টার্মিনাল পরীক্ষা ১০০ নম্বরে নেয়ায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তাকে সতর্ক করে। বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী কোনো শিক্ষককে 'সতর্ক' করাও একপ্রকার শাস্তি। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গেলেও উচ্চ আদালত সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তকে বহাল রাখে।
কিন্তু ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় এত বড় অনিয়মের ফলে ৫৪ হাজার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জড়িত শিক্ষকরা সনাক্ত করে এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগ, ড. খসরুল আলম কুদ্দুসীসহ লোক প্রশাসন বিভাগের দুই জন শিক্ষক এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক প্রশাসনিক দায়িত্বে না থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিষয়ে খবরদারি করছেন। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা।
ডি ইউনিটের পরীক্ষায়ও এই শিক্ষকদের খবরদারির কারণে ৫৪ হাজার শিক্ষার্থীর ভাগ্য ঝুলে আছে। ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মের বিষয়ে জড়িত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না তা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কেএম নুর আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিডি-প্রতিদিন/ সিফাত আব্দুল্লাহ